Main Menu

ভূমিকম্পে ভুল !

+100%-

হারুন উর রশীদ॥

শনিবার দুপুরে ভূমিকম্পের সময় আমি ছিলাম রাস্তায়। রিকশা নিয়ে কলাবাগান বসিরউদ্দিন রোডের বাসা থেকে ইস্কাটনের অফিসে যাচ্ছিলাম। গলিতে মানুষের জটলা দেখে নির্বাচনের ভিড় মনে হলেও তাদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা আমাকে কিছুটা ভাবিয়ে তোলে। ঘটনা জানতে কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাব ঠিক তখনই আমার স্ত্রী রিংকুর ফোন। আমি হ্যালো বলতেই তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ভূমিকম্প। আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাসার বাইরের রাস্তায় নেমে গেছি। তুমি কোথায়? অফিসে থাকলে বাইরে বের হও।’

আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আমার জন্য নয়, স্ত্রী সন্তানদের জন্য। তাকে শুধু বললাম, তুমি বাইরে বের হয়েছো কেন? এসময়তো ঘরে থাকাই নিয়ম, বেশি নিরাপদ। এরপর ফোন কেটে গেল। ফিরতি ফোন করে বললাম বাইরে যখন বের হয়েছোই তখন খোলা কোনও জায়গা বা মাঠে চলে যাও। পারলে কলাবাগান মাঠে যাও।

ততক্ষণে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প থেমে গেছে। আমি অফিসে আসার পথে বাংলামোটরে দেখলাম রাস্তায় শত শত মানুষ। আর তখনও অনেকই পড়িমড়ি করে রাস্তায় বের হয়ে আসছিলেন।

অফিসে এসে দেখলাম ফেসবুকে আরেক ভূমিকম্প। কে কিভাবে ১০ তলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছেন। কে আগেই লিফটে নামতে পেরেছেন। কতটা ভয় পেয়েছেন তার বর্ণনা। ছবিও আছে অনেক। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছেন তার ছবি। কেউ কেউ আবার ভূমিকম্পের সময় সেলফিও তুলেছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম সব ছবি, যে ভবন থেকে তারা বের হয়েছেন তার সামনে। মানে তারা প্রাণভয়ে ভবন ছেড়ে বের হলেও সেই ভবনের সামনেই আবার তারা জটলা করেন। অফিসে আসার পথেও রাস্তায় তাই দেখেছি।

রবিবার দুপুরে আরেক দফা ভূমিকম্পের সময়ও একই অবস্থা, সবাই ভবন ছেড়ে বাইরে ছুটেছেন। একজন সাংবাদিক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন কীভাবে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামা যায় তার কৌশল জানিয়ে। আরেকজন বলেছেন আজ (রবিবার) প্রথমেই তিনি লিফটে উঠতে পেরেছেন (আল্লাহ সহায়)।

আমি আমার পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি এ নিয়ে। প্রশ্ন করেছি তারা কেন ভূমিকম্পের সময় ভবন ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় বের হলেন? এটাই কি ভূমিকম্পের সময় প্রাণ বাঁচাতে করণীয় কী না? তারা ঠিক জবাব দিতে পারলেন না। বললেন সবাই বের হয়েছেন তাই তারাও বের হয়েছেন।

এই সবাই কারা? তাদের ব্যাপারে জানি না। তবে এটা জানি যে মাইকে ঘোষণা দিয়েও ভবন ছেড়ে বের হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আর আমার স্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, তার আত্মীয়রা তাকে ফোন করে রাস্তায় বের হতে বলেছেন।

ভবনের মধ্যে শক্ত কোনও কিছু যেমন টেবিল, খাট অথবা লোহার কোনও ফার্নিচারের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। দরজা খুলে তার ফাঁকেও আশ্রয় নেয় যায়। যাতে উপরের কিছু ভেঙে পড়লে মাথাসহ শরীরকে রক্ষার একটা উপায় থাকে।

আমি আর অন্যকে কী বলব। নিজের ঘরেই সচেতন করতে পারলাম না! অথচ এই আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনে ভূমিকম্পের সময় করণীয় নিয়ে অন্তত অর্ধশত প্রতিবেদন করেছি। একুশে টেলিভিশনের অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান ‘একুশের চোখে’-এ ২২ মিনিট করে মোট দু’টি পর্ব বানিয়ে তা প্রচার করেছি অন্তত ২০ বার। কিন্তু সবই ব্যর্থ!

আমি বিষেশজ্ঞ নই। তবে আমি বাংলাদেশের শীর্ষ ভূমিকম্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করেছি বার বার, পেশার কারণেই। আর শনিবার ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্পের সময় মানুষের এই ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসা নিয়ে কথা বলেছি ইএনডিপির প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামালের সঙ্গে। তিনিও সাধারণ মানুষের এই অসচেতনতায় কষ্ট পেয়েছেন।

এটা সারা বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের কথা যে ভূমিকম্পের সময় ভবন ছেড়ে বের হয়ে আসা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কেউ যদি কোনও ভবনে থাকেন সে বহুতল ভবনই হোক না কেন তিনি সেখানেই অবস্থান করবেন। তবে এই অবস্থানের জন্য কিছু কৌশল নিতে হবে। ভবনের মধ্যে শক্ত কোনও কিছু যেমন টেবিল, খাট অথবা লোহার কোনও ফার্নিচারের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। দরজা খুলে তার ফাঁকেও আশ্রয় নেওয়া যায়। যাতে উপরের কিছু ভেঙে পড়লে মাথাসহ শরীরকে রক্ষার একটা উপায় থাকে। আর এটা সম্ভব না হলে মাথার উপর শক্ত কিছু দিয়ে আড়াল করার নিয়ম। এমন কিছুর নিচে আশ্রয় নেওয়া ভাল যেটা মাথায় নিয়ে প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন করা যায়। আর ভূকম্পন টের পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুৎ-গ্যাস লাইন বন্ধ করে দিতে হবে।

চেষ্টা করতে হবে ভবনের পিলার ও বিম যেখানে মিশেছে সেখানে আশ্রয় নেওয়ার। কারণ ছাদ ভেঙে পড়লেও পিলার ও বিমের সংযোগস্থলে ধংসস্তূপের মধ্যেও ফাঁকা জায়গা থাকে। একে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলেন- ‘লাইফ ট্রায়াঙ্গেল’। সব কিছু ভেঙে পড়লেও এই ফাঁকা জায়গায় যারা অবস্থান নেন তারা বেঁচে থাকেন। পরে উদ্ধারকারীরা উদ্ধার করতে পারেন। বড় বড় ভূমিকম্পের ঘটনায় এটার প্রমাণ মিলেছে। এমনকি রানা প্লাজা ধসের পরও যারা ভাগ্যক্রমে ‘লাইফ ট্রায়াঙ্গেলে’ ছিলেন তাদের বড় একটি অংশ বেঁচে যান। রানা প্লাজার এই কথা আমার নয়। যারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন তাদের কথা।

এখন প্রশ্ন বাইরে বের হলে ঝুঁকি কেন? প্রথম, নামার জন্য লিফট ব্যবহার করলে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কারণ লিফট ভূমিকম্পে আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা ভবনের বিদ্যুৎ চালু থাকলে শর্ট সার্কিট হতে পারে। আর সিঁড়ি দিয়ে সবাই একযোগে নামলে পদদলিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যা শনিবার সাভারে আল মুসলিম গার্মেন্টস-এ হয়েছে।

বড় কথা হল এটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নয় যে বাইরে আগুন নেই। ভূমিকম্প সর্বব্যাপ্ত। রাস্তায় নানা স্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে এলাকা বিদ্যুতায়িত হতে পারে। গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। গাছপালা ভেঙে পড়তে পারে। আর সহজ করে বললে কোনও ভবন বা স্থাপনা ভেঙে পড়লে তা রাস্তাতেই পড়বে।

