Main Menu

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- ব্রাহ্মনবাড়িয়াঃ এক স্বপ্নের জন্ম এবং চেতনায় একাত্তর

+100%-

Brahmanbaria District Map১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।

কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইয়্যা একটা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পিঁয়াজী সাবে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচী-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম্ তারাবি হইয়া গেল।

এহলো ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের কন্ঠে চরমপত্রের অংশবিশেষ। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল মুক্তিযোদ্ধাদের এবং যুদ্ধের খবর-বিখ্যাত সব গান প্রচার করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিকামী বাঙ্গালী জাতির মনে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছিলো কলকাতায়, উইকি থেকেঃ

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও বেতারকেন্দ্রের কর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার (৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ) প্রদান করে। এসময় সকল বেতারকর্মীদের ধীরে ধীরে মুজিবনগরে নিয়ে আসা হতে থাকে। ঢাকা থেকেও ঢাকা বেতারের শিল্পী-কুশলীরাও আসতে থাকেন। প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ তথা ২৫ মে তারিখ। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮নং দোতলা বাড়িটিতে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আবাসের কক্ষের সাথের একটি কক্ষে উক্ত ট্রান্সমিটার দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা অন্য বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর সেই ৫৭/৮ নম্বর বাড়িটিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থায়ী কার্যালয়রূপে গড়ে ওঠে। এরপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত হতে থাকে। এই কেন্দ্র দুটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।

এর মধ্যে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া রেডিও’র শিলিগুড়ি কেন্দ্রকে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” হিসাবে উল্লেখ করে সেখান থেকে ভাষণ প্রদান করেন এবং এরপরেও বেশ কিছুদিন ঐ কেন্দ্র হতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণসহ আরো নানাবিধ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
এরপর ১৬ এপ্রিল জনগণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্দেশিত ঘোষণা ও আদেশপত্র পাঠ করা হয়। এরপর সেখানে কয়েকদিন অনিয়মিতভাবে সম্প্রচার চলেছে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার পর এর নাম বদলে বাংলাদেশ বেতার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা থেকে সম্প্রচার শুরু করে বাংলাদেশ বেতার যা এতকাল রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। “জয় বাংলা, বাংলার জয়” গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে প্রচারিত হতো।

jaidul cover

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ব্রাহ্মনবাড়িয়াঃ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই ইতিহাসের সাথে আরো একটা ইতিহাস যুক্ত করার চিন্তা থেকেই আমার আজকের এই লেখার অবতারনা। চট্টগ্রাম এবং কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মুক্তিকামী জনতা ১৯৭১ সালে গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে আরেকটি বেতারকেন্দ্র এবং তাঁরা খুব সফলভাবে সম্প্রচার করেছিলেন স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরনাদায়ী অনুষ্ঠান। ফিরে যাই ৭১ এর সেই সব দিনগুলিতে।

weekly sandeep 11-17 dec 1989 p49

এক নজরে ব্রাহ্মনবাড়িয়াঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে এই জেলা কুমিল্লা (পুরাতন নাম টিপরা) জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। উল্লেখ্য ১৮৩০ সালের পূর্বে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ অঞ্চল প্রাচীন বাংলার সমতট নামক জনপদের অংশ ছিল।

ঈসা খাঁর প্রথম ও অস্থায়ী রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে সরাইলে। এ জেলায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বিপ্লবী উল্লাস কর (অভিরাম) দত্ত কর্তৃক বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে আন্দামানে দীপান্তরিত হয়েছিল। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ ও গোপাল দেব প্রকাশ্য দিবালোকে তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.সি.বি স্টিভেনসকে তারই বাসগৃহে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৩০ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল হাকিম খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। এ সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে চারজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল আখাউড়ার যুদ্ধে শহীদ হন।

