১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ – ইতিহাসের অমর অধ্যায় -অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু
একাত্তরে ১৪ এপ্রিল সংগঠিত আশুগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবজ্জল ঘটনা। দুধর্ষ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে বীর বাঙালির বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে ছিল।
১৯৭১ এর ১৪ এপ্রিল ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১লা বৈশাখ। ঐদিন ভোর থেকেই মেঘনা নদীর পশ্চিম তীর ভৈরব থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাকিস্তানী এফ-৮৬ বোমারু বিমান থেকে আশুগঞ্জ সাইলো, পাওয়ার স্টেশন, রেলস্টেশন, লালপুর ও আশুগঞ্জ বন্দর এলাকায় বোমা হামলা চালাতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই ৬-৭টি পাকিস্তানী হেলিকপ্টার থেকে সোহাগপুর, সোনারামপুর গ্রামে ছত্রীসেনা নামাতে শুরু করে। সোহাগপুরে পাকিস্তানী হেলিকপ্টার অবতরণের সময় ঐ গ্রামের বাসিন্দা আম্বর আলী বল্লম (স্থানীয় ধারালো অস্ত্র) দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ করতে গেলে পাক সৈন্যদের ব্রাশফায়ারে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদৎবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনিই আশুগঞ্জের প্রথম শহীদ।
সোহাগপুর থেকে পাকিস্তানী কমান্ডোরা মেঘনা নদীর তীর দিয়ে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন সংলগ্ন ধানের গাল্লায় নির্বিচারের গুলি চালিয়ে রতন সিকদারসহ ৪০ জন, সোনারামপুরের ৪ জন, আশুগঞ্জ বাজারে ২ জনসহ অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে করতে আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছলে সেখানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সৈন্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জে আক্রমণের পূর্বে ভৈরবে পাকিস্তানী সৈন্যরা বিপুল পরিমাণে মরণাস্ত্রসহ বহু সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ৪ এপ্রিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ভৈরব থেকে পিছু হটে নদীর এপার আশুগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই ভৈরব মূলত পাকিস্তানীদের দখলে চলে যায়। ১৩ এপ্রিল বিকালে লালপুরে পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোট নিয়ে হামলা চালায়। আলফা কোম্পানির ৭৫ কিঃ মিঃ ট্যাংক বিধ্বংসী গোলায় শত্রুদের বেশ ক্ষতি হয়। ১৩ এপ্রিল রাতে ভৈরবে অবস্থানরত সব অবাঙালিকে ৩টি লঞ্চে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়।
১৪ এপ্রিলের ভয়াবহ যুদ্ধের পর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আশুগঞ্জ ছেড়ে পশ্চাদপসারণ করে। এরপর কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন বর্ডার দিয়ে ভারতের গিয়ে পরিপূর্ণ ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে এসে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভৌগোলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশুগঞ্জ বন্দরটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও সিলেটসহ এতদাঞ্চলে ঢুকতে পারছিল না। তাই তারা যে কোনো মূল্যে আশুগঞ্জের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রসহ তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ দখলের মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
আশুগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ : সোহাগপুর ও সোনারামপুরে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণকারী পাকিস্তানী বিপুল সংখ্যক কমান্ডোসহ কয়েকশত সৈন্য আশুগঞ্জ বাজার হয়ে রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছলে সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবলপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেঃ হেলাল মোর্শেদ খান কৌশলগত কারণে এক পর্যায়ে তাদের কোম্পানি দফতর লাল দালান ত্যাগ করে সু-উচ্চ আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থান করেন। আশুগঞ্জ রেলস্টেশনটি ভূমি থেকে ৮০-৯০ ফিট উঁচুতে হওয়ায় আশুগঞ্জ বাজার থেকে আক্রমণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিরোধ সুবিধাজনক হয়ে উঠে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা রেলস্টেশন সংলগ্ন হাজী আব্দুল জলিলের বাড়ির আশপাশ এলাকায় পৌঁছলে রেলস্টেশনে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ট্যাঙ্কে অবস্থান নিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে থাকে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। উভয়পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তখন মাত্র ৭০-৮০ গজ। পাকিস্তানী ৬টি জঙ্গী বিমান তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর অনবরত মেশিনগান ও রকেট ফায়ার চালাতে থাকে। ভৈরব থেকে পাকিস্তানী পদাতিক বাহিনীর একটি গ্রুপ তখন মেঘনা ব্রিজ দিয়ে আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে পাকিস্তানী কয়েকজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে তলিয়ে যায়। ভৈরব থেকে মেঘনা নদী দিয়ে গানবোট ও অ্যাসল্ট ক্র্যাফটের মাধ্যমে বর্তমানে আশুগঞ্জ ফেরীঘাট এলাকায় সৈন্যদের সমাবেশ ঘটায়। এদিকে জঙ্গী বিমান, ট্যাঙ্ক, কামান, হেলিকপ্টার, গানবোট, অ্যাসল্ট ক্রাফট হেভী মেশিনগানসহ বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানী সেনা, অন্যদিকে মাত্র ২টি মেশিনগান ও ছোট কয়েকটি অস্ত্রসহ এক কোম্পানি মুক্তিসেনা অসমশক্তির এ লড়াইয়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বীরবিক্রমে শত্রুদের মোকাবেলা করতে থাকে। ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেঃ হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে সেই দিন এ যুদ্ধে যারা অসিম সাহসীকতার সাথে শত্রুদের মোকাবেলা করেছিলেন তাদের মধ্যে ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, সুবেদার মাজহার, সুবেদার আঃ করিম, সুবেদার আজিজ, সিপাহী কফিল শফিকউদ্দিন, আঃ হাই ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হোসেন উল্লেখযোগ্য। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে এক পর্যায়ে বিমানের গোলায় কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ.এস.এম নাসিম ও সহকারী কমান্ডার লেঃ হেলাল মোর্শেদ গুরুতর আহত হন। অসীম সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করে শাহাদৎবরণ করেন ল্যান্স নায়েক আঃ হাই। তাঁর মেশিনগানের গুলিতে সেদিন ১৫-২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে শাহাদৎবরণ করেন সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, সৈনিক কফিল, শফিক উদ্দিন, আঃ রহমান ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল হোসেন। এ যুদ্ধে সেদিন বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন নাসিম তাঁর সৈন্যদের উইথড্র করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।
আশুগঞ্জ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর আশুগঞ্জ থেকে রেল সড়ক দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা তালশহর রেলস্টেশন পর্যন্ত তিন কিঃ মিঃ রেল সড়কের দু’পাশে যাত্রাপুর, বৈকণ্ঠপুর, বড়তল্লা ও তালশহর গ্রামের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বড়তল্লা গ্রামের মনজুর আলী ও জুরালীসহ আরো অনেককে হত্যা করে।
আশুগঞ্জে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন একই সময় লালপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেখানে পাকবাহিনী গানবোট থেকে নদীর তীরে ট্যাংক নামায় এবং হেলিকপ্টার থেকে বিপুল পরিমাণ ছত্রীসেনা নামানো হয়। আকাশ পথে বিমান হামলা চলতে থাকে অবিরতভাবে। এখানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা চর চারতলা গ্রামের মোঃ শাহজাহান শাহাদাৎবরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী লালপুর গ্রামে ঘরে ঘরে ঢুকে গণহত্যা চালায়। সেখানে হাজী মহরম আলী ও তার ছেলে শহিদুল্লাহসহ ৫৭ জনকে হত্যা করে। এদিন খোলাপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালিয়েও ৪ জনকে হত্যা করা হয়।
১৯৭১-এর ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাসে চিরদিন তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জে প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের যে সূচনা হয়েছিল তা সমাপ্ত হয়েছিল একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর সোহাগপুর যুদ্ধের মাধ্যমে। আশুগঞ্জ সোহাগপুর যুদ্ধে বিমান, ট্যাংক ও মুখোমুখি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কয়েকশত সৈন্য নিহত হয়েছিল। ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধের পর ঐ রাতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরবে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন এবং ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল।
(লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, মুক্তিযুদ্ধ এবং আশুগঞ্জ গ্রন্থের প্রণেতা ও সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ)