ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিসির নম্বর থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানকে ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দাবি!!
উপজেলা চেয়ারম্যানকে ডিসির ফোন। তবে বার্তা অন্যরকম। অফিসিয়াল কোনো আদেশ-নির্দেশ নয়, সোজা টাকার আবদার। ডিসির নম্বরও ঠিক আছে। নম্বর মিলিয়ে এক চেয়ারম্যান সেই আবদারও পূরণ করেছেন। দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। বিকাশের খরচসহ ৫১ হাজার টাকা। আরেক চেয়ারম্যান অবশ্য বিরত থাকেন। তার কাছেও দাবি করা হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। তবে এই চেয়ারম্যানের কাছে টাকা চাওয়ার কারণ ছিল ভিন্ন। বলা হয়েছিল, ৫০০ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার উপজেলায়। সে জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। আর আগের চেয়ারম্যানের কাছে বাড়ি কেনার প্রয়োজনে ৫০ হাজার টাকা ধার চেয়ে নেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসকের সরকারি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার এই ঘটনা সম্প্রতি আলোচিত হয়েছে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে নতুন জেলা প্রশাসক রেজুওয়ানুর রহমান যোগ দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে এই ঘটনা। নতুন ডিসির কণ্ঠ পরিচিত হওয়ার আগেই জাল ফেলে প্রতারকচক্র। আশুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আসিফ ডিসির নম্বরের এই বিশেষ ফোনটি পান গত ৬ই অক্টোবর সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে। আসিফ জানান, তাকে ফোন দিয়ে প্রথমে সালাম দেয়া হয়। তার মোবাইলের পর্দায় সমস্যার কারণে বুঝতে পারেননি ফোনকারী কে? পরিচয় জানতে চাইলে বলা হয়, আপনার কাছে কি ডিসির নম্বর নেই। বলা হয় ২ মিনিট পর ফোন দিচ্ছি। নম্বর চেক করেন। তখন আমি নম্বর মিলিয়ে দেখি- ঠিকই আছে। এটি তো ডিসিরই নম্বর। আবার ফোন আসে। বলে আমার ভাই বাড়ি কিনেছে, বিদেশ চলে যাবে। কিছু টাকার দরকার ছিল। আমি তখন বলি সমস্যা নেই, হাতে কিছু টাকা আছে দিতে পারবো। বলি সোহাগকে (অফিস স্টাফ) দিয়ে আপনার কাছে অফিসে পাঠিয়ে দেই। তখন আমাকে বলা হয় টাকা এখানে দরকার নেই। আমি আপনাকে আমার ভাইয়ের নম্বর দিচ্ছি। সে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এর পরই ওই নম্বর (ডিসির ভাই পরিচয়দানকারী) থেকে ফোন আসে। আমাকে বলা হয় ভাইজান কিছু বলেছে। তখন আমি তার কাছে জানতে চাই টাকা কিভাবে পাঠাবো। বলে বিকাশে। কিন্তু এক নম্বরে তো ৫০ হাজার টাকা পাঠানো যাবে না। তখন আমাকে সে দুটি বিকাশ নম্বর দেয়। এই সময়ের মধ্যে আমি গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার-এ যোগাযোগ করি। জানতে চাই, আমার নম্বর অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে কিনা। তখন তারা আমাকে বলে, এরকম কোনো সুযোগ নেই। এরপর আমি নিশ্চিত হয়ে ওই দুই বিকাশ নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেই। টাকা পাঠানোর চার্জও আলাদা দেই এক হাজার টাকা। আসিফ বলেন, আমি ফের ডিসির নম্বরে ফোন দিয়ে আর জিজ্ঞেস করিনি। ভেবেছি উনি আবার কিনা কি মনে করেন। তাছাড়া সমস্যা তো হতেই পারে। আমাকে আবার বলেছে, রোববার অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন। টাকাটাও নিয়ে যাবেন। সে কারণে আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করিনি। সন্দেহও হয়নি। ৫০ হাজার টাকা দেয়ার পর আবার আমাকে ফোন করা হয়। তখন বলা হয় বাড়ি কিনেছিলাম। টাকা তো আরও অনেক দরকার। এবারও ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। দ্বিতীয় বার ফোন দেয়ার পর আমার সন্দেহ হয়। আমি এক ঘণ্টা পর ফোন দেব বলে রেখে দেই। এরপর আবার গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে বলে এরকম সুযোগ নেই। ইন্টারনেটের সাহায্যে কোনো কারসাজি করে হয়তো এরকম (একই রকম নম্বর) করতে পারে। এরপর আমি ডিসি সাহেবকে ফোন দেই। তখন তিনি আমাকে বলেন, আপনাকে ইউএনও সাহেব কোনো কিছু বলেননি। আসিফ জানান, নম্বর একই হলেও পরে আমি বুঝতে পারি কোড নম্বরের পার্থক্য রয়েছে। গ্রামীণফোন নম্বর থেকে যেসব ফোন আসে তার আগে কোড নম্বর থাকে + ৮৮০। কিন্তু প্রতারকদের ব্যবহার করা নম্বরটিতে কোড ছিল শুধু ৮০।
ডিসির নম্বর থেকে ভুয়া ডিসি কাছাকাছি সময়ে ফোন করেন বাঞ্ছারামপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামকে। নূরুল ইসলাম জানান, তাকে বলা হয় তার উপজেলার জন্য পাঁচশ’ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সে জন্যে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা নিয়ে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। তিনি বলেন, নতুন ডিসি যোগদানের পর আমাদের সঙ্গে একদিন বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে গলার স্বর চেনা মনে হয়নি। এতে আমার মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। আমি ডিসিকে ফোন করি। ফোন রিসিভ করে আবারও বলা হয় ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন ৫শ’ টন গম পেয়ে যাবেন। একটি নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। আমি তখন ওই নম্বরে ফোন দেই। ফোন রিসিভকারীকে বলে সচিবালয়ে, আপনি কোথায় আছেন? কোন কক্ষে আছেন বলেন, আমি আপনার টেবিলে টাকা পৌঁছে দেব। তখন বলা হয় বিকাশে পাঠাতে। এরপরই আমার সন্দেহ হয়। তখন আমি গালাগাল করে বলি কারে ফোন করছিস বুঝতে পারসনাই।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির চলতি মাসে হওয়া বৈঠকে (৯ই অক্টোবর) ডিসির নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার এ ঘটনা আলোচনায় আসে। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক রেজুয়ানুর রহমান তখন সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক করেন। বিশেষ করে জেলার ব্যবসায়ীদের।
জেলা প্রশাসক রেজুয়ানুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে চাননি।
তবে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, শুধু মোবাইল ফোন নয়, ডিসির ফেসবুক পেজেও উল্টাপাল্টা লেখালেখি হয়েছে। জেলা প্রশাসক বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে জানিয়েছেন।
কয়েক মাস আগে জেলা পুলিশের পদস্থ এক কর্মকর্তার ফোন নম্বর প্রতারকদের ব্যবহার করার বিষয়টি ধরা পড়ে এক সাংবাদিকের কাছে। ওই সাংবাদিক এ বছরের ১০ই জানুয়ারি জেলায় মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা সম্পর্কে জানতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (বর্তমানে এসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র বদলি এমএ মাসুদ) সরকারি নম্বরে ফোন দেন। কিন্তু গলার স্বর ভিন্ন পান। মিছিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বলা হয়- ‘আমার বরাত দিয়ে লিখে দেন ওরা মিছিল করছিল শান্তিপূর্ণভাবে। সেই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি করেছে। বুঝতে পেরেছেন। রিপোর্টটি এভাবেই লিখে দেন।’ এমন বক্তব্য এবং গলার স্বরের ভিন্নতার কারণে সন্দেহ হয় ওই সাংবাদিকের। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ফোন অন্য কারো হাতে ছিল কিনা বা অন্য কেউ ব্যবহার করছে কিনা তা নিশ্চিত হতে আবারও ফোন দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সরকারি নম্বরে। এবার আসল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফোন রিসিভ করলে তার কাছে জানতে চান ফোন কিছু সময় আগে অন্য কেউ রিসিভ করেছিল কিনা। তিনি না বলার পর ওই সাংবাদিক তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। বলেন, প্রতারক ব্যবহার করছে তার নম্বর।
সূত্র :: মানবজমিন