মানুষ মানুষের জন্য:: মানসিক ভারসাম্যহীন ‘অন্তর’ এর পরে এবার ‘আদুরী’র পাশে দাড়ালেন ব্যাংকার শামীম আহমেদ
ভারসাম্যহীন জবার স্মৃতি ও পরিবার ফিরিয়ে দিলেন ব্যাংকার শামীম
নোয়াখালীতে নিখোঁজের সাত বছর পর ভারসাম্যহীন কিশোরীকে ফিরে পেলো তার স্বজনরা। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আদরের সন্তান জবাকে কাছে পেয়ে বাবা-মা ও স্বজনরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এসময় আবেগ ঘন পরিবেশে উপস্থিত অনেকেই নিজের অজান্তে কেঁদে ফেলেন।
জবাকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যিনি তাকে সুস্থ করে তুলেছেন সেই হৃদয়বান মানুষটি হলেন শামীম আহম্মেদ। পেশায় তিনি ব্যাংকার। যমুনা ব্যাংকের সিনিয়ন এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শামীম আহমেদ তার কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে গত বছর ১৭ আগষ্ট ঢাকার পল্টন মোড়ে রাস্তার পাশে ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে কিছু টাকা ও খাবার কিনে দেন। পরদিন অফিসের সহকর্মী ব্যাংকার আলী সাব্বিরের সাথে পরামর্শ করে মেয়েটিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করার পরিবেশ তৈরি করতে পল্টন মডেল থানা সহ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। এরপর ০৭/১১/১৫ ইং তারিখে পল্টন থানা পুলিশের সহায়তায় মেয়েটিকে শেরেবাংলা নগর জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তিকালে মেয়েটির পরিচয় জানা না থাকায় শামীম আহমেদ তার নাম রাখেন ‘আদুরী’।
হাসপাতালে সার্বক্ষণিক দেখাশুনা ও সেবাকর্মের জন্য জরিনা বেগম নামক এক মহিলাকে বেতনে নিয়োজিত করেন। ডাক্তারদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সেবা শুশ্র“ষায় মেয়েটি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠার পর জরিনা বেগমের ঢাকাস্থ আদাবরের বাড়ীতে রাখা হয়। এক সময় তার মুখ থেকে কিছু শব্দ বের হলে সে কথার সুত্র ধরে শামীম আহমেদ ফেসবুকে www.facebook.com/helphandsbd এবং আদুরীর ছবি সম্বলিত পোষ্টারিং এর মাধ্যমে তার পরিবারকে খুজে বের করে। পরবর্তীতে শামীম আহমেদ ও তার বন্ধুরা মেয়েটির গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে জবার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জানতে পেরে অশ্র“সিক্ত হন তারা। মেয়েটির প্রকৃত নাম জবা। নোয়াখালী জেলার মাইজদী উপজেলার লক্ষীনারায়নপুরে তাদের বাড়ী। তার বাবা আলাউদ্দিন একজন রিক্সা চালক ও মা গৃহিনী। আজ থেকে প্রায় ০৬ ছয় বছর আগে বাড়ী থেকে সে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। অনাহার অর্ধাহার, উদভ্রান্ত পদচারনা ও মানুষের অবহেলায় মেয়েটি ক্রমান্বয়ে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে । ওদিকে জবার পরিবার অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে তার ভাগ্যকে ছেড়ে দেয় বিধাতার হাতে। ভাগ্য বিড়ম্বিত সেই জবাকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় রাস্তায় দেখে তাকে উদ্ধারপূর্বক সুচিকিৎসার মাধ্যমে ভাল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ব্যাংকার শামীম ও তার বন্ধুরা।
শনিবার ৯ এপ্রিল, ২০১৬ ,বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নোয়াখালী বিআরডিবি মিলনায়তনে যমুনা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার শামীম আহমেদ ও সহকর্মীরা আনুষ্ঠানিক ভাবে আদরীকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় নোয়াখালী পৌর মেয়র মো: হারুনুর রশিদ আজাদ, নোয়াখালী পৌর বণিক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন সোহান সহ অনুষ্ঠানে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে এসে নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র হারুনুর রশিদ আজাদ আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে এখনো ভালো মানুষ আছেন। বিশেষ করে ব্যাংকার শামীম আহম্মেদ, তার সহকর্মীরা ও পরিবারের সদস্যরা এভাবে এগিয়ে না আসলে কখনো জবাকে তার পরিবারের সদস্যা খুঁজে পেতেন না। তিনি এখন থেকে জবার ভোরণ পোষণসহ যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেন।
মানুষের বিপুল ভালবাসায় সিক্ত ঢাকাস্থ যমুনা ব্যাংক এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার শামীম আহমেদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমার মানবিক বিবেক বোধ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন এই মেয়েটিকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে আমার বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিত চেষ্টা করেছি এ কারণে যে, আমাদের কাজটি দেখে মানুষেরা যেন উদ্ধুদ্ধ ও অনুপ্রানিত হয়ে রাস্তাঘাটে কোন পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীন লোককে অনাদর-অবহেলা না করে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন করেন”।
তিনি আরো জানান, আদুরীকে (জবাকে) তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার সকল ওষুধসহ বিভিন্নভাবে আর্থিক সহযোগিতা চালিয়ে যাবেন।
উল্লেখ্য, শামীম আহমেদ গত বছর নভেম্ভর মাসে অফিসের সহকর্মীদের সাথে বান্দরবান জেলার থানচিতে ঘুরতে গিয়ে গাছের নিচে বসে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন একটি মেয়ে দেখতে পেয়ে পরবর্তীতে তার সহকর্মী বন্ধু আলী সাব্বির ও হাসান ফরহাদ আজাদের সহযোগিতায় মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে শেরেবাংলা নগর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট হাসপাতালে ‘অন্তর’ নাম রেখে ভর্তি করান। অনেকদিন পরে মেয়েটির মুখের কথা ফোটে। আর সেই কথার সুত্র ধরেই ফেসবুকে যোগাযোগের মাধ্যমে মেয়েটির ঠিকানা মিলে । মেয়েটির নাম শিউলি রানী সরকার। প্রায় ৫ বছর ধরে বাড়ী থেকে সে নিখোঁজ ছিল। শামীম আহমেদ ও তার বন্ধুদের অক্লান্ত ভালবাসায় তিন সন্তানের জননী শিউলী রানী সরকারকে সুস্থ করে তার গ্রামের বাড়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দাউরিয়া গ্রামে স্বামী ও পরিজনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। মানবিক এ ঘটনাটি নান্দনিক উপস্থাপক হানিফ সংকেত তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “ইত্যাদি” তে গত ১১/০৯/২০১৫ইং তারিখে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান শামীম আহমেদ ব্যাংকের একজন ব্যস্ততম কর্মকর্তা হয়েও মানুষ ও মানবতার প্রতি তিনি যে বিরল ভালবাসার স্বাক্ষর রেখেছেন সেটা আমাদেরকে মানবিক মহৎ কাজে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে।