‘ওরা কাল আমাকেও মেরে ফেলতে পারে !’ :: পদ্মবিভূষণ পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া৷
ডেস্ক ২৪:: ‘ওরা কাল আমাকেও মেরে ফেলতে পারে !’ভয়টা পাচ্ছেন স্বয়ং পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া৷ ভয়ের কারণ ঘটেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে , যে ঘটনাকে ২০০১ সালে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের পর থেকে শিল্প -সংস্কৃতির জগতের উপর নেমে আসা সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ হিসেবে দেখছেন শিল্প জগতের মানুষরা৷ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় ভারতের কিংবদন্তি সেতার ও সরোদ শিল্পী উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের স্মৃতিধন্য ‘সঙ্গীতাঙ্গন ’ ভবনে হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে এই মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত বাঁশিবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া৷
গত মঙ্গলবার একটি সংঘর্ষে মাসুদুর রহমান নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণবেড়িয়া জুড়ে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে তার সহপাঠীরা৷ সেই রোষ আছড়ে পড়ে সঙ্গীতাঙ্গনের উপরেও৷ অন্তত ৩০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় হামলা চালায় সেখানে৷ ঘরগুলিতে আগুন লাগানোর পাশাপাশি ভবনে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক ভাবে মূল্যবান বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র , ছবি ও চিঠি বাইরে জড়ো জ্বালিয়ে দেয় হামলাকারীরা৷ নষ্ট হয়ে গিয়েছে উস্তাদ আলাউদ্দিনের সরোদ , চিঠিপত্র , বিরল সব ছবি , বিদেশ থেকে পাওয়া নানা উপহার -সহ বহু স্মৃতিচিহ্ন৷ গোটা ঘটনায় মোট ৬২০০ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার নিন্দা করে চৌরাসিয়া বলেছেন , ‘এটা মানবতার মৃত্যু৷ এই ধরনের ঘটনা সামাজিক কাঠামোকেই বিপর্যস্ত করে৷ কাল তো জনতা উত্তেজিত হয়ে সঙ্গীতশিল্পীদেরও আক্রমণ করতে পারে৷ ওরা আমাকেও মেরে ফেলতে পারে৷ ’ ছোটবেলায় আলাউদ্দিন খাঁয়ের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে শিক্ষাগ্রহণের সুবাদে দীর্ঘ দিন তাঁর স্নেহপূর্ণ সাহচর্য পেয়েছিলেন চৌরাসিয়া৷ তাঁর ক্ষোভ তাই বাঁধ মানেনি৷ পাশাপাশি , এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে এ পারের অন্যান্য বিশিষ্ট শিল্পীদের তরফেও৷ পণ্ডিত যশরাজের প্রতিক্রিয়া , ‘বাংলাদেশ সঙ্গীত এত ভালোবাসে৷ সেখানে এ ধরনের ঘটনা কী ভাবে ঘটতে পারে ? হামলাকারীরা কোনও ভুল পথে চালিত হয়েছে৷ কী ধ্বংস করছে , ওরা তা জানত না৷ ’ আলাউদ্দিনের নাতি এবং উস্তাদ আলি আকবর খাঁয়ের পুত্র উস্তাদ আশিস খাঁয়ের কথায় , ‘এটা লজ্জাজনক ঘটনা৷ আসলে বাংলাদেশ কখনওই দাদুকে যোগ্য সম্মান দেয়নি৷ মর্মাহত বোধ করছি৷ দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নিক বাংলাদেশ সরকার৷ ’ উস্তাদ রশিদ খান বলছেন , ‘মানুষ কী ভাবে এতটা নীচে নামতে পারে ! শিল্পীরা সব জায়গাতেই সহজ নিশানা হয়ে যাচ্ছেন৷ মৃতদের স্মৃতিকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না !’ মাসখানেকের মধ্যেই সঙ্গীতাঙ্গন যাওয়ার কথা পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের৷ তার মধ্যেই এই খবরে হতচকিত শিল্পী৷ বললেন , ‘উস্তাদ আল্লাউদিন খাঁ সাহিবের মাইহার ঘরানার শিল্পী আমি৷ তাঁর সব স্মৃতি এ ভাবে ছাই হয়ে গেছে জেনে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে৷ বামিয়ান বুদ্ধমূর্তির উপর তালিবান হানার মতোই ভয়াবহ এই ঘটনা৷ ’ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জমিদারের কাছ থেকে ওই ভবনটি উপহার পেয়েছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ৷ ফোনের ও পার থেকে সঙ্গীতাঙ্গনের ক্ষতির সম্পূর্ণ খতিয়ান দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হেলালউদ্দিন৷ তাঁর কথায় , ‘মাদ্রাসার কয়েকটা ছেলে আমাদের প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দিল৷ চারটে ঘর পুরোপুরি পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে৷ এই ঘরগুলোতে ওঁর ব্যবহূত সারেঙ্গি , পাখওয়াজ , বাঁশি , চারটি তানপুরা এবং দু’টি সেতার ছিল৷ এছাড়াও দু’টি সরোদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে , তার মধ্যে একটি উনি ব্যবহার করতেন৷ ’ শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে আগুন লাগানো নয় , হামলাকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সঙ্গীতাঙ্গনের ভিতরে রাখা সামগ্রী ধ্বংস করে বলে অভিযোগ হেলালউদ্দিনের৷ তিনি বলেন , ‘ঘরে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ওরা৷ সেখান থেকে সব বাদ্যযন্ত্র ও জিনিসপত্র বার করে এনে মাটিতে ডাঁই করে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ বাইরে শিখা দেখে ছুটে এসে দেখি এই কাণ্ড৷ তখন আর কিছু বাঁচানোর মতো অবস্থাতেই ছিল না৷ ’যা হারাল চিরতরে☛ উস্তাদ আল্লাউদ্দিন খাঁয়ের ব্যবহূত সারেঙ্গি ও পাখওয়াজ , বেশ কয়েকটি বাঁশি , দু’টি সরোদ , দু’টি সেতার , চারটি তানপুরা☛ মাইসোরের রাজার দেওয়া দু’টি কার্পেট☛ হজে যাওয়ার সময় সৌদি সরকারের দেওয়া দু’টি জায় -নামাজ , সঙ্গে তাঁর লেখা ২০টি চিঠি☛ অন্নপূর্ণা দেবী , পণ্ডিত রবিশঙ্কর (তাঁর জামাতা ) এবং উস্তাদ আলি আকবর খাঁয়ের সঙ্গে তাঁর বিরল কিছু ফোটোগ্রাফ-এটা মানবতার মৃত্যু৷
এই ধরনের ঘটনা সামাজিক কাঠামোকেই বিপর্যস্ত করে৷ কাল তো জনতা উত্তেজিত হয়ে সঙ্গীতশিল্পীদেরও আক্রমণ করতে পারে৷ ওরা আমাকেও মেরে ফেলতে পারে৷