অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ ॥ স্মরণ
আজ ২৪ ডিসেম্বর ’৫২-এর ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস। ২০১৪ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। আবু হামেদ ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে হোস্টেল ব্লকের নির্বাচিত সদস্য (সংস্কৃতি) হিসেবে মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে তিনি আহত হন। বরকতের রক্তে নিজের হাত ও রুমাল রঞ্জিত করে সেদিন বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তার জন্ম ১৩৩৫ সালের ৪ জ্যৈষ্ঠ (১৯২৮ সালের ১৮ মে) বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের আঁখিতারা গ্রামে।
১৯৪৬ সালে বিশেষ ট্রেনযোগে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বাংলা ও আসাম সফরের সময় আখাউড়া রেল স্টেশনে সিঙ্গারবিল ও পত্তন ইউনিয়নের মুসলিম যুবকদের নিয়ে চাউড়ার খান বাহাদুর শহুদুল সাহেবের ছোট ভাই আলাউল হক সাহেবের নেতৃত্বে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে সরাইল অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডে ১৭তম স্থান অধিকার করে মেট্রিক, ’৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ১ম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট এবং ’৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ’৫২ সালেই গঠন করেন সরাইল কালচারাল এ্যাসোসিয়েশন, যার উদ্যোগে ’৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সরাইল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ১৯৪৯ সালে সরাইলে তার সভাপতিত্বেই প্রথম ছাত্রলীগ এবং ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আওয়ামী লীগেরও সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তৎকালীন সরাইল থানার সকল ছাত্র-যুবক, জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহলের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আশীর্বাদ নিয়ে ১৯৭০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সরাইল কলেজ। ’৭১-এর ২৩ মার্চ সরাইলে হাজারো জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন কালে সভাপতির বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ পাকিস্তানকে তালাক দিলাম’। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার নরসিংহগড় যুব শিবিরের পলিটিক্যাল মটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গন পরিদর্শন করে আগরতলায় আসলে আমতলী-হাপানিয়ার উন্মুক্ত মাঠের জনসভায় তাদের দেয়া অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আবু হামেদ।
আবু হামেদের ব্যক্তিগত পরিচয়ে স্বাধীনতার পর তার কলেজে পা রেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী) ও ত্রাণমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী)। আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ সৈনিক আবু হামেদ ’৭৫-পরবর্তী সময়েও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শ প্রচারে পালন করেছিলেন সাহসী ভূমিকা। দীর্ঘ জীবনে এলাকায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন আবু হামেদ। এ সব কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সচেতন মহলের কাছে প্রিন্সিপাল আবু হামেদ নামটি অত্যন্ত সম্মানিত।
এলাকার জন্য যা তিনি করেছিলেন তা ক্ষমতার বাইরে থেকেই, শুধু মানুষের প্রতি ভালবাসা ও নিষ্ঠা দিয়েই। এর প্রতিদান হিসেবে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছিলেন বলেই নিজের জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখে গেছেন, ‘১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে কলেজ এলাকায় শাল, সেগুন, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি বৃক্ষরোপণ করেছিলাম। সরাইল কলেজ আজ বাংলাদেশের বৃক্ষ সুশোভিত একটি মনোরম স্থান।’ যতদিন সরাইল মহাবিদ্যালয়, সরাইল বালিকা বিদ্যালয় ও সরাইল আওয়ামী লীগ থাকবে আবু হামেদ নামটিও ততদিন দেদীপ্যমান থাকবে সবার কাছে। তার এই মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শাহ্ শেখ মজলিশ ফুয়াদ
লেখক : অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদের পুত্র