শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)
আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে সময়টা ইতিহাসে বর্বরতার যুগ নামে খ্যাত। এমনি সময়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন সর্বকালীন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। জন্মেই তিনি পেয়েছিলেন জীবনযন্ত্রণার তিক্ত স্বাদ। বাবা ডাকটি তিনি কোনো দিন উচ্চারণ করতে পারেননি। মা বলে ডাকার সুযোগটাও হারান খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। দেখেছিলেন গোত্রপতিদের স্বেচ্ছাচারিতা, কুলিনদের দাম্ভিকতা, পুঁজিপতিদের আগ্রাসী থাবা কত মারাত্মক! মনুষ্য সমাজ আর মানবজীবন অশান্তির গহ্বরে কতটা নিচে তলিয়ে যেতে পারে! তাই হয়তো তিনি পণ করেছিলেন, যে করেই হোক শান্তির পায়রাকে ধরণীতে নামাতেই হবে! আর মহান বিধাতা তো তাঁকে সৃষ্টিই করেছিলেন অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে—শান্তি প্রতিষ্ঠায়। তাই তিনি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ছুটে চলেছেন শান্তির অন্বেষায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাকে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আল-আম্বিয়া : ১০৭ ) জন্ম যাঁর শান্তি নির্দেশিত, তিনি আজীবন সে ঠিকানায় ছুটে চলবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাই তো বোধহীন শিশুবেলায়, দুরন্ত কৈশোরে, উদীপ্ত যৌবনে আর জীবনের সাঁজবেলায় তিনি ছুটেছেন একই লক্ষ্যে। কয়েক দিনের একটি শিশু ধাত্রী মায়ের এমটি স্তন পান করে অপরটি দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিয়েছেন কোন বিচারে? হ্যাঁ! ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত না হলে যে শান্তি আসবে না! ১৪ বছরের দুরন্ত কিশোর নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের শপথ অনুষ্ঠানে (হিলফুল ফুজুল গঠনে) যোগদান করে কিসের প্রেরণায়? তাঁর জবানিতেই শুনুন, ‘ইবনে জুদানের ঘরে আমি যে শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলাম, একপাল লাল উটের বিনিময়েও যদি আমাকে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হতো তাহলেও আমি তা গ্রহণ করতাম না। আজও যদি এ ধরনের কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং আমাকে তাতে শরিক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়, আমি তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করব না।’ (আস্-সুনানুল কুবরা : বায়হাকি)
যে যুবক নিজের শরীরে ৪০ জন যুবকের শক্তি ধারণ করেন, ‘জোর যার মুলুক তার’ যুগে কিসের নেশায় সে রাতের আঁধারে মসজিদে ছোটে আর উদ্ভূত সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষগুলোই বা কেন তাঁর শরণাপন্ন হয়? ঘটনা যখন ঘটে, মহানবী (সা.) তখন ৩৫ বছরের যুবক। কোরাইশরা খানায়ে কাবা নির্মাণ করতে গিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের উপক্রম হয়েছিল। আল্লামা ইদ্রিস কান্দলবি (রহ.) লিখেছেন, ‘যখন নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় এবং হাজরে আসওয়াদ তার স্থানে রাখার সময় হয়, তখন ভীষণ মতবিরোধ দেখা দেয়। তরবারি কোষমুক্ত হয় এবং লোকজন যুদ্ধবিগ্রহ, হত্যা-ধ্বংসের জন্য প্রতিজ্ঞ হয়। যখন এভাবেই চার বা পাঁচ দিন কেটে গেল, কোনো সিদ্ধান্তই হলো না, তখন আবু উমাইয়া ইবনে মুগিরা প্রস্তাব করলেন, কাল প্রভাতে যে সর্বপ্রথম মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তাঁকে সিদ্ধান্তদানকারী বানিয়ে তাঁর দ্বারা সিদ্ধান্ত করিয়ে নাও। সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হয়। অধীর অপেক্ষা শেষে দেখা গেল, কাবাঘরে সবার আগে প্রবেশ করছেন মুহাম্মদ (সা.)। সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, ‘মুহাম্মদ, আমাদের আল-আমিন! আমরা সবাই তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সম্মত।’ হজরত মুহাম্মদ (সা.) বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে একটি চাদর আনতে বলেন। নিজ হাতে তার ওপর হাজরে আসওয়াদ রেখে চার গোত্রের চারজনকে দিয়ে সেটি বহন করিয়ে যথাস্থানে পাথরখানা স্থাপন করে দিলেন। আর এভাবেই উদ্ভূত যুদ্ধাবস্থার অবসান হয়ে শান্তি স্থাপিত হয়।’ (সিরাতুল মুস্তাফা)
হুদায়বিয়ার সন্ধি ও রাসুলের শান্তির অন্বেষা
