মুক্তিযুদ্ধ : বৃটেনের দ্য টাইমসের নতি স্বীকার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত তা স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য টাইমস’। উল্লেখ্য, টাইমস এর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্রের স্পেকট্রাম নামক বিভাগে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবির ক্যাপশন বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত একজন স্বামী কলেরা আক্রান্ত তার স্ত্রীকে কোলে নিয়ে তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে হাসপাতাল যাচ্ছেন- ‘ক্যাজিওলটিজ অব ওয়ার’ শিরোনামে প্রকাশিত এই ছবিটির ক্যাপশনে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধের স্থলে ‘গৃহযুদ্ধ’ উল্লেখ করা হলে ব্রিটেনে বসবাসরত তরুণ ব্রিটিশ বাঙালিদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফটোগ্রাফার ডন ম্যাককুলিনের তোলা এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবিটি ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দ্য টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল।
টাইমসের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্য সানডে টাইমসে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রের ম্যাগাজিনে অন্য আরো কিছু ঐতিহাসিক ছবির সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের এই ছবিটিও প্রকাশ করা হয়। ক্রোড়পত্রের এই বিশেষ ম্যাগাজিনটি পাঠকদের মধ্যে ‘পেছন ফিরে দেখার’ ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করলেও বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ আখ্যায়িত করায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে তরুণ ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের মাঝে। ব্রিটেনে বসবাসরত তরুণ বস্নগার নিঝুম মজুমদার ফেইস বুকের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ইতিহাস বিকৃতির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ৫ ফেব্রুয়ারিই ফেইস বুকে তিনি লিখেন, ‘বৃটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দি টাইমস’ আজকে তাদের ৫০ বছর পূর্তিতে বিশেষ কিছু ক্রোড়পত্র বের করে, যেগুলোর মধ্যে একটি ম্যাগাজিন ছিল। এই ম্যাগাজিনের ৫০ নাম্বার পাতায় ‘ংঢ়বপঃৎঁস’ নামক একটি সেকশানে ওরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি হৃদয়বিদারক ছবি প্রকাশ করে “ঈধংঁধষরঃবং ড়ভ ডধৎ” শিরোনামে।
ছবিটি তৎকালীন সময়ে ডন ম্যাককুলিন নামে এক ফটোগ্রাফার তোলেন। সব কিছুই ঠিক হতো যদি না টাইমস আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘সিভিল ওয়ার’ হিসেবে ট্যাগ না করত। এই পত্রিকা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ পড়ে এবং এই ছবির ক্যাপশনে যখন সিভিল ওয়ার শব্দ দু’টি থাকবে তখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ মিথ্যাভাবে প্রকাশিত হবে। আমি ফেসবুকে আমার সব বন্ধুদের বিনীত অনুরোধ করছি যে, তারা যেন দয়া করে এই ব্যাপারটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে টাইমসকে একটি ইমেইল করেন। আপনারা দয়া করে টাইমসকে ই-মেইলে বলবেন, এই এতবড় মিথ্যা তথ্যের জন্য তাদের রুমা চাইতে হবে। আমরা যদি সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি, তাহলে এই মিথ্যাকে সবাই ভ্যালিড ও গ্রান্টেড মনে করে নেবে। প্লিজ আপনারা দুইটা মিনিট ব্যয় করে টাইমসকে আপনাদের অভিযোগের কথা জানান’।
বস্নগার নিঝুম মজুমদারের এই আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেকেই টাইমসের কাছে তাদের প্রতিবাদ পাঠাতে থাকেন। নিঝুম নিজেও একটি কড়া প্রতিবাদ পাঠান দ্য টাইমসে। শেষ পর্যন্ত টাইমস কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল স্বীকার করে। ১০ ফেব্রুয়ারি নিঝুমের প্রতিবাদ পত্রের উত্তর দেন টাইমস এর লেটার এডিটর পেরিন জানমোহামেদ। নিঝুমকে তিনি লিখেন, ‘আমাদের স্পেকট্রাম ম্যাগাজিনের ছবি ক্যাপশনের বিষয়ে আপনার পাঠানো নোটের জন্যে ধন্যবাদ
আসলে গৃহযুদ্ধের স্থলে স্বাধীনতা যুদ্ধ শব্দটি ব্যবহারই ছিল উপযুক্ত। এই যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল’। বিষয়টি নজরে আনার জন্যে নিঝুমকে ধন্যবাদ জানিয়ে টাইমস কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘আমরা এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, সাচি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিতব্য টাইমসের এক্সিবিশনেই এটি আমরা সংশোধন করে নেব’। এছাড়া নিঝুমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরো যারা এ বিষয়ে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিলেন তাদেরও অনেকে টাইমস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একই নিশ্চয়তা পেয়েছেন বলে জানা গেছে।