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ ম্যানেজার মি হ্যালিডের কুঠি সরাইল থেকে শহরের মৌড়াইলে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি ভেঙ্গে সরকারি অফিস ঘর করা হয়েছে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের মুনিপুর অধিকারের সময়ে তাদের সামরিক সদর দফতর ছিল এ শহরে। শহরের বাণিজ্য কেন্দ্র আনন্দবাজার ও টানবাজার। আনন্দবাজার, টানবাজার, জগৎবাজার, মহাদেব পট্টি, কালাইশ্রী পাড়া, মধ্যপাড়া, কাজীপাড়া ও কান্দিপাড়া শহরের পুরাতন এলাকা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এ শহরকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। ১৮৬৯ সালে শহরটি পৌরসভায় রূপান্তর হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এ শহরের উত্থান।

378946_2553471308941_224489791_n

কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ বা শুধু কুল্লাপাথর বা কোল্লাপাথর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সমাধিস্থল। একটি ছোট টিলার উপরে এই সমাধিস্থল অবস্থিত। কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর পাশের ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষে পরিণত হয়েছিল ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। এখানে দুজন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম, দুজন বীরপ্রতীক সহ মোট ৪৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের উপরেই লেখা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাম এবং ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম এবং তার আত্নীয়রা মিলে তার পৈত্রিক ভিটায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করে দাফন করেন। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও রেস্ট হাউস, তোড়ণ এবং পুকুরের পাঁকা ঘাট নির্মাণ করা হয়।

BB1

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠনের উদ্যোগঃ

২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর খালেদ মোশাররফকে কুমিল্লাতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২৬ মার্চ মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে তিনি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈনিক নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ঢাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে তিনি বিদ্রোহ করেন এবং সেই রাতে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালে তাঁর বাহিনী এবং সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত মেজর শাফায়াত জামিলের বাহিনী সম্মিলিত হয়। ইতোমধ্যেই তাঁর বেতার নির্দেশ পেয়ে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত পাঞ্জাবী সৈনিকদের আটক করেন। মেজর খালেদ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দ্বায়িত্ব নেন।

Prof_Khaled-Mosarraf-portrait

তখন ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ সি এস পি। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহন করেন। ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরের উত্তর প্রান্তে তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার ছিলো। স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ রক্ষার জন্য তেলিয়াপাড়ায় কমান্ডার কর্নেল রেজা (শিশু মিয়া)’র নিকট পাঠিয়ে দেন।

মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় একটি বেতারকেন্দ্র স্থাপন করা যায় কিনা তা নিয়ে মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের সাথে আলোচনা করেন। কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ ততকালীন ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিন্টডেন্ট জনাব শামসুদ্দীন আহমেদকে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন।

জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের নিজেদের তৈরী একটি সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ট্রান্সমিটারকে এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। তিনি সেটার সঙ্গে নতুন যন্ত্রাংশ যুক্ত করে প্রচার পরিধি বাড়িয়ে তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রে সেটি স্থাপন করেন। ফলে ব্রাহ্মনবাড়িয়া সহ আশেপাশের অঞ্চল এই রেডিও ট্রান্সমিটারটির আওতাভুক্ত হয়। এইভাবে অতি দ্রুততার সাথে স্থাপিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতারকেন্দ্র স্থাপনে ততকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য জনাব আলী আজম, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব লুতফুল হাই সাচ্চু এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়া কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জনাব ইকবাল হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য। মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ ব্রাহ্মনবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক এ কে এম হারুনুর রশিদকে কেন্দ্রের পরিচালক এবং ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর ওসমানকে তাঁর সহকারী নিয়োগ করেন। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও কারিগরী তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিলেন ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারেন্টন্ডেন্ট জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ।

যাত্রা হলো শুরুঃ

১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ এ বেতার কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন করা হয়। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। পরে অবশ্য সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়। উদ্ভোধনীর দিন ততকালীন ছাত্রনেতা ইউসুফ একটি মাইক্রোফোন হাতে সমস্ত শহরবাসীকে এই বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার আহবান জানান। শর্টওয়েভে ১৩ মিটার ব্যান্ডে এই বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। অধ্যাপক এ কে এম হারুন উর রশিদ এবং ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর ওসমান কিছুক্ষন পর পর সংবাদ বুলেটিন প্রচার করতেন এবং বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে নির্বিচারে গনহত্যা চলছে তার সংবাদ প্রেরন করতেন। সংবাদ বুলেটিনের ফাঁকে ফাঁকে বিপ্লবী গান প্রচার করা হতো। ‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’ সবচাইতে বেশী প্রচার করা হতো। অধ্যাপক এ কে এম হারুনুর রশীদের ভাষায়-

