শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন বাদল (পিএসসি)
প্রাণ দেব তবু মান দেব না…… অথবা সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা । এই স্লোগান বুকে ধারণ করেই জাতির মহান আত্মত্যাগী সন্তানরা যে বাহিনীর পতাকা তলে নিজেকে সোপে দেন এবং দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে তাঁদের মেধা, শ্রম, শিক্ষা-দিক্ষায় তিলে তিলে গড়ে তুলে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে, যাঁরা অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দেশ ও মাটিকে মায়ের অদলে ভালবেসে প্রাণ বিসর্জন দিতেও দ্বির্ধাবোধ করে না। তাঁদের একজন জাতির সূর্য্য সন্তান শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পিএসসি । দেশপ্রেমিক একজন সেনা অফিসার ছিলেন তিনি। দেশের প্রতি অগাত ভালবাসার আছে বলেই এ বাহিনীতে তাঁর যোগদান। শৃঙ্খলা, আস্থা-বিশ্বাস নীতি-আদর্শে অবিচল থেকে সব সময় এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সুনাম গৌরব উজ্জ্বল করেছে ।
শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পিএসসি । ১৯৬০ সালে ১৪ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আশুগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস খ্যাত শিক্ষার রাজধানী নাওঘাট গ্রামে এক মুসলিম সম্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন তিনি । বাবা কাজী জসিম উদ্দিন ছিলেন বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার । পেশাগত জীবনের প্রথম দিক তার কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্থানে পেশোরায় হওয়া সেখানে তিনি স্বপরিবার নিয়ে চলে যান । বাবা-মার আদরে সন্তান কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন কে পেশোরায় ক্যান্টারমেন্টে একটি নামি স্কুলে ভূর্তি করে দেয়া হয় । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাবা কাজী জসিম উদ্দিনসহ দেশ প্রেমিক বাঙালী অফিসারা পাকিস্তান সরকারের কঁড়া নজর বন্দিতে আটকে পড়েন । ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই পরিবারটি বাংলাদেশে চলে আসে । ১৯৭৫ সালে কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পশ্চিম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন । ১৯৮০ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউ থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন হন । ১৯৮৩ সালে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন এবং ১৯৯৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যাল থেকে এম.ডি.এস বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন । শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পিএসসি ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন । ১৯৮৩ সালে ২৩শে ডিসেম্বরে তিনি ৯ম বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে সাফল্যের সাথে কোর অব সিগন্যালস এ কমিশন লাভ করেন । ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলস-এ যোগদান করেন এবং ৩৭ রাইফেলস ব্যাটালিয়নে অধিনায়ক হিসেবে বলিপাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত হন । ১৬ই আগস্ট ২০০৮ সালে কর্ণেল পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন এবং এইদিন থেকেই সেক্টর কমান্ডার, রাঙ্গামাটি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন । শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পিএসসি ‘র চাকুরি জীবনে তিনি ১, ২, ৩ ও ১০ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন; এস টি এস, আর্মি সিগন্যাল ব্রিগেড, ডিজিএফআই ও সেনাসদর পিএস পরিদপ্তর ও বিডিআর -এর ৩৭ রাইফেল ব্যাটালিয়নে বিভিন্ন নিযুক্তিতে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ সহায়তা মিশন (UNAMIR)-এ সামরিক পর্যবেক্ষক এবং কঙ্গোতে জাতিসংঘ মিশন (MONUC)-এ অধিনায়ক, ফোর্স ব্যানএমপি -১ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । সর্বশেষ তিনি বিডিআর-এর সেক্টর কমান্ডার, (রাঙ্গামাটি) পদে নিয়োজিত ছিলেন । রুয়ান্ডা ও কঙ্গো ছাড়াও তিনি কেনিয়া, সৌদী আরব, থাইল্যান্ড, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে, উগান্ডা ও জাম্বিয়া সফর করেন । একজন আত্মপ্রত্যায়ী সৎ দক্ষ, পরিশ্রমী, কর্মনিষ্ঠা সাহসি ও বিচক্ষণ সেনা অফিসার হিসেবে শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (বাদল) পিএসসি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজ কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব জন্য দুই দু বার পুরষ্কার অর্জন করেন । এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে বহু পদক ও সম্মাননা গ্রহন করেন । কর্মক্ষেত্রে একজন সফল মানুষকে শুধু পদক সম্মাননা দিয়েই মূল্যায়ন নয়, তাদের সব ক্ষেত্রে সম্মানের স্থানে রাখতে হবে।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ । ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনা বিধুর একটি দিন । সেদিন পিলখানার দরবার হলে বিডিআর-এ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তথাকথিত দাবি আদায়ের অজুহাতে কিছু সংখ্যক বিপদগামী বিডিআর সদস্যদের বিদ্রোহে নিহত হন জাতির এই সূর্য্য সন্তান । ঐদিন তিনি সহ প্রায় ৫৫ জন মেধাবী সেনা অফিসাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। দেশের সর্বাক্ষণিক অতন্দ্র প্রহরী মহান আত্মত্যাগী এই সেনা নায়েকের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সদর দফতর থেকে যশোর ক্যান্টারমেন্ট প্রবেশ পথে ঢাকা-যশোর মহসড়কের পাশে “শহীদ কর্ণেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (পিএসসি) -এর নামে তরুন নির্মাণ করা হয় । একই সাথে কাঁচের গ্লাসের মধ্যে কালো কালি দিয়ে রং তুলিতে লেখা হয়, তাঁর কর্মজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত । উদ্দেশ্য দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আত্মদানকারী একজন বীর সৈনিক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান কে যেন জাতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার সাথে সব সময় স্মরণ রাখে।
বদরুন্নেছা খানম প্রিয়তমা জীবন সঙ্গীনী । হঠাৎ ঝড়ে লন্ডভন্ড করে দেয়া সংসারকে যেন আবার গুছানো চেষ্টা । জীবন যুদ্ধে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু স্বামীর শূন্যতা বুকে রেখেই দুই ছেলেকে নিয়ে সময় পারাপার করছেন তিনি । বড় ছেলে কাজী সামির আসাফ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি (AIUB) থেকে বি.বিএ শেষ করেছে। বর্তমানে আরো উচ্চতর ডিগ্রীর আরোহনের আস্ট্রোলিয়ায় U.T.S ইউনিভার্সিটিতে একাউন্টিং এ মাস্টার্স করছে। ছোট ছেলে কাজী সাদির আসাফ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ৭৪ তম বিএম দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে সাফল্যের সাথে কোর অব ইনফেন্ট্রি (পদাতিক বাহিনী )তে কমিশন লাভের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন । সাদির আসাফ গেল কয়েক দিন আগে আরো একটি রেংক পদোন্নতি পান। বর্তমানে লেফটেনেন্ট হিসেবে কর্মরত আছে । যোগ্য জীবন সাথী উজান ঝড়ের খেয়ার মাঝি হিসেবে জীবনের কঠিন সময়েও রেখে চলছেন অমিত সাহসিকতার স্বাক্ষর ।
রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরী বিডিআর-এর দেশপ্রেমিক এই সেনা নায়ক ও সেনাপতি -সহ ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও তাদের আত্মার চির শান্তি কামনা করছি….. আমিন
লেখক: -মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম, লোক-সাহিত্যনুরাগী, রাজনীতিক কর্মী ও সংগঠক।