নাসিরনগরে হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে তান্ডবের এক বছর
তদন্তে ধীরগতি: হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায়ত্ব কেটেছে, বেড়েছে মনোবল
৩০ অক্টোবর। ফেসবুকে দেয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে গত বছর এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। হামলাকরীরা ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘরবাড়ি ভাংচুরের পর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ কারণে ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় অনেক পরিবার। এক বছর পর পাল্টেছে দৃশ্যপট। সেখানকার হিন্দুদের মতে, তাণ্ডবের পর সরকার এবং দেশের মানুষ যেভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। নিজেদের এখন আর অসহায় মনে হয় না। তবে হামলাকারীদের বিচার না হওয়ায় কিছুটা কষ্ট রয়েছে তাদের মনে। হামলার ঘটনায় নাসিরনগর থানায় ১২শ জনকে আসামি করে ৮টি মামলা দায়ের হলেও এখন পর্যন্ত একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাণ্ডবের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ভিডিও ফুটেজ ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া ঘটনার নেপথ্য বিষয় জানারও চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাণ্ডবের ঘটনায় জড়িত আরো প্রায় ২০০ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে। তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে থাকায় মামলার পুলিশ প্রতিবেদনও দ্রুত দেওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে ঘটনার এক বছরে এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। গত বছরের তুলনায় এ বছর নাসিরনগরে দুর্গাপূজা বেশি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃতদের জামিনে ছাড়া পাওয়া, প্রকৃত অপরাধীরা এখনো আড়ালে থাকা, এক বছরেও পুলিশি প্রতিবেদন আদালতে জমা না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এ ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি করেছে।
নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও মামলার বাদী অঞ্জন দেব জানান, এক বছরেও মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় আমরা বিচার নিয়ে শঙ্কিত। দিন যত বাড়ছে আমাদের মনে শঙ্কাও তত বাড়ছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি অবিলম্বে যেন হামলায় জড়িত সকল আসামিকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
নাসিরনগর থানার ওসি মো. আবু জাফর বলেন, মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। কোনো অপরাধীই যেন পার পেয়ে না যেতে পারে, বিচার থেকে না বাঁচতে পারে, সে জন্য ব্যাপক তদন্ত করতে গিয়ে প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে। শিগগিরই পর্যায়ক্রমে সাতটি মামলারই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। রসরাজের বিরুদ্ধে হওয়া আরেকটি মামলার তদন্ত করছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
রসরাজের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার দীর্ঘদিন তদন্ত করা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বর্তমানে সরাইল থানায় কর্মরত) মো. মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রসরাজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্ট করার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। পিবিআইয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য এ বিষয়ে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত চাওয়া হয়েছে।
গতকাল রবিবার পর্যন্ত সিআইডির কোনো মতামত আসেনি বলে জানিয়েছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান। এ বিষয়ে তাগাদা দিয়ে সিআইডির কাছে চিঠি লেখা হবে বলে তিনি জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, নাসিরনগরের তাণ্ডবের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তদারকি হচ্ছে। হামলার ঘটনায় আরো অন্তত ২০০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামবে পুলিশ। হামলার ঘটনায় কেউ যেন ছাড় না পায়, সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে।
তুচ্ছ ঘটনায় এতবড় হামলা কেন, তা তদন্তে পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ধর্মীয় ইস্যুকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্তে সব বিষয়ই এসেছে।’ রসরাজ দাসের মামলা থেকে মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘রসরাজ নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও এটা সত্য যে, তার খুব কাছের কেউ তার ফেসবুকে সেই পোস্টটি দিয়েছিল। কিন্তু রসরাজকে বারবার বলার পরও সে এ বিষয়ে সহায়তা করছে না। তবে একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পোস্টটির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।’ রসরাজের ভাই পলাশ দাস সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মনে করে, সে নিখোঁজ নয় বরং পলাতক।’
২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর পবিত্র কাবা শরিফকে অবমাননা করে নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। এ ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে নাসিরনগর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় রসরাজকে গ্রেফতারের পর তার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো নাসিরনগর উপজেলা। পরদিন (৩০ অক্টোবর) মাইকিং করে সমাবেশ ডাকে দুটি ইসলামী সংগঠন। সমাবেশ শেষ হওয়ার পরপরই দুষ্কৃতকারীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করে। এরপর ৪ ও ১৩ নভেম্বর ভোরে দুষ্কৃতকারীরা আবারও উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।