রাভিন্দার কৌশিকঃ দ্য ব্ল্যাক টাইগার। “RAW” এর ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিক্রেট এজেন্ট
যে তার সারাজীবন উৎসর্গ করেছিল ভারতের জন্য !
রাভিন্দর কৌশিক রাজস্থানের শ্রী গঙ্গানগরে ১১ এপ্রিল ১৯৫২ সালে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি কিশোর জীবনে থিয়েটার কর্মী হিসেবে লক্ষ্নৌতে জনপ্রিয় ছিলেন। সেখানে সে একজন “র” কর্মকর্তার নজরে পড়েন। পাকা গোয়েন্দারা জহুরীর চোখ দিয়ে হীরা চিনতে ভুল করে না। রাভিন্দার কেও চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। তাকে দেশের সেবা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। সে সানন্দেই রাজী হয়।
তাকে একজন আন্ডারকাভার এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় ট্রেনিং।
তাকে মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স-এর প্রতিটি শাখা সম্পর্কে হাতে কলমে শিখানো হয়। তাকে দিল্লীতে ঝাড়া দুই বছর ব্যাপক ট্রেনিং দেয়া হয়. সেখানে তাকে উর্দু ভাষা, পাকিস্তানের পুরো ভৌগলিক কাঠামো, পাকিস্তান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞান এবং একজন পরিপুর্ন মুসলিম হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয়। ভাবতে পারছেন একজন দাদাকে মুসলিম দেশে গোয়েন্দাগিরির জন্য কোরান থেকে শুরু করে ধর্মের প্রতিটি বুৎপত্তিগত জ্ঞান দেয়া হচ্ছে, এখানে মূল বিষয়টি হোলও যারা সেই জ্ঞান দিচ্ছে তারা কারা ? কোন ছদ্দবেশী হুজুর নয়তো ?
রাভিন্দার শুধু আরবী পড়তেই পারত না, সে এর পরিপূর্ণ অর্থ যাকে তাফসীর বলা হয় তাও পারত। যাতে কারো ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না আসে। যেহেতু সে রাজস্থানের পাঞ্জাবী পরিবার থেকে এসেছিল, তাঁর পাঞ্জাব ভাষা তাকে পাকিস্তানে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছিল, কারণ পাকিস্তানের অন্যতম ভাষা ছিল পাঞ্জাব।
সকল দরকারী প্রশিক্ষনের পর ২৩ বছর বয়সে তিনি “নবী আহমেদ শাকির” নাম ধারন করে পাকিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে মিশনে যান। রাভিন্দর কৌশিক পাকিস্তানে ১৯৭৪ সালে প্রবেশে করেন।
বরাবরের মত এসপিওনাজ জগতের নিয়ম অনুযায়ী সে পাকিস্তান প্রবেশের পর তাঁর সকল পরিচয় “র” নস্ট করে ফেলে।
শুরু হয় “নবী আহমেদ শাকির” এর নতুন জীবন। সেখানে সে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। উল্লেখ্য পাকিস্তানের বেশিরভাগ কমিশন্ড অফিসার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই তখন পাওয়া যেত।
এলএলবি পাশের পর রাভিন্দর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্থ বিভাগের একজন ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর এক সেনা ইউনিটের দর্জির কন্যা “আমানত” কে বিয়ে করেন এবং তাদের এক পুত্রসন্তান হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে সে মেজর হিসেবে পদ পায়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সক্রিয় থাকে।
সে নিয়মিত ভারতীয় ডিফেন্স কে পাকিস্তানের বিভিন্ন গোপন কার্যক্রম এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তথ্য পাচার করত. ১৯৮০ সালে যখন পাকিস্তান ভারতের বিপক্ষে একটি শক্ত যুদ্ধ শুরু করার প্রকল্প হাতে নেয়, তখন তাঁর পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী চমৎকার এক সমর কৌশল তৈরী করে। রাভিন্দার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমন একটা পজিশনে ছিল যাকে বলা হয়ে থাকে “সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়”, তাঁর কারণে সেবার কমপক্ষে তাঁর দেশের ২০০০০ হাজার সেনা সদস্য প্রানে বেঁচে যায়। চিন্তা করতে পারেন সংখ্যাটা ! এভাবেই চলছিল তার আন্ডার কাভার তৎপরতা।
সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা একজন নিম্ন স্তরের অপারেটিভ, ইনিয়াত মাসিহ নামে একজঙ্কে কৌশিকের সাথে যোগাযোগের জন্য “সিস্টেমে” পাঠায়। কিন্তু তার ভুলের কারণে সেই এজেন্ট পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা ধৃত হয় এবং তাকে টর্চারের সময় সে রাভিন্দরের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে দেয়।
এখানে লক্ষনীয় দুটি বিষয়, তার কাভার তার নিজের কোন কারণে প্রস্ফুটিত হয়নি, বরঞ্চ ইন্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের ভুলের কারণে প্রকাশিত হয়েছিল। আর কোন সিক্রেট এজেন্ট কে আগে টর্চার কিভাবে সহ্য করতে হয় তা শিখানো হয়। বেশিরভাগ সিক্রেট এজেন্টের একটি দাঁত থাকে না, দাতের ফাকে সায়ানাইড ক্যাপসুল সমৃদ্ধ একটি নকল দাঁত লাগানো থাকে, যাতে টর্চার সহ্য করতে না পারলে তা দাঁত দিয়ে চেপে ভেঙ্গে মৃত্যুবরণ করা যায়।
এই ধরনের হাস্যকর ভুল এই ধরনের “হাইলি ক্ল্যাসিফায়েড” মিশনে কেউ করবে না, যা “র” করেছিল।
এরপর শুরু হয় রাভিন্দারের উপর মারাত্মক নির্যাতন। তাকে শিয়ালকোটে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে দুই বছর ধরে নির্যাতন করা হয়। তাকে কোর্ট মার্শালে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে।
কৌশিক শিয়ালকোট, কোট লাখপাত এবং মিয়ানওয়ালি জেলে ১৬ বছর ধরে ছিল, যেখানে সে হাঁপানি এবং টিবি সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, এছাড়া সে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। এরপর ২৬ জুলাই ১৯৯৯, মুলতানের কেন্দ্রীয় কারাগারের হৃদরোগ মারা যায়., সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
তার পরিবার এই খবর শোনার সাথে সাথে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু বরাবরের মত রাভিন্দারকে চিনতে কেউ অস্বীকার করে, কারণ পুর্বেই আপনাদের বলেছি তার সকল ডকুমেন্ট পুড়িয়ে নস্ট করা হয়।
ইন্ডিয়ান সরকারের “ভ্রান্ত” নীতি অনুযায়ী কোন আন্ডার কাভার এজেন্ট কোথাও ধরা পড়লে তাকে স্বীকৃতি না দেয়ার নিয়ম।
মৃত্যুর পুর্বে সে গোপনে ভারতে তাঁর পরিবারকে চিঠি দেয়, এবং তার প্রকৃত অবস্থা জানায়। সেখানে তার সাথে যে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে তার বিবরণ থাকে। সেই চিঠিতে সে লিখে “ক্যায়া ভারত য্যায়ছে বাড়ে দেশকে লিয়ে কোরবানী দেনে ওয়ালো কা এহি মিলতা হ্যায়” অর্থাৎ ভারতের মত বড় দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারীর কি এই পুরস্কার ?
এভাবেই সমাপ্ত হয় শতাব্দীর অন্যতম সেরা একজন এসপিওনাজ এজেন্টের জীবন। ঐ যে আপনারা “এক থা টাইগার” নামে একটি বলিঊডি সিনেমা দেখেছিলেন মনে আছে, তা রাভিন্দারের জীবন কে কেন্দ্র করে।
তার মৃত্যুর পর ভারতীয় মিডিয়া সরকারকে তুলোধুনো করে ছাড়ে।
কি কেমন লাগল আপনাদের ?