ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল :: রাউন্ডের ছুতায় সময় মানেন না চিকিৎসকরা! ডা. রানা নুরুস্ শামস বসেন প্রাইভেটে!
সকাল পৌনে ৮টা থেকেই রোগীদের আনাগোনা। সাড়ে ৮টার পর খুলল টিকিট (বহির্বিভাগে রোগী দেখানোর স্লিপ) কাউন্টার। টিকিটের গায়ে লেখা কক্ষ নম্বর অনুযায়ী রোগীরা চলে গেল যে যার মতো করে। ওই সব কক্ষের সামনে এক এক করে রোগীর ভিড় বাড়তে থাকল।
সকাল সোয়া ৯টা। নিচতলার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ১১৩ নম্বর কক্ষের সামনে ৫০-৬০ জন রোগীর সারি। সবার অপেক্ষা চিকিৎসকের জন্য। পাশের আরো দুই-তিনটি কক্ষের সামনেও প্রায় একই অবস্থা। দ্বিতীয় তলার ২১২ নম্বর কক্ষের সামনেও রোগীর ভিড়। তখনো চিকিৎসক আসেননি এসব কক্ষে।
কথা হয় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে।
তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মচারীরা খোঁজ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ককে জানান, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ১১৩ নম্বর কক্ষের চিকিৎসক মো. আমজাদ হোসেন আসেননি। অন্যদিকে ২১২ নম্বর কক্ষের ইকবাল হোসেন রাউন্ডে (শয্যায় থাকা রোগী দেখা) আছেন। অন্য কক্ষের চিকিৎসকদের সম্পর্কেও খোঁজ নিতে শুরু করেন তত্ত্বাবধায়ক। তাত্ক্ষণিকভাবে মো. মনির হোসেন নামের একজন মেডিক্যাল অফিসারকে ১১৩ নম্বর কক্ষে গিয়ে রোগী দেখতে বললেন।
সরেজমিনে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল রাউন্ড দেওয়ার নাম করে চিকিৎসকদের নিয়ম না মানার এ চিত্র। সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ চিকিৎসককে সেটা মানতে দেখা যায়নি।
অবশ্য দুপুর ১টার দিকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আমজাদ হোসেন জানান, তাঁকে ওএসডি করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তার পরও তিনি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে এসে রাউন্ড দিতে হয় বলে সকাল ৮টায় এলেও বহির্বিভাগে কক্ষে বসতে ১০টা-১১টা বেজে যায়।
শুধু তাই নয়। হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার সময়ে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে (আরএমও) পাওয়া গেল হাসপাতালের উল্টো দিকের ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তিনি হলেন ডা. রানা নুরুস্ শামস। দুপুর পৌনে ২টার দিকে তিনি ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে উঠে ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে যান। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গিয়ে এ প্রতিবেদক পরিচয় না দিয়ে ডা. রানা নুরুস্ শামস এখানে রোগী দেখছেন কি না জানতে চাইলে হ্যাঁ সূচক জবাব পাওয়া যায়।
তবে ব্যতিক্রম দেখা গেল চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইয়ামলী খানকে। সকাল সোয়া ৮টা থেকেই তিনি রোগী দেখা শুরু করেন। তাঁর কক্ষের সামনে ছিল রোগীর দীর্ঘ সারি। নিয়মিত চিকিৎসা করাতে আসা কয়েক রোগী জানান, ইয়ামলী খানকে নিয়মিতই সময়মতো হাসপাতালে পাওয়া যায়।
কথা হয় দুই শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসা জেলার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরের মো. ইউনুস আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, পৌনে ৯টায় টিকিট পেলেও পৌনে ১০টা পর্যন্ত চিকিৎসকের দেখা পাননি। ৩০৩ নম্বর কক্ষের সামনে দাঁড়ানো কসবা উপজেলার শাহপুর গ্রামের সোহেল সকাল সোয়া ৯টার দিকে জানান, তিনি ডা. এ কে এম নিজাম উদ্দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। বলা হচ্ছে, তিনি ১০টা-১১টার দিকে আসবেন। অনেকেই জানান, সকাল সোয়া ৯টার দিকে ডা. নিজাম উদ্দিনকে দোতলা-তিনতলার বিভিন্ন কক্ষে ঘুরতে দেখেছেন। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে নিজাম উদ্দিনকে তাঁর নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করতে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌলভীপাড়ার গোলাম মোস্তফা নামের এক রোগী।
সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে ডা. ফৌজিয়া আখতার তাঁর জন্য নির্ধারিত দ্বিতীয় তলার ২০৬ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার মধ্যপাড়ার লাভলী আক্তার নামের এক রোগী ওই কক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে বাদ সাধেন এক তরুণী। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম রাউন্ড দিয়ে এসে রোগী দেখবেন। ’ মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে তিনি রোগী দেখা শুরু করেন। ডা. ফৌজিয়া দুপুর দেড়টার দিকে প্রাইভেট কারে করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান।
প্রচণ্ড দাঁতের ব্যথা নিয়ে সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার খলিল সরকার। ব্যথা সহ্য হচ্ছে না জানিয়ে ২১০ নম্বর কক্ষের চিকিৎসক কখন আসবেন জানতে চান তিনি। দন্তরোগ বিভাগের চিকিৎসক নাজিম উদ্দিন সকাল ১০টার দিকে রোগী দেখা শুরু করেন। দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ তিনি ৭০-৮০ জন রোগী দেখেন বলে জানান। এ কক্ষের চিকিৎসক ডা. এম এ মনসুর ছেলে অসুস্থ থাকায় এবং নাফিসা আলম মুমু মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন বলে জানায় হাসপাতাল সূত্র।
১১২ নম্বর কক্ষের ডা. এম এ এহসান ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই আসবেন বলে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জানান ওই কক্ষে অবস্থানরত মজিদ মিয়া। নিজেকে হাসপাতালের কর্মচারী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, ‘স্যার সবার আগে আসেন। ’ সাড়ে ৯টা নাগাদ তিনি না আসার কারণ জানতে চাইলে মজিদ মিয়া বলেন, ‘স্যার রাউন্ডে আছেন। ’ সোয়া ১০টা থেকে রোগী দেখা শুরু করেন ডা. এহসান।
ডা. শেখ আবু জাফরকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দুটি পত্রিকা হাতে প্রবেশ করতে দেখা যায়। দুপুর ১টার দিকে তাঁর জন্য নির্ধারিত ১০৫ নম্বর কক্ষটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। ১১১ নম্বর কক্ষের ডা. মো. শাহজাহান সকাল সোয়া ৯টা থেকে রোগী দেখা শুরু করেন। সময়মতো এসে তিনি ওপরে ছিলেন জানিয়ে এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসকের কক্ষই খালি। মূলত ৯টার পর থেকেই চিকিৎসকরা আসতে শুরু করেন। তবে নির্ধারিত সময় আড়াইটার আগেই তাঁরা চলে যান।
রোগীদের দাবি অনুযায়ী, রাউন্ড দিতে চিকিৎসকদের খুব একটা সময় দিতে হয় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুধু তাঁদের চিকিৎসার আওতাধীন রোগীদের দেখে আসেন। এ ক্ষেত্রে একেকজন চিকিৎসক হয়তো কয়েকজন রোগীকে দেখে আসেন। এ অবস্থায় তাঁদের আধঘণ্টার বেশি সময় দিতে হয় না।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখানে চিকিৎসকের বেশ সংকট রয়েছে। চোখের চিকিৎসার জন্য মাত্র একজন রয়েছেন। শিশুদের জন্য থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো. মনির হোসেন সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রেষণে গেছেন। শিশুদের জন্য দুজন কনসালট্যান্ট ও একজন মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন, যা খুবই অপ্রতুল। অন্যান্য বিভাগে কোনো চিকিৎসক ছুটিতে গেলেই সমস্যায় পড়তে হয়।
টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তিকে দেরিতে কাউন্টার খোলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জানান, সময়মতোই তিনি চলে এসেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘যেসব চিকিৎসক নিয়মিত আসেন, তাঁদের কক্ষের নম্বরই দেওয়া হয়। এখন কেউ যদি না এসে থাকেন তাহলে তো এটা আমি বলতে পারব না। ’
হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, ভালো চিকিৎসক হিসেবে যাঁরা পরিচিত, বিশেষ করে কনসালট্যান্টরা প্রায়ই দেরি করে আসেন। কেউ আবার অফিস সময়েই হাসপাতালের পাশের ক্লিনিকে গিয়ে বসেন। নানা কারণে এ বিষয়ে তাঁদের কিছু বলার থাকে না।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কয়েক দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করছি। সকাল সোয়া ৯টার দিকে এসে আমি মোটামুটি সবাইকেই হাসপাতালে পেয়েছি। তবে আসার পরপরই চিকিৎসকদের রাউন্ড দিতে হয় বলে অনেক সময় তাঁরা সময়মতো বহির্বিভাগে বসতে পারেন না। কেননা রাউন্ডে অনেক সময় লেগে যায়। রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা, সব বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার কারণে তাঁদের একটু বেশি সময় দিতে হয়। ’