জব্বারের বলীখেলার ১০৩ তম আসরে চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি বলী
কোথায় যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করছিল গতকাল জব্বারের বলী খেলার ১০৩ তম আসরে। গত বেশ কয় বছর ধরে যারা জব্বারের বলী খেলার নিয়মিত অতিথি ছিলেন সে দিদার-মর্মসিং কিংবা গতবারের চ্যাম্পিয়ন আলম বলী কারো দেখা নেই। চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রাচীনতম এই বলী খেলায় চট্টগ্রামের নামকরা সব বলীদের কেউ না থাকাতে একটা শূন্যতা তো থাকবেই। আর সে শূন্যতা পূরণ করার মত চট্টগ্রামের কাউকেই পাওয়া গেলনা। তাই স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম জব্বারের বলী খেলার শিরোপাটা গেল চট্টগ্রামের বাইরের কোন বলীর মাথায়। লালদীঘি মাঠে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১০৩ তম আসরে চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি বলী। রানার আপ হয়েছেন রাউজানের ইকবাল বলী। চ্যাম্পিয়ন বাউটে তাকে খুব বেশী ঘাম ঝরাতে পারেনি রাউজানের ইকবাল। মাত্র তিন মিনিটেই কুপোকাত ইকবাল। ফলে জব্বারের বলী খেলার সিংহাসনে নতুন রাজা হিসেবে নাম লেখালেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি হোসেন। আর রানার আপ হয়েছেন রাউজানের ইকবাল। চ্যাম্পিয়ান ও রানার্স আপ হওয়া দুইজনই অপেশাদার বলী, পেশায় দুইজনই ব্যবসায়ী। বরাবরের মত এবারো জব্বারের এই বলী খেলাকে কেন্দ্র করে উৎসাহ, উদ্দীপনার কমতি ছিলনা। বরাবরের মতই সারাদেশ থেকে এবারো এসেছেন বলীরা। লক্ষ্য একটাই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা। এবারের আসরে নাম লেখান ১১৬ জন বলী। তবে শেষ পর্যন্ত বলী খেলায় অংশগ্রহণ করেন ৭৮ জন। এর মধ্যে প্রথম রাউন্ডের খেলায় অংশগ্রহণ করেন ৭৪ জন, চ্যালেঞ্জ পর্বে (সেমি ফাইনাল) অংশ নেন চারজন। চ্যাম্পিয়ন পর্বে অংশ নেন দুইজন। প্রথম রাউন্ডের বিজয়ীদের ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। বিকাল চারটায় শুরু হয় প্রথম রাউন্ডের খেলা। ৪টা ১২ মিনিটে বালি দিয়ে তৈরি করা মঞ্চে খালি গায়ে মাঝ বয়সী দুই জন ও পঞ্চাশোর্ধ দুই জন বলী আসেন। তিন মিনিটের মাথায় বাকলিয়ার শরীফুল ইসলাম হারান তার প্রতিদ্বন্দ্বিকে। তার পরই নিজের শক্তি দিয়ে জয়ী হন বয়োবৃদ্ধ হাটহাজারীর মফিজ বলী। এরপর বালির মঞ্চে উঠে আরেকদল। রাউজানের আজিজ বলী হারায় তার প্রতিদ্বন্দ্বিকে। এভাবে দুই জন করে চলতে থাকে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন বলী খেলা। প্রায় একঘণ্টা প্রথম রাউন্ডের প্রতিযোগিতা চলার পর শুরু হয় প্রতীক্ষিত, প্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ পর্ব। চারটা ৫০ মিনিটে শুরু হয় এ পর্বটি। মঞ্চে প্রথমে উঠেন রাউজানের ইকবাল বলী ও মিরসরাইয়ের লিয়াকত বলী। সেটি ছিল প্রথম সেমিফাইনাল। সুঠাম দেহের অধিকারি ইকবাল ও লিয়াকতের মধ্যে চলে পরস্পরকে পরাজিত করার নানা কসরত। প্রায় তিন মিনিটের এই চমৎকার পর্বে অবশেষে ইকবাল লিয়াকতকে হারিয়ে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন পর্বের জন্য নিশ্চিত করেন। এরপর আসেন চ্যালেঞ্জ পর্বের দ্বিতীয় বলীর দুই প্রতিযোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি বলী ও কুমিল্লার জসিম বলী। জসিম গত আসরের রানার্স আপ। চার মিনিট স্থায়ী লড়াইয়ে অলি- জসিমকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন পর্বের জন্য নিজের অবস্থান নিশ্চিত করলেন। এরপর শুরু হয় চ্যাম্পিয়ন