Main Menu

পালিয়ে বেড়িয়েছেন সানুর মা :: এডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

+100%-

NISHAT-PIC-2নবীনগরের জালশুকা গ্রামে পাক হানাদারদের বিচরণ না থাকলেও আতঙ্ক তাড়া করেছে এ গ্রামের মানুষকে সবসময়ই। এরবাইরে ছিলেন নারীরাও। তেমনই একজন সানুর মা। পুরো নাম খোরশেদা খাতুন। তবে গ্রামের মানুষের কাছে সানুর মা বলেই পরিচিত তিনি। সানু তার বড় মেয়ে। বয়স ৭০ প্রায়। গ্রামের গরিব ঘরের একজন গৃহিনী। কথা হয় তার সঙ্গে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দাইয়ের কাজ করতেন ।এখনো তাই করেন। তার হিসেবে লাখ সন্তানের জন্ম হয়েছে তার হাত দিয়ে। মার ডেলিভারী করেছেন,আবার তার ঘরে জন্ম নেয়া মেয়ের ডেলিভারীও হয়েছে সানুর মায়ের হাতে। দারুন অভাব-অনটন,আর পাঞ্জাবির হামলার আতঙ্কে কেটেছে তার যুদ্ধের নয় মাস।পাশের গ্রাম খারঘরে পাকবাহিনী হামলা করে অনেক মানুষকে হত্যার পর এই গ্রামের মানুষের আতঙ্ক যায় আরো বেড়ে। গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া পাগলীনি নদী দিয়েই পাঞ্জাবিরা লঞ্চ নিয়ে খারঘরে হানা দেয়। তাদের চিন্তা জালশুকা যদি এরা ডুকে পড়ে। জীবনের শেষ বেলায় এসে রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবেন সে সময়ের কথা। সানুর মা অর্থাৎ খোরশেদা হরহর করে বলতে থাকেন আতঙ্কের সেই দিনগুলোর কথা। বলেন পালাইছলাম একদিন-অই,যেদিন ছুট্টোর বাইত পাঞ্জাবি আইছিন। ঘরে আড়াইশের চাল আছিন,ইতা গুড়ার তলে ফালাইয়া বাইত থাইকা গেছিগা।পইল্লা রহিমের নানার বাড়িত,গোসাইপুর,হিহান থেইক্কা খাড়ঘর গেছি। পাঞ্জাবি গ্রাম থেইক্কা যাওনের পর আবার বাড়িত আইছি। হুনছি হেরা পাঞ্জাবিরে ভালা করা খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বিদায় কইরা দিছে। আরেকদিন পরিবার পরিকল্পনা অফিস থেকে আমরারে ডাকছে নবীনগর যাওনের লাইগা। খবর পাডাইছে না গেলে চাকরী যাইবোগা। বাড়িত থেইক্কা হুজুরের(জামাল উদ্দিন) সাথে ইদ্রিসের নাও-য়ে কইরা রওনা দেই সহাল ৮/৯ টার দিগে। সাথে আমার ঘরের লা-ও (স্বামী)। আমরা যাই উজান দিগে,আর দেহি মানুষ নাও ভইরা ভইরা ভাইট্টাইতাছে । বেডা-বেডি আর আবুইদ্দায় নাও বোঝাই। আমরারেও অনেকে হেদিকে না যাওনের লাইগা মানা দিছে। দেহি চিত্রি গ্রামডা আগুনে জ্বলতাছে। হেদিন যে একটা ডর পাইছিলাম। হুজুর কই তোমরা সবাই নাওয়ে থেইক্কা-অই উজু করো। উজু কইরা নিজের জানাজা নিজে পইরা লও। হজুর কইলমা(কলিমা) পড়াইছে,তওবা করাইছে। নবীনগরে পৌইচ্ছা কাজ শেষ কইরা দুপুরে আওনের সময় দেহি চিকনা গড়নের সুন্দর সুন্দর দুই পাঞ্জাবি একটা দোহানো ডুকতাছে। হেরার আতো মুরগি। আমি হেরারে দেইখ্খা ডরাইছিনা। চিন্তা করছি তদিলে(ধীরে) আডুম। আস্তে আস্তে আটতে তাহি। আমার তাইনে কয় জলদি আডো(হাটো)। আমি চিন্তা করলাম জোরে আটলে হেরা আমারে সন্দেহ করবো।মনে করবো কোন হবরী-টবরী(গুপ্তচর)। পরে নাও-অ উঠট্টা তাইনরে তাইস(ধমক) দিছি তাইনরে,কইলাম আফনে যে কইলাইন জোরে জোরে আটতাম,আমি যদি জোরে জোরে আটতাম তইলেইতো হেরা আমারে সন্দে কইরা ধইরা লাইলো অইলে। আমি বোরহা পইরাই গেছিলাম। দেখতে সুন্দর আছিলাম,হেললাইগা ডর আছিন বেশী। সংগ্রামের(যুদ্ধের)সময় ডরাইয়া ডরাইয়া চলছি। আরেকদিন গেছিলাম,পৈরতলা। আমরা বাড়িত যহন পাঞ্জাবিরা আগুন লাগাইয়া দিছিল।হেদিনও বোরকা পইরা গেছিলাম।কইলজাডা চিফা দিয়া রইছে। বাড়িডার অবস্থা দেইক্কা আবার আইয়া ফরছি। তহন আমার বোন কসম দিয়া কইছিল মুক্তিরারে পাইলে ঘরে যা থাহে তা-ঐ যেন হেরারে বাইট্ট দেই। একদিন আছরের ওয়াক্ত ৭ জন মুক্তি আমরার বাইত উটছে।হেরারে ঘরের ভিতরে রাইক্কা দরজা বন্ধ কইরা আমি যাইয়া বাইরে দিয়া ঘুরি। মেস্তুর (মিস্ত্রি)বাইততে একপুরা (একহাড়ি)মুরি আইন্না দিছিলাম হেরারে হাইতো। খোরশেদার স্বামী ছিল শয্যাশায়ী,প্যারালাইসিসে আক্রান্ত।স্বামীর আয় রোজগার ছিলনা। তাই সংসার ছিল অভাবের। অনেকদিন না খেয়েও থাকতে হয়েছে তাদের। বলেন মাত্র একটা শাড়ির জন্যে রোজার সারা মাস হুজুররে রাইন্দা হাওয়াইছি। মোল্লা বাড়ির চেয়ারম্যান(আবদুর রহিম হুমায়ুন),তার বউ (তুহুরা বেগম),গ্রাম সরকার(সিরাজুল হক),অহিদ মাষ্টার আমারে অনেক সাইজ্জকরছে। কেই জুমন না দেহে চেয়ারম্যান পানের ভাডাত বইরা ভাত দিছে। এইডা-হেইডা আবুনির মারে দিয়া পাডাইয়া দিছে। মাইনষের ভাত রাইন্দা দিছি,হেরা যেডা দিছি হাইছি,আর কানছি।ডরের চেয়ে কষ্ট করছি তহন অভাবে। তহন ভাত জুডাইয়া হাইতে পারছিনা। আমারে হগলতে কইতো পাগলনী। সারাদিন চৈচৈ করতাম,আর কানতাম। কানছি অভাবের লাইগ্গা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বেডি আমি,তিন রাস্তার মোড় আমার বাড়ি। অভাইভ্যা জামাইর কাছে বিয়া দিছে। এমনে সারদিন কাজ করছি।বাকী সম চাইয়া রইছি। সব সময় কান আলগি(সজাগ) দিয়া রাখছি। এদিক দিয়া আওয়াজ,হেদিকদিয়া আওয়াজ। এরে জিগাইছি,হেরে জিগাইছি। হুনতাম এমেদা পুইরা লাইতাছে,হেমেদা পুইরালাইতাছে। রাইত অইলে অহন চিন্তা করি ,কলফনা করি হেসমর কথা। কিয়ামত আছিল যেন সংগ্রামের সমডা।






Shares