মহানবী (সা.) জন্ম নিয়েছিলেন কাবার তত্ত্বাবধায়ক পরিবারে। হিজরতের পর দীর্ঘ ছয়টি বছর পেরিয়ে গেল, নিজ প্রভুর ঘর তাওয়াফ করতে পারছেন না মহানবী (সা.)। হিজরতের ছয় বছরের মাথায় স্বপ্নযোগে নিজেকে ওমরাহ পালন করতে দেখে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন তিনি। আল্লাহর রাসুলের সদিচ্ছার কথা খুব অল্প সময়ের মধ্যে মদিনা ও আশপাশের মুসলমানদের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। ওমরাহ পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাসুলের সঙ্গী হলেন তাঁর ভক্তকুল। মহানবী (সা.) ১৪০০ সঙ্গী নিয়ে হোদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কোরাইশরা তাঁদের আটকে দেয়। যেকোনো মূল্যে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাথিদের কাবা জিয়ারত করতে না দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। এদিকে সাহাবিরা জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে মহানবী (সা.)-এর অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন কোরাইশদের অন্যায় আস্ফালনের জবাব দিতে। কিন্তু আল্লাহর রাসুল সাহাবিদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও এক অসম চুক্তিতে উপনীত হলেন কোরাইশদের সঙ্গে। চুক্তির ধারাগুলো ছিল (১) উভয় পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে আগামী ১০ বছর কোনো যুদ্ধ করবে না। (২) কোরাইশদের যেসব লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাদের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মদিনায় চলে যাবে, মুসলমানরা তাদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। (৩) কোনো মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে মক্কায় চলে এলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। (৪) অন্যান্য আরব গোত্র উভয় পক্ষের কারো সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে অপর পক্ষ তাতে বাধা দিতে পারবে না। (৫) এ বছর তাওয়াফ ও জিয়ারত না করেই মুসলমানরা ফিরে যাবে। (৬) আগামী বছর মুসলমানরা ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে। তবে মাত্র তিন দিন তারা সেখানে অবস্থান করতে পারবে। আর আত্মরক্ষার জন্য শুধু তরবারি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না। [হায়াতে মুহাম্মদ (সা.)] চুক্তির ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে যেকোনো সামান্য বোধের মানুষের মনেও প্রশ্নের উদয় হওয়ার কথা, হজরত মুহাম্মদ (সা.) কেন এমন চুক্তি স্বাক্ষর করলেন? তিনি তা করেছিলেন শুধুই শান্তির অন্বেষায়, যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের দিন বিশ্বশান্তির বার্তা
রাসুলুল্লাহ (সা.) যেদিন চূড়ান্তভাবে মক্কা বিজয়ের পর খানায়ে কাবার চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে, তখন তাঁর সামনে ছিল অতীতের সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল মক্কার অধিবাসীরা। চারপাশ ঘিরে নির্দেশের অপেক্ষায় তীক্ষ তরবারি হাতে মুসলিম সেনাদল। সেদিন মহানবী (সা.) বলতে পারতেন, ‘ওদের গর্দান উড়িয়ে দাও! যে হাত শান্তিকামী তাওহিদবাদীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল, ওই হাতগুলো কেটে দাও! যে চোখগুলো অসহায় মুসলমানদের দিকে হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে তাকাত, সে চোখগুলো উপড়ে ফেলে দাও! যে মুখ আল্লাহ, তাঁর রাসুুল ও মুমিনদের বিরুদ্ধে শুধুই মিথ্যা অপবাদ, বিষোদগার আর কুত্সা রটনা করে বেড়াত, সে জিহ্বাগুলো কেটে ফেলে দাও!’ তিনি ঘোষণা করতে পারতেন, ‘আজ থেকে কোরাইশ জালিমদের পুরুষরা বিজয়ী মুসলিম বাহিনীর গোলাম আর নারীরা দাসী হিসেবে গণ্য হবে।’ আশ্চর্য হলো, কোরাইশরাও তাদের প্রাপ্য এমনটা ছিল বলে বিশ্বাস করত। কিন্তু মহানবী (সা.) তেমন কিছুই বলেননি। তিনি বলেছিলেন : ‘লা-তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা ওয়া আন্তুমুত্তুলাক্বা।’ অর্থাত্ আজ তোমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত। এভাবেই মহানবী (সা.) একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বসমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ রচনা করে গিয়েছিলেন।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব
রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