পর্বের রুদ্ধশ্বাস খেলা। চ্যাম্পিয়ন পর্বে বলী ধরবেন দুইজন- অলি বলী এবং ইকবাল বলী। খালি গায়ে চ্যাম্পিয়ন দলের দুই বলী উঠলেন খেলার মঞ্চে। মাঠ ভর্তি দর্শক, মঞ্চে বসা অতিথিবৃন্দ, মাঠের পূর্বের সিএমপির কার্যালয়ের পাদদেশে, জেলা পরিষদ মার্কেট, মহল মার্কেট, মাঠের গেট, বিল বোর্ডের উপরে থাকা এবং আশপাশের উৎসুক দর্শকের চোখ কেবল মাঠের দিকে। সবার জিজ্ঞাসু চোখ বলছে- কে হচ্ছেন চ্যাম্পিয়ন, কার হাতে যাচ্ছে শিরোপা। প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছেই না। অবশেষে চারটা ৫৭ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে শুরু হয় চ্যাম্পিয়ন পর্বের বলী খেলা। দুই জনই মঞ্চে উঠে নিজে বিজয়ী হওয়ার কথা ব্যক্ত করলেন। নিজেদের শক্তির সর্বোচ্চ ব্যয় করে চেষ্টা করলেন দুই জনই। পরে মাত্র তিন মিনিট ৪০ সেকেন্ডের মাথায় অলি বলী ইকবালের পিঠকে লেপটে দেন বালির ওপর। মুহূর্তেই চারপাশে মুহুমুর্হু তালি, দর্শকদের হৈ চৈ। বাধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস সবার মাঝে, আনন্দে উদ্বেলিত হন নতুন চ্যাম্পিয়ন। নিজের হাত দুটি আকাশের দিকে উচিয়ে নিজের শক্তি মত্তার কথা জানান দেন মেলার অগনিত দর্শকদের। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা মঞ্চ থেকে আসে অলির বিজয়ের কথা। জব্বারের ঐতিহাসিক বলী খেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ খেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপির) কমিশনার আবুল কাশেম, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ, রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, আবদুল জব্বার স্মৃতি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখি মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারি, সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদল, কাউন্সিলর আঞ্জুমান আরা বেগম, পরিচালনা সম্পাদক স্বপন মহাজন, বাংলা লিংকের রিজিওনাল হেড ফরহাদ হোসেন। প্রধান অতিথি বলেন, জব্বারের বলী খেলার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের কাছে চট্টগ্রামের বিশেষ বিশেষ ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরা যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও সংস্কৃতিকেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। সারা পৃথিবীর নানা ধরনের মানুষের, বিভিন্ন সংস্কৃতি লালন করা মানুষদের কাছে আমাদের স্বকীয়-স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অবস্থান তুলে ধরা হচ্ছে এই বলী খেলার মাধ্যমে। তাই এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের, গৌরবের অনুষ্ঠান। আমরা চাই ভবিষ্যতে এটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। এবারের বলী খেলা পরিচালনায় ছিলেন কাউন্সিলর এম এ মালেক। তাকে সহযোগিতা করেন নুরুল ইসলাম টুকু, নুর মোহাম্মদ লেদু ও জাহাঙ্গীর আলম। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিবৃন্দ চ্যাম্পিয়ন অলির হাতে বাংলালিংকের সৌজন্যে ১৫ হাজার টাকার চেক ও আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে একটি বর্ণিল ট্রফি তুলে দেন। রানার্স আপ ইকবালের হাতে তুলে দেয়া হয় দশ হাজার টাকার চেক ও একটি ক্রেস্ট। |
« ছাত্র ছাত্রীদের অমনোযোগিতার কারন শিক্ষককেই তাঁর নিজের মধ্যে খুঁজে নিতে হবে—বিভাগীয় কমিশনার (পূর্বের সংবাদ)
(পরের সংবাদ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির বিক্ষোভ »