সরাইলে হাইওয়ে পুলিশের টোকেন ও আটক বাণিজ্য
সরাইল প্রতিনিধি ॥ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইল-আশুগঞ্জ এলাকায় এখন বেপরোয়া হাইওয়ে পুলিশের সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটক বাণিজ্য। সঙ্গে রয়েছে পিকআপ ভ্যান ও ট্রাক্টর। জেলা ট্রাফিক পুলিশের দৃষ্টিও তাদের ওপরই। অন্যদিকে লেনদেনের পর দেয়া হয় টোকেন। আর এ টোকেন নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে সিএনজি। একই জায়গায় ৩ বছর বা তার অধিক সময় চাকরির কারণেই মাসোয়ারা আদায়ে বেপরোয়া পুলিশ এমনটি বলছেন মালিক শ্রমিকরা। চালক মালিকরা জিম্মি হয়ে পড়েছে চিহ্নিত ৩ শ্রেণির দালালের কাছে। মাসিক চুক্তিতে (চালক-পুলিশের ভাষায় মানতি) শুধু সরাইলেরই শতাধিক অটোরিকশার রয়েছে মহাসড়কে চলাচলের গোপন নির্দেশনা।
মানতির টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে সেক্টর ভিত্তিক অর্ধডজনেরও অধিক লোক। অটোরিকশা ছাড়ের ফি কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। ক্ষেত্র বিশেষ ১২-১৫ হাজার টাকা। বিশেষ তদবির থাকলে ফি সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা।
পুলিশি হয়রানির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১০-১৫ জন চালক ও মালিক বলেন, আর সহ্য করতে পারছি না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে চলছে ১০-১২ বছর ধরে। বর্তমান হাইওয়ে ওসি যোগদানের পর অটোরিকশা ছাড়ের ফি অতীতের সকল রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। সিএনজি আটকের পরই কতিপয় দালাল ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। দালালিতে রয়েছে গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয়ের কয়েকজন ব্যক্তি। এরপর আস্তে আস্তে টাকার চুক্তি করে। অনেক সময় দালাল ছাড়া স্যারের সঙ্গে কথাও বলা যায় না। কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে দেশের ৬০ থানায় ওসির বন্ধুদের সহায়তায় মামলা দেয়ার হুমকির বিষয়টিও চাউর হচ্ছে সর্বত্র। প্রতিদিনই চালক-মালিকদের পকেটের লক্ষাধিক টাকা যাচ্ছে দালাল ও পুলিশের পকেটে। নতুন করে আটক ছাড়ের বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ১৫-২০ দিন অনেক সময় মাসাধিক সময় ঘুরেও সর্বস্ব খুইয়ে ক্রয় করা রিকশা ছাড়াতে পারছেন না অনেক গরিব চালক। ওদিকে সুদে আসলে কিস্তির ঘানিও টানতে হচ্ছে তাদের। কোনো কারণে হিসাব না মিললেই মামলা। জেলা শহরে গেলেও ধরে টি আই অফিসের পুলিশ। চালকদের ভাষায় ইকবাল পারভেজ নামের এক স্যারের ব্যবহার ও যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ।
সরাইলের ইসলামাবাদ গ্রামের জাকির অটোরিকশা ও আশুগঞ্জ এলাকার খোরশেদ পিকআপ ভ্যানের মানতির টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছেন। সরজমিনে চালক-মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরাইল বিশ্বরোড হাইওয়ে থানা পুলিশ এখন বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠছে মহাসড়কে। বিধি না থাকলেও মহাসড়কের বিশ্বরোড মোড়ের চারিদিকে সড়কের ওপরেই রয়েছে অটোরিকশার একাধিক স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ড থেকে মাসিক মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা যাচ্ছে কিছু নাম সর্বস্ব শ্রমিক নেতা ও পুলিশের পকেটে। বিশ্বরোড মোড় থেকে আশুগঞ্জ ও শাহবাজপুর এলাকার রামপুর ব্রিজ পর্যন্ত দিনে রাতে তাদের টার্গেট সিএনজিচালিত অটো ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। বিশেষ কারণে অনুমতি থাকার পরও জেলা শহরের কাউতলি পর্যন্ত শান্তি নেই চালকদের। হিসাব না মিললেই মামলা। আর মামলাগুলো হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সামাল দেয়ার একটা অস্ত্র। আটকের পরই দর কষাকষিতে নেমে পড়েন পুলিশের কিছু দালাল। স্থানীয় চালকরা সম্প্রতি ২ জন দালাল যারা কথিত গণমাধ্যম কর্মী পরিচয়দানকারী তাদের দিয়েছে গণধোলাই। আরো রয়েছে স্থানীয় কিছু পেশাদার ও লেবাসধারী আরেক শ্রেণির দালাল। এদেরকে দিয়েই এখন অটোরিকশা আটক বাণিজ্য করছেন জেলা টি আই ও বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ। তারা প্রথমে চালক বা মালিকের সঙ্গে ছাড়ের মূল্য নির্ধারণে কাজ শুরু করেন। নিজের কমিশনসহ হিসাব মিললে গাড়ি ছাড়ের ব্যবস্থা করেন। হিসাব না মিললেই ঘুরাতে থাকেন। থানায় সপ্তাহ, মাস আবার মাসাধিককালও আটক থাকে অটোরিকশা। সরাইলসহ আশেপাশের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের লোকজনের সঙ্গে রয়েছে দালাল ও পুলিশের গোপন মাসিক চুক্তি। ৫ থেকে ১৫-২০টি গাড়ির টাকা মাসে একবার জমা দেয় দালাল অথবা পুলিশের চিহ্নিত লোকের কাছে। এটাকে চালক ও পুলিশের ভাষায় বলা হয় মানতি। মানতি আজ থেকে বছরখানেক আগে ছিল ৩০০ টাকা করে। সম্প্রতি মানতির রেইট ৫-৬শ’ টাকা।