‘অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য তাঁদের সম্বল ছিলো একটা রেকর্ডপ্লেয়ার আর কিছু সংখ্যক রেকর্ড। গান বাজানোর জন্য মাইক্রোফোনটিকে রেকর্ডপ্লেয়ারের সামনে রাখা হতো’।

384529_2553382106711_1005951702_n

স্বপ্নের অপমৃত্যুঃ

১৯৭১ সালের ২৮ শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরে পাক হানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় তখন কমান্ডিং অফিসার কর্নেল খালেদ মোশাররফ এবং মেজর সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাংগালি ই পি আর , পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ বাহিনীর অস্ত্র দিয়ে হানাদারদের মোকাবেলা করা হয়। এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়ার দক্ষিন অংশে কুরুলিয়ার খালের নিকট মুক্তিবাহিনী পাক হানাদারদের আক্রমন করেন প্রচন্ড যুদ্ধে পাক বাহিনীর একজন অফিসার এবং কয়েকজন সিপাহী নিহত হবার পর হানাদার বাহিনী কুমিল্লার দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২৯ শে মার্চ বিকেলে ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরের অনেক উপর দিয়ে কয়েকটি পাকিস্থানী বিমান উড়ে যেতে দেখা যায়। বিমানগুলো কয়েকটি চক্কর দিয়ে শহরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান চিহ্নিত করে হবে ধারনা করা যায়। মুক্তিবাহিনীও সম্ভাব্য বিমান আক্রমন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্থানে বাংকার খনন করে মুক্তিবাহিনী সতর্ক অবস্থান নেয়। এর ঠিক দু’দিন পর ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ব্যাপক বিমান আক্রমনের শিকার হয় ব্রাহ্মনবাড়িয়া। উপর্যুপরি আক্রমনে ততকালীন পাকিস্তান সেল ওয়েল কোম্পানী (বর্তমানে তিতাস গ্যাস ফিল্ড) এর এক নাম্বার লোকেশনে একটি তেলের ট্যাংকিতে আগুন ধরে যায় এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ধ্বংশ হয়ে যায়। শহরের পাইকপাড়ায় মেশিনগানের গুলিতে একজন মহিলা নিহত হন। মুক্তিবাহিনীর হাতে তখন বিমান বিধ্বংশী কামান না থাকায় পাক হানাদাররা অতি অল্প সময়ে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি করতে সমর্থ হয়। সেই হামলায় ধংশ হয়ে যায় অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পাকিস্তান বিমানবহরের বোমা বর্ষনের মাত্র দশ মিনিট আগে ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর তাঁর সহযোগীদের নিয়ে চা পান করতে যাওয়ায় অল্পের জন্য তাঁরা প্রানে বেঁচে যান।

শুধু বেতারকেন্দ্র ধ্বংশ করে ক্ষান্ত হয়নি পাক হানাদাররা। ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহর দখল করার পর স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলটিকে পুড়িয়ে ফেলে (কারন ব্রাহ্মনবাড়িয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ ছিলেন এই স্কুলের সুপারেন্টেন্ডেন্ট)। এতে তিলে তিলে গড়ে তোলা স্কুলটির প্রায় আট লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হয়। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার এই বেতারকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট অনেককে পরবর্তীতে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের সবার নাম হানাদার বাহিনীর মৃত্যুর খাতায় ছিলো।
পাকিস্তানী বিমান হামলায় বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে যাবার পর আর পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। উদ্ভোধনের পর এ বেতারকেন্দ্র মাত্র তিনদিন স্থায়ী ছিলো। ব্রাহ্মনবাড়িয়া বিদ্রোহের খবর প্রচার সম্পর্কে কর্নেল সাফায়াত জামিল বলেনঃ

