ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ইতিবৃত্ত
সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম আমাদের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার শিরোনামে এসেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) Institute of Information and Communication Technology (IICT)-এর পরিচালক প্রফেসর ড. এস এম লুত্ফুল কবীরের তত্ত্বাবধানে ইভিএম তৈরি করা হয়েছে। মূলত সংসদ নির্বাচন ইভিএম পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলেও ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এই পদ্ধতি ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা প্রচার করছে নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে সাধারণত স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং কাগজের ব্যালট ব্যবহৃত হয়। কাগজের ব্যালটে সিল মেরে ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ইভিএম ব্যবস্থায় ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীর নাম এবং প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট প্রদান করবেন।
প্রচলিত পেপার ব্যালট পদ্ধতি ছাড়াও পাঞ্চ কার্ড, অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং সিস্টেম, ইভিএম ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশে ভোটগ্রহণ করা হয়। পাঞ্চ কার্ড পদ্ধতিতে পছন্দের প্রার্থীর নাম এবং প্রতীকের পাশে নির্দিষ্ট স্থানে ব্যালট পেপার পাঞ্চ বা ছিদ্র করা হয় যা ভোট শেষ হলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং সিস্টেমে বিভিন্ন প্রার্থীর ভোট চিহ্নিত পেপার ব্যালট অপটিক্যাল স্ক্যানার দ্বারা গণনা করা হয়। উল্লেখ্য, প্রচলিত পেপার ব্যালট, পাঞ্চ কার্ড, অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং সিস্টেম এবং ইভিএম ভোট কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারসোনাল কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে রিমোট ই-ভোটিং পদ্ধতিও চালু আছে।
এবার ইভিএম ব্যবস্থার আলোচনায় আসা যাক। ইভিএম ব্যবস্থার সার্বিক মূল্যায়ন দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা সমীচীন হবে। এগুলো হচ্ছে, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা। প্রথমেই ইভিএম প্রযুক্তির দিকে আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ইভিএমে দুটি ইউনিট রয়েছে—ব্যালট ইউনিট ও কন্ট্রোল ইউনিট। ইউনিট দুটি তারের মাধ্যমে সংযুক্ত এবং ব্যাটারিচালিত। বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রের দায়িত্বে একজন প্রিসাইডিং অফিসার থাকেন। প্রিসাইডিং অফিসারের অধীনে থাকেন কয়েকজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার যারা নির্বাচন কেন্দ্রের একেকটি কক্ষে ভোটগ্রহণ পরিচালনা করে থাকেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে কাগজের ব্যালটের ক্ষেত্রে একটি ভোটিং কক্ষে এক বা একাধিক বুথ থাকলেও প্রস্তাবিত ইভিএম ব্যবস্থায় একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের অধীনে একটি ভোটিং কক্ষে শুধু একটি ব্যালট ইউনিট এবং একটি কন্ট্রোল ইউনিট থাকবে। ব্যালট ইউনিটটি থাকবে পর্দায় ঘেরা পোলিং বুথের ভেতরে। ব্যালট ইউনিটে প্রতিটি প্রার্থীর নামের পাশে প্রতীক ছাপানো থাকবে। প্রতিটি প্রার্থীর নাম এবং প্রতীকের পাশে থাকবে একটি করে সুইচ। ভোটার পোলিং বুথে প্রবেশ করে ব্যালট ইউনিটের নিচে ‘ভোট দিন’ লেখার পাশে সবুজ বাতি জ্বলতে দেখবে। ভোটারের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকের পাশে সুইচে চাপ দিলে ব্যালট ইউনিটের নিচে ‘ভোট সম্পন্ন’ লেখার পাশে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। ভোটারের ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ভোটের তথ্য ইভিএম তার মেমোরিতে নিয়ে নেবে।
ইভিএমের মাধ্যমে যেভাবে ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে তা নিম্নরূপ। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট থাকবে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে। কন্ট্রোল ইউনিটের উপরাংশে পাঁচটি সুইচ রয়েছে। এছাড়া কন্ট্রোল ইউনিটে ব্যবহারের জন্য রয়েছে একটি স্মার্ট কার্ড এবং একটি মাস্টার কার্ড। ভোট শুরুর আগে ইভিএম Demo Mode বা পরীক্ষামূলক মোডে থাকবে। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নির্বাচনের দিন ভোট শুরুর আগে বিভিন্ন প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিতে পরীক্ষামূলক ভোটের আয়োজন করবেন। প্রথমে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার স্মার্ট কার্ডটি কন্ট্রোল ইউনিটের নির্দিষ্ট স্থানে ঢোকাবেন। পোলিং এজেন্টরা তাদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন প্রার্থীকে ভোট দেবেন। কোন প্রার্থীকে কত ভোট দেয়া হলো তা লিখে রাখতে হবে। পরীক্ষামূলক ভোট প্রদান শেষ হলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের Demo Result সুইচ (চতুর্থ সুইচ) চেপে একে একে সব প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট দেখাবেন। প্রদানকৃত ভোট এবং Demo Result থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রার্থীর ভোট অভিন্ন হলে মেশিনটি অনুষ্ঠিতব্য প্রকৃত ভোটের জন্য উপযোগী বলে ধরে নেয়া হবে। প্রকৃত ভোট গ্রহণ শুরু করার আগে কন্ট্রোল ইউনিটের Memory Clear (তৃতীয় সুইচ) সুইচ চেপে পরীক্ষামূলকভাবে নেয়া সব ভোট মুছে ফেলা হবে।
প্রকৃত ভোট শুরু করার জন্য প্রিসাইডিং অফিসার নির্দিষ্ট স্থানে মাস্টার কার্ড ঢুকিয়ে Start (প্রথম সুইচ) সুইচে চাপ দেবেন। অতঃপর তিনি মাস্টার কার্ড বের করে নিলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার স্মার্ট কার্ড মেশিনে ঢোকালে আসল ভোট প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। কন্ট্রোল ইউনিটের নিচের অংশে ব্যালট নামক একটি সুইচ রয়েছে। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ব্যালট সুইচটি চাপ দিলে কন্ট্রোল ইউনিট এবং ব্যালট ইউনিটের ‘ভোট দিন’ বাতিটি জ্বলে উঠবে। ‘ব্যালট’ সুইচটি চাপ দেয়ার আগে ব্যালট ইউনিটটি ভোট দেয়ার জন্য কার্যকর থাকে না। ভোটার পছন্দের প্রার্থীর সুইচ টিপে ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল ইউনিট এবং ব্যালট ইউনিটের ‘ভোট সম্পন্ন’ বাতিটি জ্বলে উঠবে। ভোটদানের পর ভোটার পোলিং বুথ থেকে বের হয়ে গেলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার পুনরায় কন্ট্রোল ইউনিটের ‘ব্যালট’ সুইচ চেপে পরবর্তী ভোটারের জন্য ব্যালট ইউনিট চালু করবেন।
ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের Close (দ্বিতীয় সুইচ) সুইচটি চেপে ভোটগ্রহণ সমাপ্ত করবেন। অতঃপর সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার Final Result (পঞ্চম সুইচ) সুইচটিতে একবার চাপ দিলে প্রথম প্রার্থীর প্রতীক এবং তার প্রাপ্ত ভোট কন্ট্রোল ইউনিটের ডিসপ্লেতে দেখা যাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে Final Result সুইচটি চেপে অন্যান্য প্রার্থীর প্রতীক এবং প্রাপ্ত ভোট একে একে ডিসপ্লেতে দেখা যাবে। অতঃপর সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট ফরমে লিখে প্রিসাইডিং অফিসারকে দেবেন যা রিটার্নিং অফিসারকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। ব্যাটারিচালিত ইভিএম একটানা ১২ ঘণ্টা চলতে পারে। ব্যালট ইউনিট বা কন্ট্রোল ইউনিট বিকল হলেও প্রতিস্থাপন করা যায়।
ভোটিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তার মধ্যে নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবার ইভিএমের প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
ক্স ইভিএম পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিসরে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে শুধু ভারত এবং ব্রাজিলে সব জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভেনিজুয়েলায় বড় পরিসরে এর ব্যবহার রয়েছে। হল্যান্ডে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার থাকলেও এর বেশকিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় বর্তমানে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য, পৃথিবীতে দেশের সংখ্যার বিচারে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সীমিত এবং উন্নত বিশ্বের একটি দেশেও জাতীয় নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএম পদ্ধতি এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ক্স আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইভিএম ব্যবস্থাটি বুয়েটের IICT-এর গবেষণার ফসল। ইভিএম ব্যবহার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী সে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ইভিএম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এবং বুয়েটের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মালিকানাধীন Bangladesh Machine Tools Factory-তে সংযোজন করার কথা শোনা যাচ্ছে। সংযোজনের পর মেশিনগুলো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে আনুমানিক ভোটকেন্দ্র এবং পোলিং বুথের সংখ্যা যথাক্রমে চল্লিশ হাজার এবং দুই লাখ। প্রতিটি পোলিং বুথে যদি দুইটি ইভিএম (একটি অতিরিক্ত) থাকে তাহলে আনুমানিক মোট ইভিএমের সংখ্যা দাঁড়ায় চার লাখ। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংরক্ষণ থেকে শুরু করে দেশের চল্লিশ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রেরণের পুরো প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে যায়।
ক্স প্রতিটি ইভিএমে একটি প্রোগ্রাম থাকে যা একজন ভোটার কোনো প্রার্থীকে ভোট দিলে প্রার্থীর মোট ভোটের সঙ্গে এক ভোট যোগ হয়ে যাবে। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের ভেতর One Time Programmable (OTP) চিপ থাকবে যার মধ্যে প্রোগ্রামটি ঢোকানো হবে। একবার প্রোগ্রাম করা হলে চিপটিতে আবার নতুন কোনো প্রোগ্রাম ঢোকানো যায় না। কোনো মহলের প্ররোচনায় যদি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার অগোচরে প্রোগ্রামটি পরিবর্তন করেন তাহলে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট কারও পক্ষে বিষয়টি বোঝা সম্ভব নয়। ধরা যাক, নির্বাচনে দুজন প্রার্থী ‘ক’ এবং ‘খ’। দশজন ভোটারের পাঁচজন ‘ক’কে আর পাঁচজন ‘খ’কে ভোটদান করলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সব মহলের অগোচরে কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি/মহল যদি চিপটিতে এমন পরিবর্তন আনয়ন করেন যে ‘ক’-এর প্রতিটি পঞ্চম ভোট ‘খ’-এর মোট প্রাপ্ত ভোটে যোগ হবে, তাহলে কন্ট্রোল ইউনিটের ডিসপ্লেটি ‘ক’-এর চার আর ‘খ’-এর ছয় ভোট দেখাবে। এছাড়া এমনভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব যে, ইভিএম প্রথম ত্রিশ মিনিট সঠিকভাবে প্রতি প্রার্থীর পক্ষে ভোট যোগ করতে থাকবে কিন্তু ত্রিশ মিনিটের পর থেকে ভুলভাবে গণনা করবে।
ক্স ইভিএমে প্রক্রিয়ার শুরু থেকে মাঠ পর্যায়ে অর্থাত্ ভোটকেন্দ্রে আসা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে সঠিক প্রোগ্রামের পরিবর্তে ভুল প্রোগ্রামযুক্ত চিপ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। পাশাপাশি দুটি ইভিএমের একটিতে সঠিক প্রোগ্রাম এবং অপরটিতে ভুল প্রোগ্রাম থাকলেও বাহ্যিকভাবে দুটিকে অভিন্ন মনে হবে। অন্যদিকে গতানুগতিক স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ক্ষেত্রে কাগজ, ছাপানো, কালি ইত্যাদির ব্যয় এবং ভোট গণনার সংশ্লিষ্ট লোকবলের জন্য ব্যয় হলেও ইভিএম ব্যবস্থার মতো প্রতিটি স্তরে (যেমন, প্রোগ্রাম তৈরি, চিপে প্রোগ্রাম ঢোকানো, ইভিএম নির্বাচন কমিশনে নেয়া, নির্বাচন কমিশনে সংরক্ষণ, ভোটকেন্দ্রে প্রেরণ ইত্যাদি) নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজন হয় না। ভোটগ্রহণের আগে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স খালি থাকলেই ওই সময় পর্যন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। যে ইভিএম Bangladesh Machine Tools Factory-তে প্রস্তুত হয়েছে সেই মেশিনটিই নির্বাচন কমিশনে এসে পৌঁছালো কি না আর নির্বাচন কমিশনে পৌঁছানো ইভিএম ভোটকেন্দ্রে পৌঁছালো কি না তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যায়।
ক্স এছাড়া ব্লুটুথ বা অন্য যে কোনো ট্রান্সমিটার স্থাপনের মাধ্যমে ইভিএমে ভোটারদের প্রকৃত ভোট পরিবর্তন করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে প্রথমে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে ব্লুটুথ বা ট্রান্সমিটার স্থাপন করতে হবে। দূর থেকে কোনো প্রকার ব্লুটুথ বা ট্রান্সমিটার ছাড়াও ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। যেমন ভ্যান এক ফ্রিকিং (Van Eck Phreaking) পদ্ধতিতে চল্লিশ মিটার দূর থেকেও ইভিএমকে প্রভাবিত করা যায়। হল্যান্ডের কম্পিউটার গবেষক ভিম ভ্যান এক (Wim Van Eck) ১৯৮৫ সালে এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ইভিএম পদ্ধতিতে কন্ট্রোল ইউনিটের ডিসপ্লেতে ভোটের ফলাফল দেখা যায়। এই ডিসপ্লেতে আমরা যা দেখি তা এক ধরনের ভিডিও ইমেজ। ভোটের তথ্য এক ধরনের অসিলেটিং ইলেকট্রিক কারেন্ট তৈরি করে যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) রেঞ্জের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনে রূপান্তরিত হয়। এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনই ডিসপ্লেতে ভিডিও ইমেজ সৃষ্টি করে। সুতরাং বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে এই হাইফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনকে প্রভাবিত করে ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত ভোটের ফলাফল দূর থেকে জানা যায় এবং ফলাফল পরিবর্তন করাও সম্ভব। ভ্যান এক ফ্রিকিং পদ্ধতি প্রকাশের পর ইভিএম আর হল্যান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ক্স ইভিএম পদ্ধতিটি ব্যবহারের দিক থেকে একটি সহজ পদ্ধতি যার মাধ্যমে দ্রুত ভোট গণনা করা যায়, কিন্তু ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা করার কোনো সুযোগ নেই এবং বিভিন্ন ধরনের হ্যাকিং পদ্ধতির কাছে ইভিএম পদ্ধতি বিভিন্ন সময়ে দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতের নির্বাচন কমিশন এদেশের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে বিধায় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কতটা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা নিয়ে অনেক সংশয় আছে। প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে দীর্ঘদিন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করাও সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির সর্ববৃহত্ দুটি দলের যে কোনো একটি নির্বাচনে, বিশেষত সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থায় সম্মতি না দিলে বাস্তবিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থার ব্যবহার কতটা কার্যকর হতে পারে তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।