নারী কবিরাজের কান্ড ! এক যুবককে রোগী বার বার ঘুষি দিচ্ছে। দিচ্ছে লাথিও…
মোহাম্মদ মাসুদ :: কবিরাজের নাম শাহেদা খাতুন। বয়স ২০ বছর। মৌলভী বাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামে তার বাড়ি। হিন্দুদের কির্তন থেকেই তার কবিরাজি জ্ঞানের সূত্রপাত। বাহিরে সাটানো বড় প্যান্ডেল। চারিদিকে বাঁশের বেরিকেট। রোগীকে বলা হচ্ছে ঘুষি দিতে। এক যুবককে রোগী বার বার ঘুষি দিচ্ছে। দিচ্ছে লাথিও। একে অপরকে ধরে মাটিতে পড়ে লুটুপুটি খাচ্ছে। সেখানেও চলছে মারধর। কবিরাজ হাঁটছেন আর দেখছেন। মাঝে মধ্যে কি যেন ইশারা করছেন। চারিদিকে কয়েক’শ উৎসুক নারী পুরুষ ও শিশু এ দৃশ্য দেখছে। কবিরাজের আশ্বাস ৭ দিন পর রোগী ভাল হয়ে যাবে। তাদের ফি লক্ষাধিক টাকা। ঔষধপত্র বিহীন এ কেমন চিকিৎসা! ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামের দলিল লিখক আবুল হোসেনের বাড়িতে গত শনিবার থেকে চলছে এ চিকিৎসা। বৃহস্পতিবার রাতে শেষ হওয়ার কথা। গত বুধবার ভ্রাম্যমান আদালতে শাহেদা ও তার সহযোগীকে কারাদন্ড দিয়েছে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট। সরজমিনে গত ২দিন গিয়ে রোগীর পরিবার ও কবিরাজের সাথে কথা বলে জানা যায়, আবুল হোসেনের ২ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলে মাসুম (৩৫) প্রবাসে থাকেন। মেয়ে আকলিমা (৩২) তিন সন্তানের জননী ১০ বছর ধরে রাগ প্রতিবন্ধি। ছোট ছেলে জরিপ হোসেনের (১৮) একই সমস্যা। দেশের অনেক বড় চিকিৎসকও তাদের ভাল করতে পারেনি। অনেক ঘুরেফিরে তারা খাঁটিহাতা গ্রামের বিল্লাল মিয়ার (৪০) মাধ্যমে অবিবাহিত কবিরাজ শাহেদার সন্ধান পান। শাহেদা মৌলভী বাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের কুতুব আলীর বড় মেয়ে। সম্প্রতি আকলিমা ও জরিপকে তার আধ্যাত্বিক চিকিৎসায় ভাল করে দিবে। আর কবিরাজ তার দলের ৭ সদস্য নিয়ে রোগীর বাড়িতে থাকবে খাবে। দিনে রাতে বাজবে ঢোল ও বাঁশি। চলবে নাচ ও মৃদু গান। পাঁচ দিনে ভাল না হলে চলবে ৭দিন। এমন শর্তে শাহেদা বিল্লালের মাধ্যমে লক্ষাধিক টাকার চুক্তি করেন আবুল হোসেনের সাথে। কবিরাজের পরামর্শে আবুল হোসেন তার বসত ঘরের সামনে ত্রিপাল সাটিয়ে তৈরী করেন বড় প্যান্ডেল। চারিদিকে শক্ত করে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেন। বেড়ার বাহিরে সাজানো রয়েছে প্লাষ্টিকের চেয়ার। গত শনিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়েছে চিকিৎসা। উদ্ভুদ এ চিকিৎসার উপকরন হল কাঠের তৈরী একটি জল চৌকি। তার উপর সারাদিন রাত জ্বলছে ৭-৮টি মোমবাতি। পাশে পড়ে রয়েছে কিছু টাকা ও টিনের কৌঠার ভিতর চাউল। অনেক কষ্টে আবুল হোসেন সংগ্রহ করেছেন শাপলা, পদ্ম ও গোলাপ ফুল। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অগণিত নিম গাছের ডাল। থেমে চলছে বাদ্যযন্ত্র, নাচ ও গান। প্যান্ডেলের ভিতরে ঘুরে লাফাচ্ছে আর ঘুষি লাথি দিচ্ছে রোগী জরিপ। মাঝে মধ্যে ২-৩জন একসাথে মাটিতে পড়ে লুটুপুটি খাচ্ছে। আজানের আগে ও খাবারের সময় বিরতিতে যাচ্ছেন। এ ভাবে গত শনিবার থেকে আবুল হোসেনের বাড়িতে চলছে চিকিৎসা। তবে বার্ষিক পরীক্ষা নিকটে হওয়ায় আশপাশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে। বাদ্যযন্ত্রের শব্দে তারা পড়ায় মনোযোগী হতে পারছে না। জগড়াঝাটির ভয়ে কোন প্রতিবেশী মুখও খুলছেন না। গৃহকর্তা আবুল হোসেন বলেন, এ কবিরাজ এমন অনেক রোগী ভাল করেছে। খাঁটিহাতার বিল্লালের মাধ্যমে কবিরাজের সন্ধান পেয়েছি। তাদেরকে মোট ১ লাখ টাকা দিতে হবে। আর ৭দিনের খাবার ডেকোরেশন সহ আরো ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে। তারপরও আমার সন্তান দুটো ভাল হউক। গত ৪ দিনে আগের চেয়ে অনেক ভাল। কবিরাজ শাহেদা খাতুন বলেন, আমি বিল্লাল মিয়ার বাড়িতেই থাকি। রোগীর ধরন ও পরিশ্রম বুঝে ফি নির্ধারন করে থাকি। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস করে এমন চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করলেন কিভাবে? এমন প্রশ্নেরে উত্তরে শাহেদা বাবা ছাড়া তার মায়ের সাথে মামার বাড়িতে কষ্টের বেড়ে উঠার বিশদ বিবরন দেন। তিনি বলেন, পড়ার সময় বুঝতে পেরেছি মুসলমান মেয়েদের চেয়ে হিন্দু মেয়েরা অনেক ভাল। হিন্দুদের সাথেই চলতাম। তাদের পুঁজায় দাওয়াত পেলে যেতাম। পুঁজার কর্মকান্ড গুলো মনযোগ দিয়ে দেখতাম। খুবই ভাল লাগত। আমিও অসুস্থ্য হয়েছিলাম। অনেক বড় বড় কবিরাজ চিকিৎসা করে সুস্থ্য করেছেন। তখন সকলেই বলেছে আমার মধ্যে তাত্বিক অনেক কিছু আছে। বিষয়টি গ্রাম থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আমার ডাক আসতে থাকে। আমি এখন বড় কবিরাজ। ওদিকে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে মৈন্দ গ্রামের ওই আসরে অভিযান চালিয়ে সদর মডেল থানার পুলিশ কবিরাজ শাহেদা খাতুন, গৃহকর্তার বড় ছেলে মাসুম ও বাঁশি বাদক সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামের নুরু মিয়ার ছেলে ফরিদ মিয়াকে আটক করেছে। পরে গতকাল দুপুরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ড. আশরাফুল আলম কবিরাজ শাহেদা খাতুনকে ১০ দিনের কারাদন্ড দিয়ে জেলহাজতে প্রেরন করেন।