তাই ভূকম্পনের সময় ভবনে থাকলে ভবনের মধ্যেই যতটা সম্ভব নিরাপদভাবে খাকতে হবে। ভূমিকম্প শেষ হয়ে গেলে দেখেশুনে দ্রুত বাইরে বের হতে হবে। তবে তখনও রাস্তায় অবস্থান নয়। খোলা কোনও জায়গা বা খোলা মাঠে যেতে হবে। যার আশপাশে বড় কোনও স্থাপনা নেই।

আর যদি ভূমিকম্পের মাত্রা বেশি হয় তাহলে খোলা মাঠেই অবস্থান করতে হবে। কারণ সাধারণ নিয়মে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পর তুলনামূল ছোট মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প হয়। যাকে বলে আফটার শক। এটা এবার নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে পরিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশে শনিবার দুপুরের পর আরেক দফা এবং রবিবার আরেকটি ভূকিম্প হল। যদিও এর তীব্রতা শনিবারের ৭ দশমিক ৯ মাত্রার চেয়ে অনেক কম।

ভূমিকম্পের সময় যারা বাইরে থাকবেন তারা কী করবেন? যারা গাড়িতে থাকবেন তারা গাড়ি বন্ধ করে গাড়িতেই বসে থাকবেন। আর কম্পন শেষ হয়ে গেলে তারাও দ্রুত খোলা জায়গায় চলে যাবেন। যারা পথচারী, রিকশা যাত্রী তারাও দ্রুত যার যার অবস্থান থেকে ভবন বা বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকবেন। কম্পন শেষ হলে খোলা জায়গায় চলে যাবেন। এই কথাগুলোর সঙ্গে আমেরিকান রেডক্রস-এর নির্দেশনা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়, এটা এখন প্রায় সবার জানা। আর এই অঞ্চলে তীব্র ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে।

১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে যে ভূমিকম্প হয়েছিল (আনুমানিক ৭ থেকে ৮ মাত্রার) তা ইতিহাসে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামে ১৭৬২ সালে চট্টগ্রাম-আরাকান সীমান্তে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৩ জন নিহত হয়েছিল। এ ছাড়া ১৮৯৭ এবং ১৯৫০ সালে আসামে যে দু’টো বিশাল ভূমিকম্প হয়েছিল, তা ছিল সিলেট সীমান্ত থেকে খুব কাছেই।

ভূতাত্ত্বিকরা বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের খুব কাছে ডাউকি ফল্ট এবং ইউরেশিয়া-ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলের অবস্থান হওয়ায় এ অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যার প্রমাণ মিলছে বার বার। এবারে শনিবারের ভূমিকম্পের মাত্র ৭ দশমিক ৯, যা ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’-এর চেয়েও বেশি। তবে কেন্দ্র বাংলাদেশ থেকে দূরে নেপালে থাকায় শক অনেক কম হয়েছে। এ কারণে এবার বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র যদি ঢাকা বা আশপাশে হতো তাহলে ঢাকার ৭০ ভাগ ভবন কোনও না কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত। ৩০ ভাগ মাটির সঙ্গে মিশে যেত।

এরজন্য প্রস্ততি প্রয়োজন সরকারের। কিন্তু আমরা নিজেরা যেটা পারি তা হল, ভূমিকম্পের সময় প্রাণ বাঁচাতে করণীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া। জাপান তার শিশুদের স্কুলেই শেখায় ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে তা। এখন বিশ্বের অনেক দেশই স্কুলের পাঠ্য বইয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় কী তা অন্তর্ভূক্ত করেছে। আছে নানা কর্মসূচি।

এটা আমাদের এখানে থাকলে হয়তো ভূমিকম্পের সময় আমরা তাড়াহুড়ো করে ভবন থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে দেখতাম না। দেখতাম কম্পন শেষ হওয়ার পর সবাই সাবধানে বেরিয়ে আসছেন ভবন থেকে। ইউটিউবে এ নিয়ে অনেক ভিডিও প্রোগ্রাম আছে। অনলাইনে আছে অনেক লেখা।

লেখক: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত






Shares