ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বাংলাদেশে পাকিস্তানি ছিটমহল!
এ মতামতটি অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কিত হওয়ায় পাঠকদের জন্য হুবুহু দেয়া হল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বাংলাদেশের কয়েকটা এলাকাকে মনে হয় ‘পাকিস্তানের ছিটমহল’। কথায় কথায় অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, গায়ের জোর দেখায়। মানবতার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই-এইসব জনপদে। মনে হয় না এখানে মানুষ বাস করে। অন্তত মানুষের আচরণ এইসব জনপদে দেখা যায় না।
গাইবান্ধার সুন্দলপুরের কথা মানে আছে? এখানে ঘুমন্ত পুলিশকে ‘জবেহ্’ করে দিয়েছে মানুষ নামের দুর্বৃত্তরা। এসব মানুষ ধর্মের নামে তঞ্চকতার আশ্রয় নেয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাঁদের গায়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মুখ দেখায়। আর প্রচার করে চাঁদের গায়ে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে সাঈদীর বুজুর্গী ফলাতে আর উত্তেজনা বাড়াতে এসব চক্রান্ত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বশেষ খবরতো সবার জানা। ফেসবুক ব্যবহার করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে আর সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়িতে আগুন দিয়েছে। নির্বিচারে তাদেরকে মারধর করেছে। একজন সংখ্যালঘু তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কাবা শরিফের অবমাননা করেছেন এমন একটি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত যুবককে ধরে পুলিশেও দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ঘটনা থেমে থাকে না, কারণ ঘটনার উদ্দেশ্য ভিন্ন। ধর্ম এখানে উছিলা মাত্র।
এইসব জায়গার ঘটনায় কোন রাজনৈতিক দল জড়িত–এই অনুসন্ধানের কোনও দরকার পড়ে না। কারণ, এসব এলাকার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির কর্মীরা প্রায় একই চরিত্রের।
বছরের শুরুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এক মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে কতবড় কেলেঙ্কারি সৃষ্টির আয়োজন করেছিল ওই জনপদের দুর্বৃত্তরা, মনে আছে? শহরের জেলা পরিষদ মার্কেটের মোবাইল দোকানের সামনে তুচ্ছ ঘটনায় এক মাদ্রাসার ছাত্রকে মারধর করা হয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্ররা পাল্টা আক্রমণ করে। তা থেকে শুরু হয় তাণ্ডব এবং এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা। বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসার ছাত্র-জনতা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রেলস্টেশন, হাসপাতাল, ব্যাংক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ ও র্যাবের গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ঘটনার প্রতিবাদে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে। পুলিশের ২ কর্মকর্তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রত্যাহার করা হয়। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের পূর্বাঞ্চলের সব ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মাদ্রাসা ছাত্রদের অগ্নিসংযোগে বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’ সহ তার ব্যবহৃত যত বিরল সংগ্রহ ছিল, সবই ভস্মীভূত হয়ে যায়। সঙ্গীতাঙ্গনের সম্পাদক কবি আব্দুল মান্নান সরকার মিডিয়াকে জানান, ১২ জানুয়ারি ২০১৬, হামলাকারীরা মিউজিয়ামে রক্ষিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ব্যবহৃত সরোদ, বেহালা, সন্তুর, এস্রাজ, সৌদি আরবের বাদশাহ’র দেওয়া জায়নামাজ, ভারতের মাইহার রাজ্যের রাজা দেওয়া গালিচাসহ সব পুড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন সময় আত্মীয় ও শিষ্যদের কাছে সুরসম্রাটের নিজ হাতে লেখা অগণিত চিঠি, ছবি ও বড় পোর্ট্রেট পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা।
১৯৮৯ সালের আরেক ঘটনাতো এখনও ভুলতে পারি না। সরেজমিন রিপোর্ট করেছিলাম ব্রাক্ষবাড়িয়ার নিদারাবাদের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার (বর্তমান বিজয়নগর উপজেলা) নিদারাবাদ গ্রাম। সে গ্রামের শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী ও পাঁচ অবুঝ সন্তানের লাশ মিলেছিল বিলে। শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালা (৪৫), মেয়ে নিয়তি বালা (১৭), প্রণতি বালা (১০), ছেলে সুভাস দেবনাথ (১৪), সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন (৫) ও দুই বছরের সুজন দেবনাথ। এ ছয় লাশ উদ্ধারের দু’ বছর আগে অপহৃত হয়েছিলেন শশাঙ্ক। তার আর খোঁজ মিলেনি। শশাঙ্কের এক মেয়ে সুনীতি শ্বশুরবাড়ি থাকায় তিনি বেঁচে যান প্রাণে। শশাঙ্কের সম্পত্তির ওপর লোভ ছিল পাশের গ্রামের কসাই তাজুল ইসলামের। এ কারণেই প্রথমে অপহরণ করে শশাঙ্ককে হত্যা করে সে। দুই বছর পর তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জনকে হত্যা করে ড্রামে চুন মিশিয়ে তাতে লাশ ভরে বিলে ফেলে দেয়। সে সময় দুই বছরের শিশুকেও হত্যা করতে হাত কাঁপেনি খুনিদের।
বিরজা বালার মামলার আসামিদের ফাঁসি হয়েছে। আইনের সার্বভৌমত্ব থাকলে সন্ত্রাসীরা কখনও রেহাই পায় না। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে এ সব কাণ্ডকারখানা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় নাসিরনগরের সংখ্যালঘুদের ঘরে ঘরে গিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে আসি।
বাংলাদেশের হিন্দু বলুন মুসলমান বলুন- সবার বুদ্ধি, বিশ্বাস, আচরণ, ইহকাল, পরকাল সমস্ত জুড়েই ধর্ম। ধর্মকে কারও জীবন থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ধর্মপরায়ণ মানুষ কখনও খারাপ হন না। তারা সাধারণত সহজ সরল হন। কিন্তু মুশকিল হলো রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরকে নিয়ে। ধর্মের নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এই রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই সহজ সরল মানুষগুলোকে বিপদে পরিচালিত করে সমাজে ক্ষতের সৃষ্টি করে।
দুর্ভাগ্য যে ভারতে ও বাংলাদেশে একটা ধারণা রাজনৈতিক মহলে প্রচলিত আছে যে ভারতে মুসলমানেরা কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক আর বাংলাদেশে হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। সুতরাং ভারতে কংগ্রেস ভিন্ন বিজেপি মুসলমানকে আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ভিন্ন বিএনপি/জামায়াত ও অন্য সাম্প্রদায়িক দলগুলো হিন্দুদেরকে তাদের পথের কাঁটা মনে করে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত চার দলীয় জোট নির্বাচনে জিতে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কর্মী এবং হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার চালায় তা ঐতিহাসিক। হিন্দু মহল্লায় ধর্ষণও করে বিএনপি জামায়াত চারদলীয় জোটের গুন্ডারা।
ভোলায় এক হিন্দু মহিলা বলেছিল আমার মেয়ের বয়স কম তোমাদের এত লোকের অত্যাচার বরদাস্ত করতে পারবে না। এ বিষয়টা ২০০১ সালে মিডিয়ায় বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তাদের অফিসে অস্থায়ী ক্যাম্প খুলেছিল অত্যাচারিত হয়ে আসা তাদের কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য। পরবর্তী সরকার এ বিষয়টা তদন্তের জন্য ‘সাহাবুদ্দীন কমিশন’ গঠন করেছিলেন।
সাহাবুদ্দীন কমিশন তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যে সহিংসতা হয়েছিল তা ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র। কমিশন তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন প্রায় ১৮ হাজার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল তখন সারা দেশে, সুতরাং সহিংসতার ব্যাপকতা কত বিস্তৃত ছিল ভেবে দেখুন।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর পর যে দুর্গাপূজা হয়েছিল সে পূজায় টেকনাফ থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত রাত্র ৮ টার সময় একই সঙ্গে একই সময়ে পূজামণ্ডপ আক্রান্ত হয়েছিল এবং সারাদেশে মণ্ডপ বিধ্বস্ত করে পূজা বানচাল করে দিয়েছিল। সেটা ছিল পাকিস্তানপন্থীদের গভীর ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ফলাফল ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, আর ২০০১ সালের ২১ আগস্ট-এর ঘটনা। দুর্ভাগ্য যে তারা এখনও নির্মূল হয়নি। নাসিরনগরের ঘটনা ওই সব ঘটনার ধারাবাহিকতা।
আওয়ামী লীগ গত ৮ বছর ধরে টানা ক্ষমতায়। এখন এত দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা তাদের ধৈর্য্য সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং নানাভাবে এখন তারা ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেছে আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। যারা সরেজমিন দেখে এসেছেন তারা বলছেন, কারা নাসিরনগরে এসে হামলা করেছে, সেটা স্থানীয়রা বলতে পারে না। তারা হামলাকারীদের চেনে না। সে কারণে বলা যায় নাসিরনগরের সংখ্যালঘু উৎপীড়নের মধ্যদিয়ে হয়ত সে ষড়যন্ত্র আরম্ভ হলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল। সংখ্যালঘুও তাড়ালাম, আওয়ামী লীগকেও বিব্রত করলাম।
কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই এমপির ক্ষমতার বলিও হতে পারেন এই সংখ্যালঘুরা। দায়ী যে হোক- বিচার যেন থেমে না থাকে। নাসিরনগরে যে ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি হয়েছে, হচ্ছে- তার বিচার হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক। মন্দির ভাঙা, মূর্তি ভাঙা, ঘরে আগুন দেওয়া আর লুটপাটকে এইদেশে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ বলে চালানো বন্ধ হোক নাসিরনগর থেকেই।
একটা ছোট গল্প বলে আমার লেখা শেষ করব। গল্পটা সহজ সরল ধর্মপরায়ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য বলা। ১৯১০ সাল পর্যন্ত বাংলায় কোনও কোরান শরীফ তরজমা কেউ করেননি। একটা তরজমার অভাব মুসলমান সমাজ ব্যাপকভাবে অনুভব করতেন। হিন্দুরাও কোরআনে কী লিখা আছে তা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু কী হিন্দু কী মুসলমান তরজমার অভাবে তা পড়তে পারেননি কখনও। তখন নারায়ণগঞ্জের গিরিশ চন্দ্র ১৯০৫ সালে লখনৌ গিয়ে চল্লিশোর্ধ বয়সে মুসলমানের হাতে আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা শিখে এসে কোরআনের বাংলা তরজমা করেছিলেন। তিনি ঈমাম গজ্জালীর কিমিয়ায়ে সা’দত ও ইয়াহিয়া উলুমুদ্দীনেরও বাংলা তরজমা করেছিলেন। বহুদিন কোরআনের এ তরজমা কোরআন পিপাসু মুসলমানের ঘরে ঘরে পাঠ হত। ইমাম গাজ্জালীর গ্রন্থ দুটাতো হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। মুসলমানেরা তাকে ‘ভাই’ উপাধি দিয়েছিল।
এখনও বাংলা সাহিত্যে তাকে ‘ভাই গিরিশ চন্দ্র’ বলে ডাকা হয়। মওলানা আকরাম খাঁন ভাই গিরিশ চন্দ্রের তরজমা করা কোরআনের চতুর্থ-সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁ লিখেছেন- ‘গিরিশ চন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’ পরবর্তী সময়ে ভাই গিরিশ চন্দ্রই বাংলায় হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রথম জীবনী রচনা করেন (১৯১০ সাল)।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আমার আবেদন টাউট-বাটপারের পাল্লায় না পড়ে চলুন আমরা ভাই গিরিশ চন্দ্রের সম্প্রীতির যুগে ফিরে যাই। পরস্পর পরস্পরকে সর্ববিষয়ে সহায়তা প্রদান করি আর সম্প্রীতিতে উভয় সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করি। মানুষকে তার ধর্ম দিয়ে নয়, প্রথমে মানুষ হিসেবে দেখি।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
anisalamgir@gmail.com সূত্র:: ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বাংলাদেশে পাকিস্তানি ছিটমহল!