নাসিরনগরের কুলসুমার প্রেমেই জীবন গেল হাসিমের, শ্বাশুড়ীর প্রেমিককে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণণা দিল খুনি জামাই
মৃধা মুরাদ : যার সনে যার ভালোবাসা, তারে ছাড়া প্রান বাঁচেনা! পিরিতি এই জগতে জাতি কুলের ধার ধারে না।। এ গানটির সাথে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। এই গানেরই যেন বাস্তুব প্রতিফলন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহজাদাপুর ইউনিয়নের বাটবাড়িয়া গ্রামের মৃত গোয়াছ আলীর ছেলে আব্দুল হাসিম। বিয়ে করেছিলেন নাসিরনগর উপজেলার লক্ষিপুর গ্রামের কুলসুমা বেগমকে।
টানাপোড়নের কারণে তিন বছরের মাথায় ভেঙ্গে যায় সংসার। কুলসুমা হাসিমকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারলেও হাসিম তা পারেনি। শুধু কুলসুমাকে এক নজর দেখার জন্য হয়ে যান ভবঘুরে। কুলসুমার নতুন স্বামী নাসিরনগরের লক্ষিপুর গ্রামের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আক্তার হোসেনের বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত সে। আর এই প্রেমই জীবনের কাল হল হাসিমের। কুলসুমা, তার স্বামী আক্তার ও তার মেয়ের জামাই মন্নাফসহ খুনিরা পরিকল্পনা করে নির্মমভাবে খুন করে হাসিমকে।
গত মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জাকীয়াল ফারাবির আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আব্দুল মন্নান ওরফে মন্নাফ (৪৫)
আব্দুল মন্নাফ নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের লক্ষিপুর গ্রামের বাসিন্দা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌঁনে চারটার দিকে উপজেলার বুড়িশ্বর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি কুলসুমার সৎ মেয়ের জামাতা। হাসিমের হত্যার ঘটনায় আরো দুই আসামী আগেই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ৮ নভেম্বর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের লক্ষিপুর গ্রামের একটি ফসলি জমি থেকে গলায় রক্তমাখা শার্ট প্যাঁচানো অবস্থায় প্রথমে অজ্ঞাত পরিচয়ে হাসিমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এঘটনায় এসআই জুলুস খান পাঠান বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরের দিন নিহতের ছোট ভাই আব্দুর রশিদসহ পরিবারের লোকজন হাসপাতালে গিয়ে লাশটি হাসিমের বলে সনাক্ত করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নাসিরনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন বলেন, প্রায় চার বছর আগে হাসিমের সঙ্গে নাসিরনগর উপজেলার লক্ষিপুর গ্রামের কুলসুমা বেগমের দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তিন বছর সংসার করার পর কুলসুমা হাসিমকে তালাক দেন। পরে নাসিরনগরের লক্ষিপুর গ্রামের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আক্তার হোসেনকে বিয়ে করে কুলসুমা। কিন্তু হাসিম এ বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রায় বাড়ি-ঘরের কাউকে না জানিয়ে লক্ষিপুরে কুলসুমার কাছে চলে যেত। এনিয়ে কুলসুমা ও তার দ্বিতীয় স্বামী আক্তার বিরক্ত ছিল। এই কারণেই তারা হাসিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আব্দুল হাসিম প্রায় নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউকের আব্দুল্লাহ শাহ এর মাজারে যেতেন।
মন্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে কবির হোসেন বলেন, গত বছরের ৭ নভেম্বর রাত আটটার দিকে নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউকের আব্দুল্লাহ শাহ’র মাজার থেকে হাসিমকে ডেকে আক্তারের বাড়িতে নিয়ে যায় কুলসুমা। হাসিমকে তখন অন্য আরেক আসামীর ঘরে রাখা হয়।
ওইদিন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে ঘটনাস্থলে মন্নানকে ডেকে আনা হয়। সেসময় আক্তার, কুলসুমাসহ অন্যান্য আসামীরা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমের সঙ্গে কথা বলছিল। কথা বলার এক পর্যায়ে কুলসুমা বাঁশ দিয়ে হাসিমের কান ও ঘাড়ে বাড়ি দেয়। তখন হাসিম দৌঁড় দিলে সবাই তাঁকে আটক করে। মন্নান সেসময় ঘাড়ে চিপা দিয়ে হাসিমের মাথাটা মাটির সঙ্গে বাড়ি দেয়। এতে হাসিমের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। এরপর সবাই মিলে হাসিমকে ধরে ঘরে ভেতরে নিয়ে যায়। আক্তার সেসময় হাসিমের পড়নের শার্ট দিয়ে তার গলায় প্যাঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে মন্নান, আক্তার, নজরুলসহ অন্যান্য আসামীরা হাসিমের লাশ আক্তারের বাড়ি থেকে দূরে ফসলি জমিতে নিয়ে রাখে। আর কুলসুমা ঘরের রক্ত পরিস্কার করে।
তিনি আরও বলেন, আব্দুল্লাহ শাহ’র মাজার থেকে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে রাত আটটার দিকে হাসিমকে ডেকে নিয়ে। পরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে কুলসুমা, আক্তার ও মন্নাফসহ বাকি আসামীরা হাসিমকে হত্যা করে।
কবির হোসেন বলেন, গত বছরের ৯ নভেম্বর লক্ষিপুর এলাকা থেকে কুলসুমা ও আক্তার এবং চলতি বছরের ২৭জানুয়ারি নুরুল ইসলামকে নামে আরেক আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১০ নভেম্বর কুলসুমা এবং চলতি বছরের গত ২৮ জানুয়ারি নজরুল হত্যার দায় স্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।