ডেস্ক ২৪ঃনদীপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে নবীনগর উপজেলার মেঘনার তীরে গোলাম আযমের নিজগ্রাম বীরগাঁও। ১৯২২ সালের ৭ই নভেম্বর ঢাকার পুরনো অংশে লক্ষ্মীবাজার এলাকায় নানার বাড়িতে তার জন্ম হয় । স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে এ গ্রামেই থাকতেন গোলাম আযম। বর্তমানে এ বাড়িতে দু’একটি পরিত্যক্ত টিনের ঘর ছাড়া কিছুই নেই। নিকট আত্মীয় বলতেও কেউই নেই। সোমবার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দেয়া রায় সম্পর্কে নিজ গ্রামের সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। মুখ খুলতে চান না কেউ। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বীরগাও গ্রামের আইনজীবি বশির আহমেদ খান এবং সাংবাদিক জহির রায়হান বলেন, সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হবে এমনটিই আশা করেছিলাম। তবে কারাদণ্ড হওয়ায় আমরা আশাহত হয়েছি। আমরা মনে করি, আপীলের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হবে। কর্মজীবন: গোলাম আযম ১৯৫১ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ছাত্র আনিসুল হক ( রংপুরের অন্য একটি কলেজের সাবেক শিক্ষক।) বলেছেন, শিক্ষক থাকার সময় গোলাম আযম ক্লাসের বাহিরে ছাত্রদের তেমন সম্পর্ক রাখতেন না। এমনকি তখন রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে বক্তব্য তুলে ধরতেন। তাবলীগ জামাত থেকে রাজনীতিতে: তবে শিক্ষকতা করার সময় এক পর্যায়ে গোলাম আযম, সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন ১৯৫৪ সালে। আর ১৯৫৬ সালে চাকরি ছেড়ে জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেন। গোলাম আযম প্রথমে তমুদ্দন মজলিশের সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরে তাবলীগ জামাতে সক্রিয় হয়েছিলেন। অবশ্য জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ সম্পাদক হয়ে মূল নেতৃত্বে এসেছিলেন। গোলাম আযম প্রথম, জামায়াতের আমির হয়েছিলেন ৬৯ সালে। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম ৭১এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ২২ শে নভেম্বর ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান যান। ১৯৭৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে তিনি ঢাকায় আসেন। পরে তিনি আর ফিরে যাননি। স্বাধীন বাংলাদেশে গোলাম আযম ১৯৮১ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসেন। প্রায় এক দশক পর ৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর যখন গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করা হয়। এরপর তখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। সেই আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা শাহরিয়ার কবির বলেন, “৯২ সালের ২৬শে মার্চ গণআদালত করে গোলাম আযমসহ কয়েকজনের প্রতীকী বিচারও করা হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন, “৭১ সালে গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে গোলাম আযম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে দেখা করে সেই গণহত্যার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাদের সহযোগিতা করার জন্য মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টির সাথে মিলে গোলাম আযম প্রথমে শান্তি কমিটি গঠন করে মিছিল সমাবেশ করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় জামায়াতে ইসলামী সরাসরি আলবদর এবং রাজাকার নামে দু’টি বাহিনী গঠন করেছিল।” আন্দোলনের মুখে নাগরিকত্বের প্রশ্নে গোলাম আযমকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ৯১’র নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বেশি আসন পেলেও সরকার গঠনের জন্য অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। আর সমর্থনের বিনিময়ে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এক অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়। আব্দুল্লাহ-হিল আমান আযমী বলেছেন, “এ সমঝোতা বা অনুকূল পরিবেশের সুযোগ নিয়েই জামায়াত গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয়ে ৯২ সালে মার্চ মাসে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করেছিল। সেই গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিক হয়ে দেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।” আযমী আরও জানিয়েছেন, নাগরিকত্বের প্রশ্নে হাইকোর্টে জামায়াত রিট মামলা করে এর পক্ষে রায় পেয়েছিল।কিন্তু তখন সরকার হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গিয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টে আপিল বিভাগ থেকে নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে ১৬ মাস জেল খাটার পর গোলাম বেরিয়ে এসেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে গোপনে এবং প্রকাশ্যে জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালন করে গোলাম আযম অবসরে যান ২০০০ সালে। ৯১ বছর বয়সে এসে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হয়ে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন। এর পর সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্যাইব্যুনাল তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা |