Main Menu

রহস্যে ঘেরা কাদির হত্যাকান্ড

+100%-

মোহাম্মদ মাসুদ, সরাইল ॥ সরাইলের ষোলাবাড়ি গ্রামের প্রবাসী কাদির (৫০) হত্যাকান্ডকে ঘিরে এলাকায় নানা রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে। নিহতের পরিবার গ্রামবাসী ও আসামীর স্বজনদের বক্তব্যে রয়েছে ভিন্নতা। মতপার্থক্য রয়েছে হত্যাকান্ডের স্থান নিয়েও। অনেকের অভিযোগের তীর তৃতীয় পক্ষের দিকে। তবে কাদিরের পরিবার বলছে রমজান গংরাই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আর রমজানের স্বজনরা বলছে আমাদের বিরূদ্ধে এটা মলাই গংদের গভীর ষড়যন্ত্র। সঠিক তদন্তের দাবীও করেন তারা। অবশ্য এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী হেলেনা বেগম বাদী হয়ে ২০ জনের বিরূদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। অজ্ঞাতনামা আসামী রয়েছে ১৫/২০ জন। ভাংচুর লুটপাটের শঙ্কায় সেখানে অবস্থান করছেন পুলিশ।

মামলা স্থানীয় সূত্র জানায়, রমজান আলী ও আব্দুল কাদির একে অপরের প্রতিবেশী। রমজান দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করছেন। ২ বছর আগে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কাদিরকে ইরাক পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ৯ দিন জেল খেটে ফেরত আসেন কাদির। টাকাও দেননি। পাসপোর্টও আটকে দেন। এ নিয়ে তাদের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এলাকায় অনেক সালিস দরবার হয়েছে। চুড়ান্ত নিস্পত্তি হয়নি। গত ২৭ জুন পাসপোর্ট আদায়ের জন্য রমজানের বিরূদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন কাদির। এতে ক্ষিপ্ত হন রমজান ও দানা মিয়া গংরা। গত ৩০ জুন বুধবার রাতে মামলার খবর নিতে আধাকিলোটার দূরে মলাই সর্দারের বাড়িতে যান কাদির। রাত ৮টার দিকে কাদির ষোলাবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশের সড়কে রক্তাক্ত ও সঙ্ঘাহীন অবস্থায় পড়ে থাকেন। তাকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসক।

সরেজমিনে গেলে নিহতের মেয়ে সকিনা খাতুন (৩১) বলেন, সব করেছে পাসপোর্ট। মলাই সর্দারের বাড়িতে মামলার তদন্তের সময় জানতে গিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল আব্বা। রমজানের কাছে আব্বা ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাবে। কাগজে স্বাক্ষর না দিলে পাসপোর্ট দিবেন না। মলাই মিয়ার পরিচিত উকিল দিয়ে মামলা করেছেন। রমজান দানারা আগেই হুমকি দিয়েছিল।

নিহতের স্ত্রী হেলেনা আক্তার (৪৮) বলেন, মলাই সর্দারের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে রমজান ও তার লোকেরা। আমি স্বামী হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

রমজানের মেয়ে জোনাকি আক্তার বলেন, ঘটনার দিনে ও সময়ে আব্বা ঢাকায় ছিলেন। কাদিরের পরিবারের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। একটি রাস্তা নিয়ে মলাই মিয়ার বংশের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। মামলাও চলমান। মলাই গংদের গভীর ষড়যন্ত্র এটি। স্বাক্ষর না করা ও মামলা করার বুদ্ধিও দিয়েছেন মলাই। এ ছাড়া বিল্লাল, মুকসুদ, মুজিবুর ও রিপনসহ তারা সকলে মিলে আমার আব্বুকে ফাঁসিয়েছে।

তবে সালিস সভায় উপস্থিত থাকা হাজী শাহজাহান মিয়া (৬২) বলেন, সালিসে রজমান কাদিরের কাছে ৯০ হাজার টাকা পাওনা হয়েছিল। অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল হওয়ায় কাদিরকেই ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার রায় করা হয়। টাকাও দিয়েছে রমজান। শর্ত ছিল আপোষ নিস্পত্তির কাগজে স্বাক্ষর করে পাসপোর্ট নিবে কাদির। কাদির স্বাক্ষর দেয় না। তাই রমজানও পাসপোর্ট দেয় না। কাদির রমজানের নামে মামলা দিয়েছে। সালিসকারক হিসেবে গত বুধবার সকালে রমজান বিষয়টি চেয়ারম্যানসহ আমাদের জানিয়েছে। পুলিশের সাথে কথা বলে বিষয়টি নিস্পত্তির আশ্বাস দিয়েছিলাম। রাতেই কাদির খুন হয়।