নম্বরবিহীন রিকশার রেইট আরো বেশি। কিছু এলাকায় থেকে মানতি গাড়ি প্রতি ৩ হাজার টাকা আদায়ের ঘটনাও আছে। শাহজাদাপুর ইউনিয়নের জনৈক চালকের কাছ থেকে প্রতি গাড়ি ৫ হাজার টাকা রেইটে ৯টি সিএনজির মানতি (মাসিক) করে টাকা গ্রহণের পর আবার ফেরত দেয়ার ঘটনাও রয়েছে। গত ২৩শে ডিসেম্বর দুপুরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষে গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয়ের দালালদের যন্ত্রণার কথা প্রসঙ্গে ওসি মাইনুল ইসলাম বলেন, এদের যন্ত্রণায় আমার কলিজাটা শেষ। আমি আর পারছি না। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। গত ২০শে ডিসেম্বর বেলা ১২টার দিকে মহাসড়কে একটি অটোরিকশাকে তাড়া করে হাইওয়ে পুলিশ। দ্রুতগতিতে পালানোর চেষ্টাকালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শান্তিনগর ও বেড়তলার মধ্যবর্তী স্থানে সিএনজিটি উল্টে এক যাত্রী গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয় শতাধিক লোক মহাসড়ক বন্ধ করে দেয়। লাঠিসোটা নিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় জনতা।
স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। এখানে নিবন্ধনবিহীন অটোরিকশার সংখ্যা অনেক। তবে আটকের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। জনৈক শ্রমিক নেতা জানান, বিশ্বরোড থানার মাসিক মাসোয়ারা এখন গড়ে ২০ লক্ষাধিক টাকা। গাড়ি আটক। তাই চালকের ঋণের কিস্তিও আটক। সম্প্রতি সরাইলের কালিকচ্ছ এলাকার এমরানের অটোরিকশাটি আটক করে বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ। ২-৩ দিন পরই ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় এমরানের স্ত্রী আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। সরাইল সদরের ইমন নামের এক চালকের অটোরিকশা আটক করে ছাড়ের আবেদন নেন। ১৫ দিন পরও কোনো সুরাহা নেই। গরিব ওই চালকের দৈনিক আয় বন্ধ। তার ওপর আবার কিস্তির চাপ। অবস্থা নিরুপায় দেখে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর নিজে যান হাইওয়ে থানায়। কোনো রকমে মুক্তি পায় রিকশাটি। কিন্তু তখনও পুলিশের কব্জায় ছিল আরো ৫-৬টি রিকশা। কালিকচ্ছ এলাকার ‘মাসুম পরিবহন’ নামের একটি সিএনজি আটকের ১০ দিনপর গত বুধবার ৮ হাজার ৫০০ টাকায় পুলিশের কব্জা থেকে জামিন পায়। এর আগে শাহবাজপুরের মুমিনের আরেকটি সিএনজি দুই সপ্তাহের ও অধিক সময় পর জামিন মিলে ৬ হাজার টাকায়।
শাহজাদাপুর এলাকার জনৈক চালকের সঙ্গে ওসির পরিচয়ে হাইওয়ে থানার কামাল ৬টি সিএনজির মানতি বাবদ ১৮ হাজার টাকা নেন। পরের মাসে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ান। হাইওয়ে থানায় ভান্ডারি পরিচয়ের এক লোক একই লোকের ৯টি সিএনজি মহাসড়কে চলাচলের জন্য মাসিক ৪৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। শর্তের গরমিলে কিছুদিন পর ওই টাকা ফেরত দেন। এর কিছুদিন পরই দেওড়া গ্রামের দুটি গাড়ি আটক করে পুলিশ। ৬ দিন পর একটি গাড়ি ১০ হাজার টাকায় ছাড়িয়ে আনলেও আরেকটি এখনো আটক। কাঠ ব্যবসায়ী মইন্দ গ্রামের শাহজাহান মিয়া ও বাড়িউড়া গ্রামের রিপন মিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকা থেকে আমরা কাঠ এনে থাকি। সারা দেশের কোথাও আমাদের সমস্যা হয় না। অথচ বাড়ির কাছে বিশ্বরোড মোড়ে পুলিশকে গাড়ি প্রতি ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর হয়রানি যে কি পরিমাণ বলে বোঝানো যাবে না। সরাইল উপজেলা যুবলীগ নেতা মো. জাকির খান জানান, এখন বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশের থাবা থেকে রেহায় পাচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত পুষ্টি মিশ্রিত চাল বহনকারী ট্রাক্টরও। ১৫-২০ দিন আগে সরকারি ব্যানার সম্বলিত ওই ট্রাক্টর আটকিয়ে পুলিশ ৪ হাজার টাকা দাবি করে বসে। আর অটোরিকশা আটক করে মাত্রাতিরিক্ত মাসোয়ারা আদায়ের বিষয়টি এখন সর্বত্রই আলোচিত।
বিশ্বরোড হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাঈনুল ইসলাম মুঠোফোনে সকল অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটা কোনো ভাবেই অবমাননা করা যাবে না। তবে সরাইল-নাসিরনগর থেকে জেলা শহরে প্রবেশের বিষয়টি মানবিক কারণে ছাড় দেয়া হচ্ছে। সিএনজির জন্য মানতি (মাসিক) বা আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছাড়ের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। এমন সব ঘটনা পুলিশের নাম ভাঙিয়ে কেউ করলে তাদের নাম দিয়ে সহযোগিতা করুন। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবো। আমি অবৈধ সিএনজি ও আইন লঙ্ঘনের কারণে নিয়মিত ধরে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।