হরর ফিল্মের মতই ভয়ানক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওয়াপদা পুকুর, গভীররাতে এখনো অনেকে শুনেন নাচ-গানের শব্দ!!
ভর দুপুরে পুকুরে নেমে লাশ হয়ে ভেসে উঠে ষোল বছরের শাকিব খান। রহস্য দানা বেঁধে উঠে তার মৃত্যু নিয়ে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী অন্যকিছু। শাকিবের মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে ১৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে। পুকুরের পাড়ের মাঠে ক্রিকেট খেলছিলো সে। বল ছিটকে গিয়ে পড়ে পানিতে। সেই বল কুড়াতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে এই কিশোর।
শাকিবের গৃহশিক্ষক আলী হোসাইন জিহাদ জানান, হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা বলেছেন তার মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোকে। তবে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই আমাকে বলেছেন, পুকুরের মাঝখানে যাওয়ার পর কোনো কিছুর টানে সে নাকি নিচের দিকে চলে গেছে। আলী হোসাইন জানান, তাকে খুঁজে পেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময় পানির নিচেই ছিল সে। এতে যে পরিমাণ পানি পেটে ঢুকার কথা তেমন কিছুই হয়নি। পানির তল থেকে ওঠানোর পর মুখ দিয়ে সামান্য একটু পানি বের হয়।
দাতিয়ারার মানুষের সবার সুর এরকমই। তারা মানতে নারাজ স্ট্রোকে মারা গেছে এই ছেলেটি। তাদের দাবি দোষী পুকুরই কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। পুকুরের গর্ভে কিছু একটা আছে। এই মৃত্যুর পর আতঙ্কে পুকুরে নামা বন্ধ করে দেন অনেকে।
১৮/১৯ বছর আগে ওয়াপদার শামীম নামে এক নৈশপ্রহরীকে পুকুরের পাড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায়। তার জামাকাপড় ছিল ভেজা। একদিন বাদেই মৃত্যু হয় তার। পুকুরটিতে চাষকরা মাছের এক পাহারাদারও ভয় পেয়েছিলেন। শহরের দাতিয়ারা এলাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের (ওয়াপদা) বৃহৎ আকারের এই পুকুর নিয়ে ভয়ভীতির গল্প অনেক দীর্ঘ। শুধু পুকুর নয় ওয়াপদার এই গোটা এলাকা দোষী বলেই জানান অনেকে। ওয়াপদার কর্মচারী বসবাসের বিল্ডিংয়ের ছাদে গভীররাতে এখনো অনেকে শুনেন নাচ-গানের শব্দ। এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে মানবজমিন।
এখানকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের অফিস ও কর্মচারীদের আবাসস্থল করার জন্য ১৯৬২ সালে দাতিয়ারায় প্রায় ২৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে প্রায় ৮ একর আয়তনের পুকুরটি খনন করে স্থাপনা নির্মাণস্থলে মাটি ভরাট করা হয়। পুরো এলাকাজুড়ে রয়েছে এখনো পুরনো অনেক গাছ। এসব গাছের ছায়ায় শীতল এলাকাটি। তবে এই গাছের দিকেই ইঙ্গিত কারো কারো। তাদের ধারণা এতেই বাসা বেঁধে আছে কোনোকিছু। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল এই ওয়াপদায়। সুরক্ষিত কয়েকটি বাংকার সেই স্মৃতি বহন করছে এখনো। এসব বাংকারে থাকতেন পাকবাহিনীর কর্মকর্তারা। বিভিন্নস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনও করা হতো এখানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র শাকিবের মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে ওয়াপদা মসজিদের ইমাম মোজাম্মেল হক বলেন, ছেলেটা মারা গেছে স্ট্রোকে। সে দু’ঘণ্টা পাড় লাগোয়া মাঠে খেলেছে। এরপর বল পানিতে পড়ে গেলে সেটি আনতে সাঁতরে পুকুরের মধ্যেখানে যায় সে। বলটি পেয়ে পুকুরের মাঝখান থেকেই ছুড়ে মারে পাড়ের দিকে। আমার ধারণা তখনই সে আঘাত পেয়েছে। এরপরই পানিতে তলিয়ে যায়। তিনি বলেন, তবে এ ঘটনার পর অনেকেই আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। আমি ২০/২৫ বছর ধরে যারা এখানে আছেন তাদের জিজ্ঞাসা করেছি। তাদের নানা জনের নানা কথা। আসলে এগুলো ঠিক না।
হাজী ইউনুছ মিয়া। বয়স সত্তর। ওয়াপদার প্রবীণ কর্মচারী। ১৯৬৭ সালে চাকরি শুরু করে অবসরে গেছেন ২০০৪ সালে। দীর্ঘসময় ওয়াপদার ভেতরেই ছিল তার বাস। তারও বিশ্বাস নিশ্চয় এখানে কিছু আছে। বলেন- তবে আল্লাহই ভালো জানেন। ছেলেটা বল আনতে সাঁতরে পুকুরের মাঝখানে গেল, বলটা হাতে নিয়ে আর ফিরতে পারলো না! ওর আপন ভাইও পুকুরের পাড়েই বসা। পানিতে তলিয়ে গেল সে চোখের সামনেই।
নৈশপ্রহরী শামীমের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রফুজা বেগমকে ওয়াপদায় চাকরি দেয়া হয়। রফুজা বলেন, আমারে অনেকদিনই বলতো তার সামনে এসে একটা মহিলা নাকি দাঁড়াইয়া থাকতো। তার বড় বড় দাঁত। আমারে আর তার মারে বলতো আমি বাঁচতাম না। ওইদিনের ঘটনার বিষয়ে সে আমাকে জানিয়েছে, পুকুরের কোনায় সে প্রস্রাব করতে বসেছিলো। ওই সময় তার ঘাড়ে কে যেন একটা থাপ্পড় মারে। কাপড়চোপড় ভেজা অবস্থায় পুকুরের কোনায় পড়ে ছিল সে। হাতের টর্চ লাইট পড়ে ছিল একদিকে। রফুজা বলেন, আমার সন্দেহ তারে পানিতে চোবাইছে। রাত দেড়টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। তাকে লোকজন বাসায় নিয়ে আসার পর আবোল-তাবোল বলতে থাকে। রোববার রাতে এই ঘটনা ঘটে। পরদিন সোমবার মারা যায় সে। ডাক্তার বলেছিল স্ট্রোকে মারা গেছে সে। রফুজার দাবি জায়গাটা ভালো না। ওই জিনিসটা আছে এখানে। বলেন পরীও আছে।
ওয়াপদার পুরাতন গেইটের পাশের বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান। ১৯৮৫ সাল থেকে এই মহল্লায় রয়েছেন। বলেন মানুষের কাছ থেকে তো কতো কিছুই শুনি। এসব বিশ্বাস হয় না।
দাতিয়ারায় বসবাস করেন এমন একজন প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, শুনেছি ১০ বছর পরপর একজন করে মারা যায়। ওয়াপদা গেইট লাগোয়া বাসা দানা মিয়ার। তিনি বলেন, ‘ধেৎ। এগুলো আজাইরা কথা। তবে বিদ্যুতের বিতরণ বিভাগের কর্মচারী তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা আগের লোকজনের কাছ থেকে শুনেছি বিল্ডিংয়ের (কর্মচারী কোয়ার্টার) ছাদে রাতে নাচ-গান হতো। তারা কারো ক্ষতি করে না। তবে নাচ-গানের এই শব্দ এখনো পান কোয়ার্টারের বাসিন্দারা। তাজুল আরো জানান, ছেলেটি মারা যাওয়ার পর এখন অনেকেই ভয়ে পুকুরে গোসল করতে আসে না।