বাংলাদেশি দোসরদের জন্য এখনও এত দরদ পাকিস্তানীদের!
ডেস্ক ২৪ : মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের মানুষের নজর কেড়েছিলেন দেশটির সাংবাদিক হামিদ মীর। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে তাঁর বাবাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ। পুরস্কার নিতে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কথা বলে গেছেন হামিদ মীর। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধে গোলাম আযমকে সাজা দেয়ার সমালোচনায় এখন মুখর তিনি। শুধু হামিদ মীর নয়, গোলাম আযমদের জন্য সহানুভূতি দেখাচ্ছে পাকিস্তান সরকারও। তার সাজা নিয়ে কথা হয়েছে দেশটির মন্ত্রিপরিষদেও। সাজার বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেছে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম দোসর গোলাম আযমকে ফাঁসির বদলে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয়ায় গোটা বাংলাদেশ যখন ফুঁসছে, তখন এই সাজার পরও পাকিস্তান সরকারের চুপ থাকার সমালোচনা করছেন হামিদ মীর। গোলাম আযমকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর মত দিয়েছেন এই সাংবাদিক। দেশটির দৈনিক জং পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় তিনি এসব বিষয় উল্লেখ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ দেশের মানুষকে হত্যা, নির্যাতনের হেন পরিকল্পনা নেই যা করেননি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম। কেবল পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হননি এই চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী নেতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে বৈঠকের পর বৈঠক করে এসব কূট পরিকল্পনা বাস্তবায়নও নিশ্চিত করেছেন। রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠনেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আর এসবের তথ্য-প্রমাণ সবই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অথচ হামিদ মীর বলছেন,গোলাম আযমকে সাজা দেয়া অন্যায়। এই ঘটনায় পাকিস্তান সরকার কেন কিছু বলেনি, সে জন্য নিজ দেশের সরকারেরও সমালোচনা করেছেন তিনি। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা টাইমসকে বলেন, হামির মীর যেসব বলেছে তা খুবই অন্যায়। এই সাংবাদিকের আচরণ একজন সক্রিয় জামায়াতকর্মীর মতো আচরণ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, কেবল ১৯৭১ সাল নয়, জামায়াত এখনও পাকিস্তানের পক্ষেই কাজ করছে। আর এ জন্য পাকিস্তানও জামায়াতকে নানা সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছে। হামিদ মীর একাত্তরের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিলেও এখন তার আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু ঢাকা টাইমসকে বলেন, পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদেও গোলাম আযমের রায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গোলাম আযমের সাজাকে মন্ত্রিপরিষদের একাধিক সদস্য সমর্থন করেছেন। হামিদ মীর নিজেই এ সংবাদ লিখেছেন। কিন্তু তার পর তিনি গোলাম আযমের সাফাই গেয়ে নিবন্ধ লিখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করেছেন। তবে তাদের এসব মন্তব্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কোনো প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না। হামির মীর যা লিখেছেন: ‘৯০ বছরের এক বৃদ্ধের ট্রাজেডি’ শিরোনামে ওই লেখায় হামিদ মীর অবশ্য স্বীকার করেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি আজও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝুলে আছে’। গোলাম আযমের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে হামিদ মীর বলেন, ‘৯০ বছরের বৃদ্ধ গোলাম আযমকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। আমাদের শুধু একজন গোলাম আযম নয়, ওই লাখো বীরদের কথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতা করেছেন এবং আজও ঢাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ে আছেন।’ পাকিস্তানী দোসরদের বীর বলে উল্লেখ করে ওই সাংবাদিক বলেন, শাসকদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত শুধু ৯০ বছরের গোলাম আযমই নয়, কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত ভুগতে হয়। আমরা কিছুটা ভুগেছি, আরো ভোগান্তি বাকি আছে।’ হামিদ মীর দাবি করেন, গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত সেনা অভিযানের প্রতিবাদ জানান। হামিদ মীর বলেন, ‘পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর গোলাম আযম বৃটেন চলে যান। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়। ২০০০ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে সাজা দেন।’ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ‘তামাশার বস্তু’ বানিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন হামিদ মীর।’ গোলাম আযমের সাজা নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক: কেবল এক হামিদ মীর নয়, গোলাম আযমের জন্য সমবেদনা ঝড়ছে পাকিস্তান সরকারের। এই সাংবাদিক লিখেন, ‘গত সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারের উচ্চতর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও গোলাম আযমের হয়ে কথা বলেছেন। ওই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বললেন, গোলাম আযম পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছেন। সুতরাং পাকিস্তান সরকারের উচিত তার সঙ্গে করা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, গোলাম আযম সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কারণ ওই যুদ্ধ ছিল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী একটি দলের বিরুদ্ধে। আর ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল পাকিস্তান। ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আরেক মন্ত্রী গোলাম আযমকে সাহায্য করার পক্ষে মত দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ হতে দেননি।’ গোলাম আযম যা করেছেন ১৯৭১ সালে: উনিশো একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত। হাজারো বা লাখো বাঙালিকে হত্যা করে স্বাধীনতার স্বপ্ন থামিয়ে দেবে, এই নির্মম পরিকল্পনার প্রথম রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী চালায় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। নিজ দেশবাসী আক্রান্ত। কিন্তু গোলাম আযম দাঁড়িয়ে গেলেন আক্রমণকারীদের পক্ষে। রেডিওতে ভাষণ দিয়ে আহ্বান জানান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়াতে। এখানেই থেমে থাকলেন না গোলাম আযম। এ দেশের অলিগলি না চেনা ভিনদেশী বাহিনীকে আর কী কী ভাবে সহায়তা করা যায়, তা বের করতে বৈঠক করেন সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে। সঙ্গে নিলেন মুসলিম লীগ, পিডিবি, নেজামে ইসলাম পার্টির নেতাদের। গঠন করলেন তথাকথিত শান্তি কমিটি। এই কমিটির একুশ সদস্যের কার্যকরী কমিটির একজন হিসেবে গণহত্যার পরিকল্পনা চালিয়ে যান পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সে সময়ের আমির। মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের বিরুদ্ধে কূটকৌশলে কেবল এ দেশে নয়, গোলাম আযম উড়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। একাধিকবার দেখা করলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। মুক্তিকামী জনতাকে মোকাবেলায় রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তবে ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের আগে আগেই পাকিস্তানে পালিয়ে যান গোলাম আযম। আর মক্তিযুদ্ধের পর তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন বছর পর ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসেন। পরে আর ফিরে যাননি তিনি। |