রমজানের ‘কমন’ ভুল……..
রোজা রাখা কিন্তু ইবাদাত না করাঃ
আমাদের অনেকে রোজা রাখি, কিন্তু নামাজ পড়িনা।
এটা আমাদের অনেকের প্রধানতম সমস্যা।কিন্তু আমরা বুঝতেই পারিনা যে, ইবাদাতবিহীন রোজা কেবলই উপোস থাকার শামিল।
রমজান মাস হোলো ইবাদাতের মাস।এ মাস পরবর্তী ১১ মাসের জন্য নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাস।এ মাসের সারমর্মই হোলো ‘ইবাদাত’।
কিন্তু আমরা অনেকে রোজা রাখি, নামাজ পড়িনা।
‘তাদেরকে (হাশরের মাঠে) জিজ্ঞেস করা হবে,- ‘কিসে তোমাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করলো?
তারা বলবে,- ‘আমরা নামাজীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।’ (Quran 74: 42-43)
রমজানকে ‘অনুষ্ঠান সর্বস্ব’ মাস হিসেবে নেওয়াঃ
রমজান মাসকে আমরা যতোটা না স্প্রিচুয়্যালি নিই, তার থেকে বেশি নিই রিচ্যুয়্যালি।
রমজানে আমরা অনেকে রোজা রাখি জাষ্ট আমাদের চারপাশে অন্যান্যরা রোজা রাখে,তাই।
‘পাশের বাসার লোকজন যখন দিনের বেলা আহার পরিত্যাগ করে রোজা রাখছে, তখন আমরা কিভাবে দিনের বেলা খাই?’ – এই ইন্টেনশান থেকেই অনেকে রোজা রাখি। মুসলমান হিসেবে একটা যে ‘ষ্ট্যাটাস’ আছে, সেটা খুঁইয়ে ফেলার ভয়েও অনেকে রোজা রাখি।
কিন্তু এতে তো আমাদের রোজা হয়ই না, উল্টো পাপের বোঝা বাড়াই।
সেহেরি মিস করলে রোজা হবেনা ভেবে রোজা না রাখাঃ
রমজান মাসে এটি একটি বড় ধরনের ভুল।ভুলটা আমরা অনেকেই করি।
দেখা যায়, ঠিক সময়ে ঘুম থেকে জাগতে না পেরে আমরা সেহেরি মিস করে ফেলি আর ভাবি, সেহেরি খেতে না পারলে হয়তো রোজা রাখা যায়না।এটা ভুল।সেহেরি খাওয়া সুন্নত, ফরজ নয়।
আপনি যে রাতে ঘুমানোর আগে সেহেরি খেয়ে রোজা রাখার নিয়্যাত করেছেন, এটাই যথেষ্ট।
সেহেরি মিস হলেও আপনি রোজা রাখতে পারবেন।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অত্যাধিক বাড়াবাড়িঃ
রমজান মাসে দিনের বেলা আমাদের অর্ধেকের বেশি সময় চলে যায় খাবারের পেছনে।
ইফতারে কতো নতুনত্ব আইটেম করা যাবে, এগুলো কিনে আনতে আর রান্না করতে করতেই সময় চলে যায়।অথচ, রমজান মাসের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মিনিট, সেকেন্ড খুবই গুরুত্ববহ। এই সময়গুলো কোরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ, তসবি,দরূদ পাঠ ইত্যাদিতে ব্যয় করা উচিত।
বেশি খাওয়াঃ
অনেকের ধারনা, সেহেরিতে এত বেশি পরিমান খেতে হবে যে, যাতে দিনের বেলা ক্ষিধা কম লাগে কিংবা ক্ষিধা অনুভব না হয়।
এটা খুবই হাস্যকর। এতে তো রমজানের মেইন ইণ্টেনশান নষ্ট হয়ই, সাথে, এতে করে ইবাদাতেও আলসেমি চলে আসে।
সেহেরি কিংবা ইফতারে অত্যধিক পরিমাণ খাওয়ার পর একজন মানুষের ইবাদাতে সহজেই অনীহা চলে আসবে। শরীর বিছানা চাইবে।ক্লান্তি অনুভব হবে।ঘুম আসবে।তারাবি এবং ফজর মিস হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
‘ইফতার পার্টি’ নাম দিয়ে পার্টি করাঃ
রমজান মাসে একজন-অন্যজনকে ইফতার করানো অবশ্যই কল্যাণকর এবং ভালো। কিন্তু এটাকে গতানুগতিক ‘পার্টি’ বানিয়ে হৈ-হুল্লোড় করা, ছেলে-মেয়ে একসাথে হয়ে যাওয়া সম্পূর্ন হারাম। এতে কোন কল্যাণ নেই এবং এটি ইসলামের কোন রীতি-রেওয়াজের মধ্যে পড়েনা।
পার্টি দিতে গিয়ে দেখা যায় মাগরিব সালাতটাই মিস হয়ে যায়।
সারাদিন ঘুমানোঃ
রমজান মাসে অনেকেই ক্ষিধার তাড়না থেকে বাঁচতে কিংবা কোনরকমে দিনটা পার করে দিতে পুরোদিন ঘুমায়।
এটা কি রমজান মাসের উদ্দেশ্য? এতে করে রোজা রাখা হয় নাকি উপোস থাকা হয়?
আল্লাহ তা’লা কি আমরা কতক্ষন না খেয়ে থাকছি সেটা দেখার জন্যে রমজান মাসে রোজা ফরজ করেছেন? নাকি কিভাবে পার করছি সেটা দেখার জন্যে?
কাজ/পরীক্ষার কারনে রোজা ছেড়ে দেওয়াঃ
অনেক পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকগণ এই ভুলটা করে থাকে।পরীক্ষার জন্য রোজা ছেড়ে দেয়।এটার অনুমতি ইসলামে নেই।
যত কঠিন পরীক্ষা কিংবা কাজই থাকুক, শারীরিক ভাবে সুস্থ এবং উপযুক্ত (যার উপরে রোজা ফরজ হয়েছে) ব্যক্তি মাত্রই রোজা রাখতে বাধ্য।কোন ছাড় নেই।মনে রাখতে হবে, রমজান মাসে রোজা রাখাটা শ্বাস-নিশ্বাস নেওয়ার মতোই ফরজ।
ধূমপানঃ
ধূমপান সহ সকল প্রকার তামাক জাতীয় দ্রব্যই ইসলামি শরীয়াহ মতো হারাম।
আমাদের অনেকেই ইফতারের পরে একনাগাড়ে ২-৩ টা সিগারেট টেনে কোনরকমে কুলি করে মাগরিব পড়তে দাঁড়াই, অথবা, পুরোদিন খাওয়া যাবেনা বলে সেহেরির পর একনাগাড়ে ৪-৫ টা সিগারেট খাই। এরপর কোনরকমে অজূ করে নামাজে দাঁড়াই।এতে করে মুখ থেকে সিগারেটের দূর্গন্ধ যায়না।ফলে ইবাদাত নষ্ট হয়।
দেরি করে ইফতার করাঃ
এটা একটা কমন ভুল রমজানে।অনেকেই যতক্ষন পর্যন্ত আজান না শোনা যাচ্ছে বা শেষ না হচ্ছে, ততক্ষন পর্যন্ত ইফতার করেনা।
এটা ভুল। ইফতারের সময় হয়ে গেলেই ইফতার করে নেওয়া যায়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, – ‘তারা উন্নতি করতে থাকবে, যারা ইফতারে বিলম্ব করবেনা।'(বুখারি, ১৯৫৭)
দোয়া কবুলের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করাঃ
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, – ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয়না।
১/ একজন পিতার দোয়া।
২/ একজন রোজাদারের দোয়া।
৩/ একজন সফরকারীর দোয়া।- (আল বায়হাক্বী)
ইফতারের পূর্ব মূহুর্তটি হচ্ছে দোয়া কবুলের একটি সুবর্ণ মূহুর্ত।এই সময় যে দোয়া করা হয়, তাই-ই কবুল হয়।
কিন্তু আপসোস! আমরা অধিকাংশই এই সময়টা নষ্ট করি চমুচা ভাজতে, ছোলা-মুড়ি ভাজতে।টেবিল সাজাতে কিংবা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে।
তারাবীহ এর রাকাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করাঃ
বস্তুতপক্ষে তারাবীর সালাতের নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নেই।কেউ ইচ্ছে করলে আট রাকাত পড়তে পারে, কেউ ২০ রাকাত পড়তে পারে,অথবা কেউ ১০০ রাকাতও পড়তে পারে।ধরা-বাধা নেই।এটা নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করা কেবলই মূর্খামির শামিল।
কেবল ২৭ শে রমজানে লাই লা’তুল ক্ব’দর তালাশ করাঃ
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা এই কমন ভুলটা সব’চে বেশি করে থাকে।
তারা ধরেই নেয় যে, লাই লা’তুল ক্ব’দর ২৭ শে রমাজান দিবাগত রাতেই হয়ে থাকে।
অথচ, এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) থেকে প্রমানিত একটি হাদীসই নেই।
রাসুল (সাঃ) শেষ দশ রমজানের বিজোড় রাতগুলোতে ক্ব’দরের রাত তালাশ করতে বলেছেন।তিনিও রমজানের শেষ দশ রাত্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশি বেশি রাত জাগতেন আর ইবাদাত করতেন।
স্পেশেফিক ২৭ শে রমজানকে ঘিরে আমাদের দেশে ইবাদাতের যে রেওয়াজ প্রচলিত, তা বি’দাত।
শপিংয়ের ফাঁদে ক্ব’দর মিসঃ
রমজানের শেষ দশ রাতে বাঙালি মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে মেয়েরা, শপিং নিয়ে এতটাই ব্যতি-ব্যস্ত হয় যে, ক্বাদর তো দূর, ফরজ নামাজগুলোও শপিংমল গুলোতে চলে যায়।
ঠিক যে কারনে রমজানের আগমন, তা ব্যাহত হয়।
আমরা চেষ্টা করবো এই ভুলগুলো কাটিয়ে পুরো রমজান মাসটিকে কাজে লাগাতে।