নাসিরনগরের আকাশ থেকে ঝড়ে গেল একটি তাঁরা
মোঃ আব্দুল হান্নান নাসিরনগরঃ- সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ভোর তখন ৬টা বাজে। আমি তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। হঠাৎ মোবাইল ফোনে রিংটুন বাজতে লাগল। জয় বাংলার জয়। ঘুমে নিমগ্ন থাকার কারণে ফোনটি রিসিভ করতে পারিনি। ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাড়া-তাড়ি ঘুম থেকে উঠে মেসেস অপশনে গিয়ে দেখি নাসিরনগর ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের কেমিষ্টি প্রভাষক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল হকের ২য় মেয়ের জামাই আমার প্রিয় বন্ধু মাঈনউদ্দিন ভূইয়া(শান্ত) র মেসেস। লেখা দুপুর ১টা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল হকের জানাযার নামাজ অনুষ্টিত হবে। মেসেসটি পড়ে আমি স্তদ্ধ হয়ে গেলাম। কান্না থামাতে পারলাম না। দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমার স্ত্রী সেলিনা এসে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে ? আমি উত্তর দিতে পারলাম না। অনেকক্ষণ পর বললাম আহসানুল হক মাষ্টার মারা গেছে। সে ও শোনে হতবাক ! তাড়া-তাড়ি কাপর পড়ে নাসিরনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রাস্তায় এসে রিকসা, সি এন জি কিছইু না পেয়ে পুরাতন ভটভটে টেম্পুতে চড়ে বসলাম। তাড়া-তাড়ি নাসিরনগর যেতে হবে। টেম্পুতে চড়া মাত্রই ফোন করলেন নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ আজদু মিয়া(মেম্বার)। বললেন বেয়াই আপনি কোথায় ? বললাম নাসিরনগর আসছি। তিনি বললেন তাড়া-তাড়ি শহীদ মিনারে আসুন। পাঁচ মিনিটেই দেখা হলো শহীদ মিনারে মেম্বারের সাথে। তিনি বললেন ১২টা নাসিরনগর সদরে এবং ২টায় তাহার গ্রামের বাড়ি নুরপুরে স্কুল মাঠে জানাযা হবে। মাইক পাঠানো হয়েছে। আপনি তাড়া-তাড়ি জানাযা ও সংবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করুন। আমি কিছুই বলতে পারছি না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার একান্ত সহযোগী রাইটার মোঃ আলাউদ্দিন ও ভেন্ডার মোঃ আব্দুল কাদেরকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম হারুনের কম্পিউটার দোকানে। সেখানে বসে অত্যান্ত ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল ২৪ এর জেলা প্রতিনিধি রিয়াজ উদ্দিন জামি ভাই, যমুনা টিভির সফিক ভাই, সময় টিভির উজ্জল চক্রবর্তী, এস এ টিভির পলাশ ভাই সহ অনেককেই ফোনে সংবাদটি প্রচারের অনুরোধ করলাম। বিজয় টিভির মাসুদ ভাই ও মানবজমিনের সরাইল প্রতিনিধি মাহবুব ভাইকে ক্যামারে নিয়ে নাসিরনগরে জানাযা অনুষ্ঠাতে আসার অনুরোধ করলাম। তারা দুইজন আসলেন । যথা সময়ে জানাযা শুরু হলো। জানাযায় অংশ নিলেন বিপুল সংখ্যক লোক। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী, ক্ষমতাশীন ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশিল সমাজের লোকজন। জানাযার শুরুতেই মোঃ আহসানুল হকের রাজনৈতিক আদর্শ, সততা ও বিভিন্ গুনাবলীর কথা বলতে গিয়ে তার সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লেঃ অবঃ গোলামনূর, সাবেক সংসদ সদস্য এস এম সাফি মাহমুদ, সাবেক সদর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ মোঃ আব্দুল আহাদ, কুন্ডা ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ওমরাও খান ও নাসিরনগর উপজেলা বি এনপির সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান সহ অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। জানাযা অনুষ্ঠানটিতে শুরু হয় এক হৃদয় বিধারক দৃশ্য। আমি তখন নির্বাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে জানাযা অনুষ্টান এবং লাশের ছবি তুলতে লাগলাম।
