শাহআলমের যত কীর্তি
বিশেষ ওএমএস তালিকায় ভোক্তার অধিকার নিয়ে ছিনিমিনিতে জড়িত শাহআলম জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির পদও রেখেছেন দখলে। ওএমএস’র চাল আত্মসাতে ভিক্ষুক, ভবঘুরে মানুষের বদলে নিজের স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজনের নামের তালিকা করে দেশ-বিদেশে আলোচিত এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের শিল্প ও বানিজ্য সম্পাদক পদধারী এই নেতা। আর্ত মানবতার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সর্বশেষ কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদকও শাহআলম। ওই ঘটনার পর ভোক্তার অধিকার রক্ষক, মানবতার অন্য এক সেবকের সাথে পরিচিত হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত তিনি। কিন্তু সবখানেই আছে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ। পদের মর্যাদা রক্ষা পায়নি তার কাছে।
শাহআলমের ওএমএস ডিলারশিপ বাতিল হলেও টিসিবি’র ডিলারশিপ রয়েছে তার নামে।
টিসিবি’র মালের ভোক্তাদের বঞ্চিত করছেন তিনি স্থানীয়দের রয়েছে এমন অভিযোগ। তার নামে বরাদ্দ আসা মালামাল নামমাত্রই খোলাখুলি বিক্রি হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেডক্রিসেন্ট ইউনিট খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে। মোট বরাদ্দ আসা ৫শ’ ব্যাগের মধ্যে শাহআলম প্রভাব খাটিয়ে নেন একশ’ ব্যাগ। খাদ্য সামগ্রীর এই একশো ব্যাগ তিনি কাদের মধ্যে বিতরণ করছেন তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহের। সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক সংগঠন এফবিসিসিআই’র সদস্য পদও রয়েছে তার। জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতা হিসেবে ব্যবসায়িক বিভিন্ন সংগঠনে জায়গা করে নিলেও তার নিজের কোন হোটেল-রেস্তোরাঁ না থাকার অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। ২০১৪ সালে সমিতির নির্বাচনের সময় তার মালিকানার বিষয়ে চ্যালেঞ্জও করা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষ থেকে। তারপরও তিনি জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক পদ আগলে রেখেছেন বেশ ক’বছর ধরে। তার কারণেই শহরের বড় বড় বেশ কয়েকটি হোটেলের মালিকরা সমিতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। সংগঠনের বর্তমান কমিটি তার পকেট কমিটিতে পরিণত হয়েছে বলে জানান হোটেল মালিকরা। সমিতির সভাপতি হিসেবে এই সেক্টরের নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিকদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের নামে প্রতারণার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন জানান- গত ৮ই এপ্রিল জেলা শিল্প বণিক সমিতিতে বক্তৃতায় মো. শাহআলম হোটেল-রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি শ্রমিকদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন বলে জানান। কিন্তু আমরা এর কোন সত্যতা পায়নি। পরে আমরা জেলা শিল্প ও বণিক সমিতিতে আবেদন করে এ বিষয়ে ডকুমেন্টারি তথ্য পেশ করার দাবি জানাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি সেই তথ্য পেশ করেননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্প ও বনিক সমিতির পরিচালক পদও শাহআলমের দখলে।
ব্যসায়িক সংগঠনের এসব পদ ছাড়াও তার রয়েছে আরো অনেক পদপদবী। প্রধানমন্ত্রীর কার্য়ালয়ের উদ্যেক্তা সৃষ্টি প্রকল্পের জেলা পরিচালনা পরিষদের সদস্য শাহআলম। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির সাধারন সম্পাদক, সুইড ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কাউতলী শহীদ লুৎফুর রহমান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির পদও তার দখলে। জেলা জামে মসজিদ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদেও রয়েছেন তিনি। নিজ গ্রাম কাউতলীর ঈদগাহ মাঠের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, কাউতলী কবরস্থান কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহআলম। এতো পদপদবীর ভারে প্রশাসনের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। আর তাতেই অনিয়মে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ওএমএস তালিকায় অনিয়মের পর ডিসি-এসপি’র সঙ্গে উঠানো তার ঘনিষ্ঠ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াছড়ি হয়। ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সাধারণ শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, চায়ের দোকানদার, হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বদলে আওয়ামী লীগ নেতা শাহআলম নিজের স্ত্রী-সন্তান আর স্বজনদের নামে করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষ ওএমএস পাওয়ার তালিকা করেন।
মানবজমিনে এ রিপোর্ট প্রকাশের পর তদন্ত নেমে সত্যতা পায় প্রশাসন। স্ত্রী-সন্তানসহ তার ঘনিষ্ঠ ১৩ জনের নাম পায় তালিকায়। এরপরই ব্যাখ্যা তলব করে তার ওএমএস ডিলারশিপ বাতিল করা হয়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবির নাথ চৌধুরী জানান- তার ডিলারশিপের অধীনে থাকা ৫শ’ জন ভোক্তার মধ্যে এপ্রিল মাসে সব ভোক্তার মধ্যে চাল বিক্রি দেখিয়েছেন তিনি। মে মাসের বরাদ্দ থেকে তার ডিলারশিপ বাতিলের আগ পর্যন্ত ৪২৫ জনের মধ্যে চাল (প্রতিজন ২০ কেজি) বিক্রি দেখিয়েছেন। বৃহস্পতিবার পার্শ্ববর্তী একজন ডিলারের মাধ্যমে অবশিষ্ট ৭৫জনের মধ্যে চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়। এরমধ্যে ২৫ জন চাল কিনে নিয়েছেন। এখনো ৫০ জন বাকি রয়েছে। এদিকে প্রাথমিকভাবে শাহআলমের করা তালিকা যাচাই বাছাইয়ে অনিয়ম ধরা পড়ে। সামর্থ্যবান মোট ২২ জনের নাম পাওয়া যায় তালিকায়। কিন্তু পুরো তালিকা যাচাই-বাছাই হয়নি এখনো। আগে বরাদ্দ করা চাল প্রকৃতই ভোক্তারা কিনেছেন কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হয়নি।
প্রতিবেদনটি মানবজমিনে প্রকাশিত