আখাউড়া এখন টাকাউড়া
টাকা উড়ছে সর্বত্র। কর্মীদের হাতে হাতে, নির্বাচনী ক্যাম্পে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে, নেশার আস্তানায় কোথায় উড়ছে না টাকা? ভোটাররাই বলছেন টাকা উড়ার এমন চিত্র আগে কখনও দেখেননি তারা। দেবগ্রামের বৃদ্ধ রমজান আলী বললেন, আখাউড়া এখন আর আখাউড়া নেই। হয়ে গেছে টাকাউড়া। গতকাল রোববার, বিকাল তিনটা। আখাউড়া পৌর শহরের সড়ক বাজারের নাইন স্টার হোটেল। ভেতরে অনেক ভিড়ভাট্টা। ফাঁকা নেই কোথাও। কাস্টমারদের সবাই নির্বাচনী প্রচারে আসা বহিরাগত। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে এসেছেন জেলার বিভিন্নস্থান থেকে। হোটেল বয়-বেয়ারা তাদের খাবার সরবরাহে ব্যস্ত। সাধারণ কাস্টমারদের খবর দেয়ার সময় নেই তাদের। আর এই ভিড়ের কারণে কম সিদ্ধ ভাত-মাংস তুলে দেয়া হচ্ছে কাস্টমারের পাতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো- সাধারণ সময়ে প্রতিদিন দেড়-দু’শ’ লোকের খাবারের আয়োজন হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে দিন-রাত মিলিয়ে ৭/৮’শ লোকের খাবার রান্না হচ্ছে হোটেলটিতে। একই অবস্থা একই সড়কের ঢাকা হোটেলেও। হোটেলে হোটেলে এই বাড়তি খাবারের আয়োজন সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রচারকর্মীদের জন্যই। এই হোটেল দুটি ঘিরেই আখাউড়া পৌরসভার সড়ক বাজারে বহিরাগত অনেক মানুষের দেখা মিলে। মাইক্রো-হোন্ডা পার্কিং করা রাস্তার দু-ধারে। গত প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে দলবেঁধে জেলার বিভিন্নস্থান থেকে এমনকি ঢাকা থেকে আসছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। তারা প্রচারণা শেষে এখানে এসে ভিড় করছেন। খাবার খাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে দেয়া স্লিপে খাবার দেয়া হচ্ছে। নাইন স্টার হোটেলটিতে গতকাল দুপুরের খাবার খেয়েছেন ২৭০ জন।
শুধু ভাত-তরকারি খাবারেই টাকা উড়ছে তা নয়। সীমান্তবর্তী এই শহরে বিশেষ প্রার্থীর পকেটের টাকা উড়ছে অন্যভাবে। প্রচারে আসা তরুণ-যুবকদের আকর্ষণ অন্য জিনিসে। নাইন স্টার বা ঢাকা হোটেলে খাবারের পরই তারা ছুটে যান বিশেষ খাবারের খোঁজে। সীমান্তের বিশেষ বিশেষ স্পটে। এখন কোনো কিছুতেই বাধা নেই পুলিশের। অবাধে বিক্রি হচ্ছে ফেনসিডিল-বিয়ার, অফিসার্স চয়েজ, সিগনেচার-ব্র্যান্ডের মদ। সবই পাচ্ছেন প্রচারে আসা অতিথিরা হাত বাড়ালে। সীমান্তের নারায়ণপুর, দুর্গাপুর, নূরপুর, কুড়িপাইকা, কল্যাণপুর, বাউতলা, উমেদপুর, আজমপুর, রাজাপুর এসব এলাকায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে নানা মাদকদ্রব্য। নূরপুরের এক মাদক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন- তাদের ব্যবসা এখন ভালো। মালের চাহিদা অনেক বেশি। আখাউড়া থানা পুলিশ যে হাত গুটিয়ে বসে আছে তারও প্রমাণ রয়েছে ডিসেম্বর মাসের অভিযানে। এই মাসে মাত্র ১৪ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে এই থানা পুলিশ। এ ছাড়া নেশাজাতীয় সিরাপ স্কাপ ৫৯ বোতল ও ৩ কেজি গাজা উদ্ধার করেছে। এর আগের মাসে নভেম্বরে ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছিল ২৬৩ বোতল, ইয়াবা ৬ হাজার পিস, গাজা ১৩ কেজি।
আখাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন তরফদার বলেন, নির্বাচনের কারণে তিনি ওদিকে খেয়াল রাখতে পারছেন না। তা ছাড়া মাদক নির্মূল একেবারে সম্ভব নয়।
তার কক্ষে বসা পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু কাউসার ভূঁইয়াও গলা মেলান ওসির সঙ্গে। বলেন এখন সবাই ইলেকশন নিয়ে ব্যস্ত। মাদকের দিকে কারো নজর নেই। বাইরের অতিথিদের পদচারণায় আর প্রচারণায় আখাউড়া এখন সরগরম। আর এর কৃতিত্ব বেশির ভাগ সরকারদলীয় প্রার্থী তাকজিল খলিফা কাজলের। তার পক্ষেই যেন মেতে রয়েছে গোটা পৌর এলাকা। হোন্ডা বহর নিয়ে ছুটছে তার সমর্থকরা। যেসব গাড়ির কোনোটারই নাম্বার নেই। নেই কোনো কাগজপত্র। পেছনে নাম্বার প্লেটে লাগানো নৌকা প্রতীকের স্টিকার। সামনে একই স্টিকার। এতে আতঙ্কও ছড়াচ্ছে বেশ। প্রচারে হোন্ডা ব্যবহার করা যায় না বলেই জানান আখাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। তবে পুলিশের এই কর্মকর্তার দাবি তারা হোন্ডা বিরোধী অভিযান করছেন। নানাভাবে টাকা উড়ানোর রব উঠেছে সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অভিযোগ করেন সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প করেছেন সরকারদলীয় প্রার্থী। এইসব ক্যাম্পে প্রতিদিন হাজার-দেড় হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারে বেরুচ্ছে প্রতিদিন দু-আড়াই শ’ কর্মী। একেক কর্মীকে দেয়া হচ্ছে ৩শ’ টাকা করে।
বিএনপি প্রার্থী মো. মন্তাজ মিয়া বলেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এক কুড়ি অফিস করেছেন। প্রতিদিন ১৭০ জন লোক খাওয়াচ্ছেন। আমি নিজের পেটই চালাতে পারি না। অন্যদের খাওয়াবো কিভাবে।
আরেক মেয়র প্রার্থী মশিউর রহমান বাবুলও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন।
তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তাকজিল খলিফা কাজল টাকা উড়ানোর অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানান। তিনি বলেন, টাকা খরচের একটা লিমিট আছে। তবে আমাদের লোকবল আছে। তার পক্ষে হোন্ডা বহর দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এমনটা দেখেননি।
সংবাদ :: মানবজমিন