তিতাস এখন কাটাছেঁড়া খালের নাম
যে তিতাস নদীকে কেন্দ্র করে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্ব, সেই তিতাস আর এখন নদী নেই। এ নদী পরিণত হয়েছে কাটাছেঁড়া খালে। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যের এ নদী এভাবেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিতাস নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় আগের মতো জেলেরা আর মাছ ধরতে যান না। তিতাসের বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। সে চরই নদীকে পরিণত করেছে কাটাছেঁড়া খালে। ওয়াকিবহাল সূত্র মতে, মেঘনা থেকে বোমালিয়া খাল দিয়ে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-নাসিরনগর ব্রিজের নিচ দিয়ে ভাটির দিকে যে পানি প্রবাহিত হচ্ছে- তা থেকেই তিতাস নদীর সৃষ্টি। পরে তা জেলার নবীনগর উপজেলার চিত্রি গ্রামে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিলেছে। দেশের অন্যান্য নদীর চেয়ে এ নদী বেশি আঁকাবাঁকা। সর্পিল তিতাসের প্রায় ৪০ কিলোমিটারই এখন ভরে গেছে চর-ডুবোচরে। ফলে নদীর বুকে আর মাঝি-মাল্লাকে পাল তোলা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় না। বর্ষায়ও চোখে পড়ে না তিতাসের রুদ্র মূর্তি। নদীর পাড়গুলো দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। বর্ষা মৌসুম শেষের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন নৌরুট। এ ছাড়া আখাউড়ার দিকে ধাবিত হওয়া তিতাস নদীর অংশ সম্পূর্ণরূপে মরেই গেছে। সূত্র জানায়, এক সময়ের কালিদাস সায়র (সাগর) নামে পরিচিত তিতাস নদী ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে কল্পনাও করা যেত না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, সদর, বিজয়নগর, নাসিরনগর ও নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিতাসের কূলঘেঁষে ছিল বড় বড় হাটবাজার। বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকানের পণ্যসামগ্রী নৌকা দিয়েই আনা-নেওয়া করতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার আনন্দবাজার, টানবাজার, গোকর্ণঘাট, বিজয়নগরের চান্দুরা বাজার, নাসিরনগরের হরিপুর, সরাইলের শাহবাজপুর, আখাউড়ার বড়বাজার ও নবীনগরের বড়াইল, গোসাইপুর এলাকায় ছিল বড় বড় বাজার। ঘাটগুলোতে ভিড় করত মালবাহী নৌকা। নদীকে ঘিরে আখাউড়া বড়বাজার, বিজয়নগরের চান্দুরা, নাসিরনগরের হরিপুরে গড়ে উঠেছিল বিশাল পাটের বাজার। ছিল ডাউস আকৃতির গুদাম। কমপে অর্ধ লাখ জেলে এক সময় নৌকা ও ডিঙি দিয়ে সারা বছর মাছ ধরত। জীবিকার একমাত্র অবলম্বই ছিল মাছ ধরা। জানা গেছে, সেই নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জেলেদের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। এখন অধিকাংশ জেলে পরিবারই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। খনন না করায় স্রোতস্বিনী তিতাস নাব্যতা হারিয়েছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ি ঢলে নদী ভরাট হচ্ছে। ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলি তিতাসের নাব্যতাকে থামিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে দখলবাজদের কবলে পড়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর, মজলিশপুর, বাকাইল, শহরের পূর্বমেড্ডা, পাইকপাড়া, আনন্দবাজার, টানবাজার ও শিমরাইলকান্দি এলাকায় পাড় ভরাট করে গড়ে উঠেছে স্থায়ী অবৈধ স্থাপনা। নাব্যতা হারানোর ফলে কৃষি জমিতে সেচকার্যে বিঘ্ন ঘটছে। এসব বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, গত ৬ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে তিতাস নদী খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিতাসের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৯১ কিলোমিটার খননের জন্য ১৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ভ্যাকু মেশিন দিয়ে তিতাস নদীর খননকাজ প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হয়েছে। পরে অত্যাধুনিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদীর গভীরতার কাজ শুরু করা হবে। ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে খননকাজ সম্পন্ন হবে।
প্রতিবেদন, মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।