আদালতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম
ইংরেজির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। শুনতে পেলেন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বাদ রাখার যে আবেদন তিনি করেছিলেন শেষ পর্যন্ত সেই আবেদনের শুনানি হবে রোববার। এটা তার কাছে একরকম বিস্ময়। এখন থেকে ২৮ বছর আগে এ আবেদন করেছিলেন তিনি। এতে যে ১৫ বন্ধু স্বাক্ষর করেছিলেন, এরই মধ্যে তার ১০ জন মারা গিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে ধর্মনিরপেক্ষ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও তার বন্ধুরা সতর্ক করেছিলেন যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হলে দেশ মৌলবাদের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু তখন দেশের সামরিক শাসক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার জন্য তৎপর ছিল। উদ্বেগ উপেক্ষা করে তারা ওই বছরই সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে সরকারিভাবে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেয়। তাই ওই আবেদনের কোন ব্যবস্থা হয় নি।
এ মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে যে, ওই আবেদনের শুনানি হবে। এমন সিদ্ধান্ত এসেছে এক মোক্ষম সময়ে, যখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে রক্ষার এবং জঙ্গিদের ধারাবাহিক হামলা বৃদ্ধিতে বেড়েছে উদ্বেগ।
পাকিস্তানের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামের ব্যবহার নিয়ে বিভক্তি রয়েছে। এখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ওই আবেদন বাংলাদেশের জনঅনুভূতির জন্য একটি পরীক্ষা। আদালতে এ নিয়ে শুনানির তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে সরকারি কর্মকর্তারা ততই নার্ভাসনেস হওয়ার কথা স্বীকার করছেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইসলামিক গ্রুপগুলো শুনানি বাতিল করার দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। এ বিক্ষোভের আয়োজক ছিল হেফাজতে ইসলাম। এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুফতি ফয়েজুল্লাহ বলেন, এই শুনানি শান্তির প্রতি আঘাত নিয়ে আসবে। এতে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আঘাত আসবে। এদেশের মুসলিমরা এর পক্ষে থাকতে পারেন না। তাদের চেতনা এমন ঘটনার পক্ষে থাকতে পারে না।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ধারণা বাংলাদেশের ইসলামপন্থি বয়স্ক নেতাদের মতো প্রত্যাখ্যান করেন মুফতি ফয়েজুল্লাহ। তিনি বলেন, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম থেকে বাদ দেয়ার যে আবেদন করা হয়েছে তা করেছেন নাস্তিকরা। তিনি আরও বলেন, মধ্যপন্থি বা উদার ইসলামের ধারণা আমি পছন্দ করি না। ইসলাম তো ইসলামই। এটা সেই পথ, যে পথ সব সময়ই ছিল। কেয়ামত পর্যন্ত তা অক্ষত থাকবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিকেল ২ (এ) তে বলা হয়েছে ইসলাম হলো রাষ্ট্রধর্ম। দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম। ৮ দশমিক ৫ ভাগ হিন্দু, ক্ষুদ্র অংশ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ জাগ্রত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানে তারা অনুচ্ছেদ ১২ পুনঃসংযোজন করেছে। তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে’র কথা বলা হয়েছে, যেটা ছিল ১৯৭২ সালে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আবেদন পুনরুজ্জীবিত করতে আদালত নির্দেশ দেন ২০১১ সালে।
একটি সময় পর্যন্ত সক্রিয় না থাকার পর দেশের ভিতরকার জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো পুনর্গঠিত হতে থাকে। এতে বাংলাদেশে সুন্নি মুসলিম কট্টরপন্থিদের নিয়ে গত বছর আতঙ্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান এমন ৬ জন লেখক ও বোদ্ধাকে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালে। নিহতদের বেশির ভাগকেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এর পরে কট্টরন্থিরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। তারা হিন্দু ধর্মীয় পুরোহিত, ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হওয়া ব্যক্তি ও শিয়া মসজিদকে টার্গেট করতে থাকে। তখন থেকেই সামাজিক মিডিয়াগুলোতে ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করতে থাকে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বাংলাদেশে এ সংগঠনের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
ফরিদপুর জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের এক কর্মী অলোক সেন বলেন, তার স্মরণকালের যেকোন সময়ের তুলনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বেশি বিপন্ন মনে করছেন নিজেদের। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে আমি সক্রিয় কর্মী। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে অনেক প্রচারণায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু কখনও আমার ওপর হামলা হয় নি। কিন্তু এখন আমি আর নিজেকে নিরাপদ বোধ করছি না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বয়স এখন ৭৯ বছর। তিনি বলেন, সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার সিদ্ধান্তের সম্পর্ক আছে। এতে সারাদেশের আবহাওয়া (পরিবেশ) পাল্টে গেছে। কেউ ইসলামের নামে কোন ঘটনা ঘটালে তাকে একরকম দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে এতে। অনেক বছর ধরে মানুষ ধর্মের নামে অনেক দূর সরে গিয়েছে। তা থেকেই গত বছরের হত্যাকা-গুলো ঘটেছে।
আদালতে শুনানির সময় যতই ঘনিয়ে আসছে এ সপ্তাহে ততই স্নায়ু দুর্বল হয়ে আসছে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রোববারের তিনি ওই আবেদনের শুনানিতে স্থাগিতাদেশ চাইবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। কারণ হিসেবে দেখাবেন যে, পরিস্থিতি অত্যন্ত কলহপ্রবণ। কট্টরপন্থি সহিংসতার উত্থান ও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেয়ার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে বলে তিনি দেখছেন না। তিনি বলেন, সব সময়ই বিশৃংখলা সৃষ্টি করার জন্য কিছু মানুষ থাকে।
(নয়া দিল্লি থেকে যৌথভাবে এ রিপোর্ট লিখেছেন ইলেন বেরি)
নিউ ইয়র্ক টাইমে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