যুবক জুনাঈদ যা দেখেছিল: মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। বাজার থেকে বাড়ির দিকে রওনা পথে ষোলাবাড়ি কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন সড়কে পড়ে আছে একটি মানুষ। প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় জুনাঈদ। সাহস করে কাছে যায়। চিনে ফেলে তার কাদির কাকাকে। পড়নের কাপড়ে রক্ত। পিঠে আঘাতের চিহ্ন। গড়িয়ে না গেলেও শরীরের নিচে কিছু রক্ত পড়ে আছে। শ্বাস ফেলছেন কাদির। কি হয়েছে? গাড়ি মেরেছে আপনাকে? কিন্তু কথা বলতে পারছেন না কাদির। বুঝতে বাকি নেই তিনি সঙ্ঘাহীন। দৌঁড়ে বাড়িতে খবর দিল জুনাঈদ। পরিবারের লোকজন এসে হাসপাতাল নিয়ে গেলেন।

বল্লমের ১৪ আঘাত: ষোলাবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, তিনি নিহত কাদিরকে গোসল করিয়েছেন। শুধু পিঠেই তার বল্লমের ১১টি ঘাই। প্রত্যেকটি ঘাই সামনে বুকেও আঘাত করেছে। এ ছাড়া ডান ও বাম হাতের নিচেসহ মোট ১৪টি বল্লমের ঘাই রয়েছে। শরীরের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন ধরণের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

খুনের শিকার পরিবারের চতুর্থ ব্যক্তি: কাদিরের বড় ভাই আব্দুল মজিদ (৫৭)। ক্ষোভের সাথে জানালেন, আমরা চতুর্থ নম্বর খুন হজম করতে চলেছি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের বজলুর রহমানকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে খুন করে। বাবার লাশও পায়নি। আমার ছেলে রফিকের বয়স তখন ৩০ বছর। ৩-৪ বছর আগে ডাকাতরা হত্যা করে ফেলে। একই ভাবে ৫-৬ বছর আগে গলাকেটে হত্যা করে আমার ভাতিজা শিশু কুতুব উদ্দিনকে (১৬)। একটি হত্যাকান্ডেরও বিচার পেলাম না। এই হত্যার বিচার পাব কিনা জানি না।
জাহানারা বেগম (৪৮) বলেন, আমার ছেলে এলাকায় ছিল না। এ বিষয়ে কিছুই জানে না। অযথা শিশু বাচ্চাটাকে আসামী করে তার জীবন ধ্বংসের খেলায় নেমেছে মলাই গংরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি ও সালিসকারক বলেন, ঘটনাটি অনেক আগেই নিস্পত্তি হয়েছে। রহস্যজনক কারণে একটি পক্ষ ইন্ধন দিচ্ছিল। কোন পক্ষই হত্যাকান্ড ঘটানোর মত নয়। এটা তৃতীয় কোন পক্ষের দ্বারা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সর্দার মো. মলাই মিয়া বলেন, অভিযোগ গুলো মিথ্যা। এ ঘটনায় আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। এলাকায় পলিটিক্স করি। তাই আমারও তো প্রতিপক্ষ আছে। এইসব তাদের ষড়যন্ত্র। এমন নেক্কারজনক ঘটনার বিচার চাই।

পানিশ্বর ইউপি চেয়ারম্যান মো. দ্বীন ইসলাম বলেন, দুই বছর আগেই তাদের বিষয়টি নিস্পত্তি হয়েছে। হঠাৎ করে কাদির মামলা করে। রমজানের সাথে কথা বলে শুক্রবার (২ জুলাই) বসার কথা জানিয়েছিলাম কাদিরকে। কাদির রাজিও হয়েছিল। বুধবার রাতেই কাদিরকে কে বা কারা খুন করে ফেলে। আমি এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের বের করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করছি।

সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসলাম হোসেন বলেন, পুরো ঘটনাটিই তদন্তের বিষয়। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সালিসকারকদের মতামত সহ সকল দিক মাথায় রেখেই তদন্ত করছি।






Shares