২৭শে মার্চ বিকেল থেকেই পুলিশ ও তিতাস গ্যাস অফিসের ওয়্যারলেস এবং টেলিফোন অফিসের অপারেটরদের সহায়তায় সারাদেশে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার চতুর্থ বেঙ্গলের বিদ্রোহ করার খবর ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা হতে লাগলো। আমরা ব্রাহ্মনবাড়িয়াকে মুক্তাঞ্চল ঘোষনা করে সবাইকে এখানে আসার আহবান জানালাম। বল্লামঃ অন্য কেউ বিদ্রোহ করলে যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। স্থানীয় পুলিশ, ই পি আর, এস ডি ও এবং টেলিফোন অপারেটররা এই মেসেজ প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করে।

একি ধারাবাহিকতায় তিতাস গ্যাস ফিল্ডের এক নাম্বার লোকেশনে একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিলো। বেতারকেন্দ্রটি মাত্র তিন দিন স্থায়ী হওয়ায় এটি সম্পর্কে তখন অনেকেই অবগত ছিলেননা। তবে এর কার্যকারিতা ছিলো গুরুত্বপুর্ণ। এই বেতার কেন্দ্রের ঘোষনা শুনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই ব্রাহ্মনবাড়িয়া এসে যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন।

ব্রাহ্মনবাড়িয়ার স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মাত্র ৩ দিনের জন্য সক্রিয় থাকলেও তার গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। ১৮৭১ সালের ১৮ই মার্চ ফ্রান্সের প্যারিসের শ্রমজীবি মানুষ প্যারিস কেন্দ্রীক যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেছিল তাই প্যারি কমিউন নামে পরিচিত। যদিও এই রাষ্ট্র টিকেছিল মাত্র ৭২ দিন। যার পথে ধরে আজকে আলোকিত সারা দুনিয়া। ঠিক সেভাবেই ব্রাহ্মনবাড়িয়ার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অল্প কয়েকদিন স্থায়ী হলেও তার আবেদন টিকে থাকবে মুক্তিকামী বাঙ্গালীর হৃদয়ে যতোদিন বাংলাদেশ-এই মাটি-এই বাতাস-এই নদী বেঁচে থাকবে-ততদিন থাকবে। ক্ষুদ্র স্ফুলিংগ থেকেই জন্ম নেয় বিপ্লবের দাবানল।

স্বপ্নের মৃত্যু নেই!
জয় বাংলা।

রেফারেন্সঃ
০১। ডঃ মাহবুব আলম পিয়াল, সচিত্র সন্ধানী ৪র্থ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা রবিবার ২৭ শে মার্চ, ১৯৮৩
০২। দৈনিক জনকন্ঠ
০৩। জয়দুল হোসেন- মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মনবাড়িয়া
০৪। কে এম ফিরোজঃ সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ ১১-১৭ ডিসেম্বর, ১৯৮৯- ব্রাহ্মনবাড়িয়া স্বাধীন বাংলা বেতার ও কালুরঘাট ট্রান্সমিশনের নতুন তথ্য
০৫। উইকিপিডিয়া
০৬। দ্য ডেইলী ষ্টার

স্পেশাল থ্যাঙ্কসঃ
চমন সিকান্দার জুলকারনাইন
সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুল

ছবি পরিচিতঃ

০১। ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলা মানচিত্র।
০২। কবি জয়দুল হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মনবাড়িয়া’ বইএর প্রচ্ছদ।
০৩। সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে প্রকাশিত কে এম ফিরোজের নিবন্ধ।
০৪। পুড়িয়ে দেওয়া ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের ছবি (১৯৭১)
০৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও কারিগরী তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিলেন ব্রাহ্মনবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারেন্টন্ডেন্ট জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ।
০৬। জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম
০৭। দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত নিবন্ধ।
০৮। ডঃ মাহবুব আলম পিয়াল, সচিত্র সন্ধানী ৪র্থ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা রবিবার ২৭ শে মার্চ, ১৯৮৩






Shares