জুয়ার জন্য চোখের জল, ধূয়ে দিক অপরাধ প্রবণতা —- আল আমীন শাহীন



ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্র টি.এ. রোডে শত শত মানুষের জটলা। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ উৎসুক জনতা। টি এ রোড এবং কাজীপাড়ার প্রবেশ দ্বারের কাছেই কাজী মাহমুদ শাহ রোডে দাঁড়িয়ে আছে একাধিক পুলিশ ভ্যান, কারাগারে আসামী বহনের বড় একটি প্রিজন ভ্যান অপেক্ষায়। জানা গেল, টিভিতে খেলা দেখে অভিনব জুয়া খেলার অভিযোগে ৩৩ জন আটক হয়েছে এখানে। আটকৃতদের জেলে নিতেই এই গাড়ীর জটলা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত কাজী মাহমুদ শাহ রোডে ছিল মানুষের ভীর। দেখা গেল ,ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল রেজাউল কবীর, সদর মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্য নবীর হোসেন সহ পুলিশ দল ঘিরে রেখেছে জুয়ার আড্ডাস্থল। পুলিশ আটক করেছে ৩৩ জন জুয়ারীকে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে টেলিভিশনে আইপিএল খেলা দেখে রানে বলে উইকেট নিয়ে এই জুয়া খেলা হচ্ছিল
। লক্ষ লক্ষ টাকার জুয়া খেলা হতো এখানে। আটকের সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকাও উদ্ধার করেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে জুয়ারীদের। এদিকে জুয়ারী আটকের ঘটনাটি তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে পড়ে শহরে। জানাজানি হয় সকল মহলে। খবর পেয়ে উৎসাহী জনতা ভীর করেছে এ স্থানে। জুয়ার আড্ডাটি বসতো একটি হোটেলের ছদ্মাবরণে। আড্ডায় একটি টিভি আর কিছু চেয়ার টেবিল।আড্ডায় সাংবাদিকরা যখনই ক্যামেরা তাক করছিল আটক জুয়ারীরা তখন পরিচয় লুকাতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে বারবার। নানাবয়সী জুয়ারী একসাথে , কারো চোখে মুখে লজ্জাও নেই।
ঘটনার খবর পেয়ে এসে জনতার ভীরে এক সময় শোনা গেল, কান্নার গোঙ্গানী। বোরকা পরিহিত এক বৃদ্ধ মা কাঁদছে পুত্রের জন্য। আশপাশের মানুষকে আকুতি মিনতি করছে পুত্রকে ছাড়াবার চেষ্টায়। তার চোখের পানি পড়ছে জুয়ার আ্ড্ডা স্থলের কাছেই। পাশেই এক শিশুর কান্না তার বাবা আটক হয়েছে এই ঘটনায়। বেশ কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে জটলায় তাদের স্বামীও রয়েছে ৩৩ জনের মাঝে। হন্তদন্ত হয়ে এক মহিলা আর শিশুকে আসতে দেখেই তাদের কান্না আর বিলাপে দৃষ্টি পড়লো সকলের। তাদের আসার দৃশ্যটিকে দেখছে সবাই। দোষীর আত্মীয় স্বজন তারা
, স্বজন প্রীতিতে তারা জুয়ার আড্ডা স্থলে জনতার ভীরে এসেছে। দোষ না করেও তাদের চোখে মুখে, কষ্ট বেদনা আর লজ্জায় ভরা। একজনের অপরাধ গোটা পরিবারকে যেন অপরাধী করেছে। জুয়া খেলতে এসে আটক হয়েছে পুত্র স্বামী আর বাবা, অন্যদিকে বিনাদোষে কাঁদছে মা স্ত্রী সন্তান। খবর নিয়ে জানা গেছে যারা আটক হয়েছে তাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ী কর্মজীবি। সারাদিন পরিশ্রম করে যা আয় করে তা নিয়ে বসেছে জুয়ার আড্ডায়। কারো কারো প্রতিদিনের অভ্যেস এখানে আসার। সারাদিনের কষ্টের আয় এই জুয়া খেলায় দিয়ে অনেকেই বাড়ি ফেরেন শূন্য হাতে। , জুয়ায় স্বর্বশান্ত হয়ে জুয়ার নেশায় নানা অপরাধ করে অনেকে। ঘরের নানা জিনিষপত্র বিক্রি করে এই আড্ডার টাকার জোগার করে অনেকে। আড্ডাটি দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে ছিল ক্ষোভ। জুয়ার আড্ডায় পুলিশের এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন। কেউ কেউ রসাল মন্তব্য করে বলেছে “ ৩৩ ব্যাটা পড়ছে ধরা , হাতে তাদের হাতকড়া, জুয়া খেলার কি মজা , ৩ দিনের হয়েছে সাজা। ”
এক সময় ৩৩ জুয়ারীকে তোলা হলো ভ্যানে, প্রিজন ভ্যানের সর্তক সংকেত আর পুলিশের বাঁশি শোনা গেল রাস্তা খালি করার জন্য। রাস্তার পাশে জনতার ভীরে দাঁড়িয়ে তখনও সেই বোরকা পড়া মহিলা, জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীগণ, কোমল মতি শিশুরা। তারা দেখছে তাদের পুত্র কিংবা স্বামী, বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলে। তাদের চোখের জলে ভিজছে জুয়া আড্ডার পাশের রাস্তা। প্রিজন ভ্যান চলে যাওয়ার পর সকলের দৃষ্টি কান্নারত স্বজনদের দিকে। মাথা নীচু করে তারা তখনও কাঁদছে। এই কান্নার দৃশ্য দেখেনি আটককৃতরা। এই দৃশ্য দেখে মনে প্রশ্ন জেগেছে ,জনতার ভীরে লজ্ঝায় অবনত হয়ে চোখের জল ফেলা কত কষ্টের তা কি অনুভব হবে আটক হওয়া অপরাধীদের? পরিবারের একজন অপরাধী এবং দোষী হলে পরিবারের অন্য সকলের মাঝে এবং আত্মীয় স্বজনের মাঝে এর প্রভাব পড়ে এবং পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজনকে যে লজ্জিত হতে হয় সেই উপলব্ধী কি তারা করতে পারবে ? জনতার ভীরে ফেলা চোখের জল কি তাদের মনের অপরাধ প্রবণাতে ধূূেয় দিতে পারবে ?
শখে শখে লোভের বশবর্তী হয়ে অবৈধ আয় যে কত বিপদ জনক, লজ্জাকর বিষয় এর একটি দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। ৩৩ জনের প্রত্যেককে ৩ দিন করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা । সংশোধনের জন্যই এই দন্ড। যাদের ভাগ্যে জুটেছে আশা করা যাচ্ছে এই দন্ডের পর তারা সংশোধন হয়ে সুন্দর জীবনে জুয়া মুক্ত ফিরে আসবে। জেলা পুলিশের এই অভিযান দৃষ্টান্ত হবে সকলের মাঝে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে এমনই অভিযান অব্যাহত থাকবে। আর জুয়ার আড্ডার পাশে অপরাধীদের আত্মীয় স্বজনদের লজ্জায় অবনত চোখের জল উপলব্ধ হয়ে শুদ্ধ করবে সকল অপরাধীদের এই প্রত্যাশাই সকলের।
———————————————————————-
লেখক : সিনিয়র সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব,সম্পাদক নতুন মাত্রা।