কর্মই ধর্ম । গুনে নয়, নামেই যার পরিচয় । মানুষ বাচে তার কর্মে।কথায় বলে সৎ কর্মের ফল সুমধুর হয় । গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্যন্ত অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১ আসন নাসিরনগর। যার আয়তন ৩১০ বর্গ কিলোমিটার আর লোক সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৬৮ জন। নাসিরনগর উপজেলা শিক্ষার হার মাত্র ২৭.৮%। এখানে অধিকাংশ কৃষি আর শ্রমজীবি মানুষের বসবাস। অধিকাংশ গ্রাম এখনো বিদ্যুৎ শুন্য। এই অবহেলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে জম্মেছে অনেক জ্ঞানী গুনী মনীরিষিরা। যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় যুগযুগ ধরে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। পরিছিন্ন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ও সারা বাংলাদেশের, শ্রেষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে অতীশ দীপংকর স্বনপদক ও কবি জসীম উদ্দিন পদক প্রাপ্ত মোঃ আহসানুল হক মাষ্টারের মত অনেক গুনী জনের জন্মস্থান এই নাসিরনগর। যাকে নিয়ে আজকের এই প্রয়াস তিনি হলেন মোঃ আসানুল হক (মাষ্টার)। পিতামৃত- ছবদর আলী, মাতা মৃত- আলেক জাহান বিবি। চার ভাই ও নয় বোন। ভাইদের মাঝে মোঃ আহসানুল হক তৃতীয়। মোঃ আহসানুল হক ১৯৫১ সালের ৭ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহি গোকর্ন ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মোঃ আহসানুল হক ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় বোটানি বিভাগ থেকে এম, এস সি তে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১১ তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার হিসেবে যোগদান করে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বি আর ডিবি অফিসার পদে যোগ দেন। একই বছর খুলনা জুট মিলে চাকুরী নিয়ে পরবর্তীতে চট্টগ্রামের সিতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজে বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দান করেন। তা ও তিনি ছেড়ে দিয়ে কুদালা চা বাগানে চাকুরী নেয়। দেশ প্রেম মাটি ও মানুষের ভালবাসা আর নাড়ীর টানে চলে আসেন স্ব-গ্রাম নূরপুরে। সেখানে নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতিষ্টাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন। ২০১১ সালের ৭ অক্টোবর তিনি উক্ত চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মোঃ আহসানুল হক একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বড়ভাই মোঃ মোজাম্মেল হক কাপ্তান মিয়া ছিলেন একজন সফল রাজনীতিবিদ। ১৯৯৬ সালে মোঃ আহসানুল হক জাতীয় পার্টি থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে সাধারণ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী প্রার্থী এডঃ ছায়েদুল হকের সাথে পরাজিত হন। ২০০১ সালে মোঃ আহসানুল হক চার দলীয় জোটের জাতীয় পার্টি (নাফি) প্রার্থী হিসেবে ধানেরশীষ প্রতীক নিয়ে দলে আরও দুইজন বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান (সুখন) ও সৈয়দ সাফি মাহমুদ থাকার পরেও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর সাথে অল্প ভোটের ব্যবধানে আবারও পরাজিত হন। বড়ভাই মোঃ মোজাম্মেল হক কাপ্তান মিয়া ছিল এম সি এ(সংবিধান প্রণেতা) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পরপর দুইবার জাতীয় পার্টি থেকে সফল সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি তৎকালীণ সময়ে এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্টান,ধর্মীয় প্রতিষ্টান ও বহু রাস্তাঘাট নির্মান করেন। নাসিরনগর ডিগ্রী মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্টার উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। মোঃ মোজাম্মেল হক কাপ্তান মিয়া সাত বারে ৩৫ বৎসর গোকর্ণ ইউনিয়নের সফল চেয়ারম্যান ও ছিলেন। ২য় ভাই মোঃ ইমরানুল হক জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তা থাকা কালে ৪৮ বৎসর বয়সে অকালে মৃত্যৃবরণ করেন । ছোট ভাই মোঃ আজহারুল হক নির্বাচিত নাসিরনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কমান্ডার ও স্থানীয় এনজিও লাঙ্গলধরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত উপজেলা নির্বাচনে আহসানুল হক প্রার্থী না হওয়ার ইচ্ছা থাকার পরেও জনগণের অনুরোধে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি- বিজেপি র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগ প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লেঃ অবঃ মোঃ গোলাম নুরকে প্রায় চার হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হন। সৎ যোগ্য, সফল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে এলাকায় রয়েছে তার ব্যপক পরিচিতি ও সুনাম। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি র কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা কমিটির আহবায়ক ছিলেন। সারা বাংলাদেশে সৎ যোগ্য সেরা জন প্রিয় সফল চেয়ারম্যন হিসেবে উদিয়মান বাংলাদেশ নামক প্রতিষ্টান ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় থাকে অতীশ দীপংকর স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। এর পূর্বে ও তাকে কবি জসীম উদ্দিন ক্রেষ্ট প্রধান করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ নির্বাচনীয় এলাকা নাসিরনগরে জনগণের ভালবাসা সিক্ত হয়ে জন প্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। মোঃ আহসানুল হক সহজ সরল সৎ, শান্তি প্রিয় দেশ প্রেমিক জননেতা হিসেবে জনগণের কাছে সুপরিচিত ও নন্দিত। জনপ্রিয় নেতা আহসানুল হকের শৈশব, কৈশোর,ছাত্রজীবন,চাকুরী জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের আদর্শ, উদ্দেশ্যে, সততা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আনুমানিক দুই তিন মাস পূর্বে তিনি ফুসফুসের সমস্যা জনিত কারণে চিকিৎসা নিতে চলে যান ঢাকার গ্রীণলাইফ হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে চলে আসেন বাড়িতে। গোকর্ণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের শত বর্ষ পুর্তি উপলক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট ছায়েদুল হকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল তার কিন্তু অসুস্থতার জন্য পারেনি। পড়ে চলে যান ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় ৪ মার্চ রোজ বুধবার রাত ১২টা ১মিনিটের সময় কাউকে কিছু না বলে উপজেলা বাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ফাঁড়ি জমান অজানার উদ্দ্যেশ্যে না ফেরার দেশে। তার আকষ্মিক মৃত্যুর খবরে নাসিরনগর বাসীর মাঝে নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। সদায় হাস্যউজ্জল মানুষটিকে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে থাকে নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। অফিসে এসে অনেক সময় নিজে অথবা তার সিএ রাশেদুল হাসানকে দিয়ে আমাকে ফোন করে নিয়ে আসত তার অফিসে। অবসরে চলত চায়ের আড্ডা ও বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ। তার হৃদয় ছিল সমুদ্রের চেয়ে ও বিশাল । গরীব দুখী অসহায় মানুষের বিপদে, দুঃখে ও বিভিন্ন সমস্যায় এগিয়ে আসতেন বর্জ্ররে মতো। আমার মন বলছে আহসানুল হক মরেনি। তিনি সমাজ ও দেশের মাঝে এত অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার,দূর্নিতি দেখে মনের ক্ষোভে দিক্ষার দিয়ে আমাদের চোখের আড়াল থেকে অনেক দুর চলে গেছে। যেখানে হয়তো কোন দিন আর আমরা থাকে দেখতে পাবো না। আহসানুল হককে লিখতে বসে আমি অনেক কৃপণতা করেছি। এজন্য আমি আর্ন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আহসানুল হক ভাই দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আল আমিনের দরবারে আপনার জান্নাত কামনা করি। আল্লাহ পাক আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুক। আমিন।