গণ মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তি প্রস্তরে লেখা হউক জয় বাংলা—মোঃ আব্দুল কাইয়ুম
১৯৭১ এর ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভাষণে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীর আত্মবিকাশের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে পুরো জাতি ধাপে ধাপে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল দুই দশকের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত মানসিক প্রস্তুতিরই একটি সফল উত্তরণ।
কিন্তু স্বাধীনতার জন্য আতœত্যাগে প্রস্তুত বাঙ্গালী জাতিকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বে সমর্থন লাভ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলির সাহায্য ও সহযোগিতা আদায় ও নবজাতক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়োজন ছিল আইনগত ও আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। সেই উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আহমেদ ৪ ঠা এপ্রিল ভারতের দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
অন্যদিকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেঃ কর্ণেল আঃ রব, মেজর কাজী সফিউল্লাহ, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম প্রমুখ সহ অন্যান্যরা কর্ণেল ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনার অনুরোধ জানান। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাত বন্ধের জন্য সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নির জোরালো আবেদন জানান। তার মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নূতন দুই ডিভিশন সৈন্য এনে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করার প্রাক্কালে ১০ ই এপ্রিল ১৯৭১ রাত ১০ টায় কলকাতার আকাশবাণীর সংবাদের দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে উচচারিত হলো, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের নুতন এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। ঘোষণার পর পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের স্ব কন্ঠের ঘোষণাটি কলকাতার আকাশবাণী সংবাদে প্রচার করা হল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের ভাই ও বোনেরা স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পাগল গণ মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচিছ, আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে যাদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র সূর্য, গ্রহ, তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙ্গালীর মানসপটে চির অমøান থাকবে। পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্বপালনে এক মুহুর্তের জন্য ও ভূলে গেলে চলবেনা যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে এক কথায় বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক শ্রমিক ছাত্রজনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম তাদের বিশ্বাস। স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্ন প্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জš§ নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসু হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী। যেখানে মানুষ মানুষকে শোষন করবেনা। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, ক্ষুধা-বেকারত্ব আর অজ্ঞানতা অভিশাপ থেকে মুক্তি, এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালী ভাই বোনদের সম্বলিত মনোবল ও অসীম শক্তি।
যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করেছে বাংলাদেশের মাটি। যেখানে উৎকন্ঠিত হচেছ স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ। তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। গণ মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তি প্রস্তরে লেখা হোক জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ১০ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ভাষণটি কলকাতার আকাশ বাণী থেকে প্রচার হওয়ার পর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের জয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এবং ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতি ও অনাড়ম্বর পরিবেশে মেহেরপুরের স্বাধীন বাংলাদেশের সেই প্রথম রাজধানী মুজিবনগরে পাশের গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান এর পরিচালনায় ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার অন্তর্গত ভবের পাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান শেষে তখনকার সময়ের এস ডিপি ও মাহাবুব উদ্দিন এলাহী চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদ এর সদস্যবৃন্দকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। উপস্থিত অনুষ্ঠানে আগত অতিথিবৃন্দের সাথে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে অনাড়ম্বর পরিবেশে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, আইনমন্ত্রী, আবু হেনা এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পূর্ণবাসন মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর নাম মুজিবনগর নামকরণ করা হয়। যুদ্ধাবস্থায় সরকার সেখানে যাবে সেই স্থানের নাম হবে মুজিবনগর বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডের ভবনটি মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়। এভাবেই সেদিন প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আত্মপ্রকাশ করে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে পঠিত ও অনুমোদিত হয়। অতঃপর মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ এর ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং নয় মাস মরণপণ লড়াই করে বাংলাদেশকে পাক হানাদার মুক্ত করে চূড়ান্ত জয় ছিনিয়ে আনে এবং বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তথ্য পঞ্জিঃ তাজউদ্দিন আহমদ নেতা ও পিতা , লেখক শারমিন আহমদ, বাংলাদেশের রাজনীতি ঘটনা পঞ্জি, লেখক বিচার পতি হাবিবুর রহমান।
পরিচিতিঃ লেখক ও রাজনীতিবিদ।