ইতিহাসের ভয়াল শোকাবহ দিন
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। বিডিআর বিদ্রোহের নামে ২০০৯ সালের এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকষ অফিসারকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে বিডিআর’র (বর্তমান বিজিবি) তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও ছিলেন। ডিজির স্ত্রীসহ সামরিক-বেসামরিক আরও ১৭ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ওইদিন। যে শোক বইবার সাধ্য কারো নেই।
ঘৃন্যতম ওই ঘটনায় মোট নিহত হন ৭৪ জন। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে ওই দিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। এখনো বিচারাধীন রয়েছে অস্ত্র মামলার। কিন্তু মানুষ সেই দিনের নির্মমতা ভুলতে পারছেন না। সেই বিভৎসদৃশ্য চোখে ভেসে উঠতেই আঁতকে উঠছে মানুষ। এখনো বাতাস ভারী হয়ে আছে স্বজনহারাদের কান্নায়।
শুধু হত্যা করেই নরপশুরা খ্যান্ত হয়নি। সেনা অফিসারদের স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মাকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায় তারা। তাদের বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়ে ফেলে উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী জওয়ানরা। হত্যার আলামত নষ্ট করতে প্রথমে তাদের লাশগুলো পুড়ে ফেলার চেষ্টা করে তারা। ব্যর্থ হয়ে লাশগুলো মাটিচাপা এবং ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।
উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা অস্ত্রাগার লুট করে তাই দিয়ে সেনা অফিসারদের হত্যা করে। নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত হচ্ছে আজ। নৃশংস এই ঘটনার পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। বিদ্রোহের এই মামলার রায় শেষ হয়েছে। অভিযুক্তদের অনেকে ইতোমধ্যে সাজাভোগ করে বের হয়ে গেছে। নিম্ন আদালতে হত্যাকাণ্ডেরও বিচার সম্পন্ন হয়েছে গত বছরের ৫ নভেম্বর।
বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন ঢাকার পিলখানায়। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মাঝে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিলো। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহী মঈন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সাথে সাথে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি আপনাদের দাবি দাওয়া শুনবো।” কিন্তু মুহুর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়।
এক পর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাতারি গুলি শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে জওয়ানরা হত্যা করে। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে বিডিআর জওয়ানরা। এর সবই করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙ্গে অস্ত্র এবং ম্যাগজিন ভেঙ্গে গুলি তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতঙ্কে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি।
বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ড মাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মাইকে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র সমর্পন করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআর’র ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাত করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এরপরও তারা অস্ত্র সমর্পন ও বন্দিদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুনের সাথে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পন শুরু করে। কিন্তু পরদিনও থেমে থেমে গুলির শব্দ আসতে থাকে।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন , “পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্র সমর্পন করেছে।”
এদিকে, ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ উদ্ধার। একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৫টি লাশ। এভাবে মোট উদ্ধার হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তা ও সামরিক-বেসামরিকসহ মোট ৭৪ জনের লাশ।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। নিম্ন আদালতে হত্যা মামলারও বিচার শেষ হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছরের ৬ এপ্রিল নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ১২ ও ২৭ জুলাই বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টুসহ ৮২৪ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দুটি চার্জশীট দাখিল করে সিআইডি। এদের মধ্যে বিডিআরের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত বেসামরিক আসামি ছিলেন ৪০ জন।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি এ দুটি চার্জশিট আমলে নেন আদালত। ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য ছিল। ওইদিন সরকার পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে ৩ মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করেন এবং এরমধ্যে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ২১ মার্চ এই মামলায় আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। গত বছরের ৫ নভেম্বর এই মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন হয় বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ আদালতে। এতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আর খালাস দেয়া হয় ২৭১ জনকে। ৮৫০ জন আসামির মধ্যে চারজন বিচার শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে, বিদ্রোহের পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। ৫৭টি মামলায় মোট আসামি ছয় হাজার ৪১ জন। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সদর ব্যাটালিয়নের বিচার কার্যের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের বিচার শেষ হয়। আসামিদের মধ্যে মোট পাঁচ হাজার ৯২৫ জনের শাস্তি হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ১১৫ জন জওয়ান। অব্যাহতি পেয়েছে পাঁচজন। অব্যাহতি প্রাপ্তরা বিচার চলাকালীন সময়ে মারা গেছেন। মোট ১১টি আদালতে বিদ্রোহের বিচার চলে। ঢাকায় ছিলো মোট ১১টি মামলা। ঢাকায় আসামি সংখ্যা ছিলো চার হাজার ৮৯ জন। এর মধ্যে সাজা হয়েছে চার হাজার ৩৩ জনের। মামলাগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৪ অক্টোবর প্রথম বিচার শুরু হয় রাঙামাটির ১২ রাইফেল ব্যাটালিয়ন রাজনগরের ৯ জনের বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে ২০১০ সালের ২ মে এই মামলার প্রত্যেক আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। বিদ্রোহের মামলার প্রথম রায় হয় পঞ্চগড়ের ২৫ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহের ঘটনায়। রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বদল করা হয় তাদের পোশাক। হত্যার বিচার, বিদ্রোহের বিচার সবই হয়েছে। সেই বিভৎস হত্যকাণ্ডের দিনটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।