বাংলার ঐতিহ্য সরাইলের শিকারী কুকুর
সরাইল ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার একটি উপজেলা। সরাইলের কুকুর পাওয়া যায় এখানেই। সরাইলের কুকুর মূলত একপ্রকার গ্রে-হাউন্ড। এই কুকুর অন্যান্য কুকুরের মত নয়, চেহারা আকৃতি আচরন – সব দিকেই আলাদা। মুখের আদল অনেকটা শেয়ালের মত। কান ও লেজ লম্বা। সরাইলের কুকুেরর গায়ে বাঘের মত ডোরাকাটা দাগ আছে। সরাইলের ককুরের মধ্যে সবই খাটি সরাইল নয়। সংকর সরাইল রয়েছে। সরাইলের কুকুর অন্যান্য কুকুরের মত আহ্লাদী নয়। জড়িয়ে ধরা টাইপের আদর পছন্দ করে না। শিকারী কুকুর। খুব দ্রুত ছুটতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই সরাইলের কুকুর নিয়ে কিছু কিংবদ্ন্তী চালু আছে। সরাইল কুকুরের জন্ম নিয়ে এই মিথ। মুখায়ব শেয়ালের মত হওয়ায় একটি মিথ শেয়ালের সাথে সম্পৃক্ত। বলা হয় একবার সরাইলের দেওয়ান জমিদার হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে তিনি এই কুকুরটি দেখতে পান। কেনার চেষ্টা করেন কিন্তু মালিক রাজী ছিল না। শেষ পর্যন্ত হাতির বিনিময়ে এই কুকুর কেনা হল । পরে কুকুরের সাথে শেয়ালের সংমিশ্রনে যে প্রজাতি তৈরী হয় তাই সরাইলের কুকুর। অপর মিথটি সরাইলের গায়ের রঙ এর কারণে। বলা হয় জমিদার দেওয়ানের এই কুকুর একসময় হারিয়ে যায় বনে। বেশ কিছুদিন পরে কুকুরটি ফিরে আসে গর্ভবতী হয়ে। বাচ্চা প্রসব করার পরে দেখা গেল এর সাথে বাঘের বেশ মিল। ধারণা করা হয়, বাঘের সাথে মিলনে এই প্রজাতির উতপন্ন। মিথ যাই বলুক না কেন, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এই ধরনের মিলন প্রাকৃতিক নয়। এক প্রজাতির কুকুরের সাথে আরেক প্রজাতির কুকুরের মিলন হতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্কর পিতা-মাতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে জন্মাতে পারে। কিন্তু এক প্রানী অন্য প্রাণীর সাথে মিলন প্রাকৃতিক নয়। অবশ্য বর্তমানে বিজ্ঞান এ ধরনের সংকর তৈরী করার চেষ্টা করছে। ঢাকা চিড়িয়াখানায়ও এক সময় বাঘ এবং সিংহী একত্রে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর – আশা ছিল তেমন কিছু একটা হবে। হয়নি। অবশ্য উন্নত বিশ্বে এই ধরনের সঙ্কর প্রাণী রয়েছে।
সরাইলের কুকুর বর্তমানে অস্তিত্বের হুমকীতে আছে। সারা দেশে খাটি সরাইল কুকুর আছে হাতে গোনা। একসময় সরাইলের কুকুর পালন করতো সরাইলের বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু পারিবািরক এই ব্যাবসা থেকে সরে এসেছে অনেকেই। রয়ে গেছে সরাইল উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের অজিত লাল দাস। বাচ্চা সরাইল বিক্রি হয়, পাশাপাশি পূর্ণ বয়স্ক সরাইলও। বাচ্চা সরাইলের দাম ২০/২৫ হাার আর বড় সরাইলের দাম ৬০/৬৫ কিংবা আরও বেশী। এই সরাইল কুকুর পালেন বিত্তশালী মানুষরা। প্রতিদিন দুই আড়াই কেজি খাদ্য দিতে হয় একটি পূর্ণবয়স্ক সরাইলকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর দুটো সরাইল কুকুর ছিল। এই সরাইল কুকুর নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী রয়েছে। শোনা যায়, গেটে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছিল এই কুকুরগুলো। ফলে জেনারেল ওসমানী বেচে গিয়েছিলেন। আরেকটি কাহিনী থেকে জানা যায়, পাশের বাড়ির আদুরে কুকুরকে নাকি ছিড়ে ফেলেছিল এই সরাইলরা। প্রচন্ড প্রভুভক্ত এই কুকুর হিংস্রতায় কম নয়। শিকার এদের রক্তে। সরাইলের কুকুরের মূল ক্ষমতা কিন্তু তার ঘ্রাণশক্তিতে নয় বরং তার দৃষ্টিশক্তিতে। খরগোস, শেয়াল, বাঘডাশ ইত্যাদি শিকারে খুব দক্ষ।
ড: শাহজাহান ঠাকুর নামে একজন গবেষক ২০০১ সালে বানিজ্যিক ভিত্তিতে সরাইল প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন গবেষনায় তিনি প্রমান করেছিলেন সরাইলের কুকুর আমাদের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন কারণে তার এই উদ্যোগ শেষ পর্য়ন্ত টিকে থাকে নি। সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে RAB তাদের ডগস্কোয়াডে বারটি সরাইলের কুকুর যোগ করতে যাচ্ছে। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এদেরকে তৈরী করা হবে। এই উদ্যোগটা ভালো। প্রয়োজন আছে সরকারী উদ্যোগে এবং বানিজ্যিক উদ্যোগে সরাইলের কুকুর প্রজনন এবং রপ্তানি করা। রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মত হয়তো সরাইলের কুকুরও একসময় বাংলাদেশকে চিনতে সাহায্য করবে।
সরাইলের কুকুর দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। সরাইলের গল্প শুনেছি, পড়েছি, লিখলাম। দেখার আশা এখনো ছাড়ি নাই, এই কুকুর না দেখে মরা ঠিক হবে না। খুব শীঘ্রই হয়তো বেড়িয়ে পড়ব সরাইলের সন্ধানে।