রঙ্গিন জামার স্বপ্ন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংগঠন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমার প্রাণের শহর। ভালবাসি এই শহরকে। এমন অবস্থায় দাড়িয়েছে এই শহরকে ছেড়ে দূরে কোথায় গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারিনা । শহরের আলো-বাতাস, শহরের মানুষগুলি ও তাদের আচার আচরণ সবই আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। ফলে সেই ভালবাসার টানে পাগলের মত শহরের বুকে ফিরে আসা। কারণ আমি ভালবাসি আমার শহরকে। আমাদের শহরকে। আমাদের বললাম কারণ এই ভালবাসার মাত্রা আমার থেকেও বেশি আছে শহরের অনেকের মাঝেই তাদের কয়েকজন আমার পরিচিত। আমি এমনও ব্রাহ্মণবাড়িয়ানকে চিনি যিনি কিনা লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছুটে এসেছেন প্রশান্তির টানে।
আপনারা হয়তো ভাবছেন এতো প্রতিটি জেলার নাগরিকের জন্য স্বাভাবিক বিষয় যে সে তার প্রিয় ভূমিকে বেশি ভালবাসবে। এটা নিয়ে আবার লিখার কি আছে? হুম আছে , সে কারণেই তো লিখছি। কিছু বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলছে বেশ কিছুদিন যাবত। সে গুলো সবার নজরে আনতেই আমার এই লিখার সূত্রপাত।
ফেসবুক কি সেটা বলে বোঝানোর মত মূর্খতা করতে চাইছিনা। কারণ বর্তমান যুগে সবাই এর উপকারিতা ও অপকারিতা মুখস্থ ও ঠুথস্ত করে নিয়েছেন। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশ কিছু সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে উঠেছে। আমি নাম উল্লেখ করতে চাইনা। তাদের উদ্দেশ্যগুলোও চমকপ্রদ এবং প্রশংসাযোগ্য। কেউ ছোট শিশুদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে। কেউ বিদ্যালয়ের দেয়াল আবর্জনামুক্ত করে রংধনুর রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউবা বিভিন্ন উতসব পার্বণে সমাজের অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাড়াচ্ছেন। যা দেখলে যে কারো ভাল লাগবে। কিন্তু!
এখানে আবার কিন্তু কিসের ? যতটুকু পড়লেন তাতে আসলে কোন কিন্তু না খোঁজে পাওয়ারই কথা। চলুন তাহলে একটু গভীরে যাই। আমরা জানি প্রতিটা সফল কাজের পিছনে অনেকগুলো কাজের মিশ্রণ থাকে। আমাদের এই সংগঠনগুলোর কাজের পেছেনেও এমন কিছু গল্প থাকে। যেমন এদের মাঝে অনেকেই নিজের টিফিনের টাকা জমিয়ে তা দিয়ে ছোট শিশুর মুখে হাসি ফোঁটায় আবার অনেকে আছে এই কাজের জন্য রীতিমত চাঁদাবাজি শুরু করে দেয়। শহরের বিভিন্ন এলিট পার্সনের কাছ থেকে টাকা বের করে আনার ক্ষেত্রে তাদের সহায় জেলায় কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের সাথে তোলা ছবি বা সেই ব্যক্তির অনুরোধ। আবার এমনও হয় জেলার হর্তাকর্তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি করে সেই কার্ড দেখিয়েও অর্থ নেওয়া হয়। আসলে যারা এসব অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তারা মহানুভবতা থেকেই যাচ্ছেন বা যান। যান অনুপ্রেরণা যোগাতে। তবে এর সাথে কিছু বিষয় মাথায় রাখলে মহানুভবতা আরো প্রসারিত হতো। অন্তত তা কারো জন্য সমস্যার কারণ হতো না।
একবার এক বাহীনির এক কর্মকর্তার সাথে কথা হচ্ছিল এসব সংগঠন নিয়ে। সেখানে তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেন, তার অসহায়ত্বের কথা। বললেন, সংসার তো এখন আমার অনেকগুলো, সকাল এ সংসারের খোরাক যোগায় তো বিকালে অন্য সংসার। এত সংসার নিয়ে আসলে ভাই আর চাকরি করতে পারব না। চলেই যাব। যেমন কথা, তেমন কাজ।
ছোটবেলা থেকে আমার পরিবার আমাকে এটা শিক্ষা দিয়েছে যে, ছোটদের হাতে কখনও টাকা দিতে নেই, দিলে তারা বখাটে হয়ে যায় । ঠিক এই সমস্যাটাতেই ভুগছে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংগঠনগুলো। তারা টাকার খেলায় মত্ত। জেলা শহরের প্রধান সমস্যা যানযট। এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই । লোডশেডিং হচ্ছে নিয়মিত, নাহ তা নিয়েও তাদের কথা বলতে দেখা যায়না।, শহরের ইভটিজিং বন্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরীতেও তারা নেই। মাদকমুক্ত শহর গড়তেও নেই আগ্রহ, তারা আছে সেখানে, যেখানে কাড়ি কাড়ি টাকার প্রবাহ আছে, যেখানে ব্যান্ডিং হওয়ার সুযোগ আছে, তাদের সেখানে পাবেন। এর ফলে কি হচ্ছে? এর ফলে নষ্ট হচ্ছে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা। নষ্ট হচ্ছে স্বেচ্ছায় কাজ করতে এগিয়ে আসা যুবক যুবতীদের স্পৃহা। কারণ সবাই তো আর নিজেকে জাহির করতে আসেনা। অনেকেই আসে মানষিক প্রশান্তি ও সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায়। তারাই হচ্ছেন আশাহত। কারণ তারা আসে সমাজের সেবা করতে, আর এসে দেখে নিজেকে জাহিরের অস্থির প্রতিযোগিতা। আবার তা কখনও সংগঠন সংগঠনের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে, চলে বিষেদ্বগার। আর বলতে চাচ্ছিনা কারণ খারাপ কিছু পুড়ে ছাই করতে গেলেও বাজে গন্ধ বের হয়।
তবে তার ব্যতিক্রমও কিন্তু হচ্ছে। আসলে সেই ব্যতিক্রমী আয়োজন দেখেই এই লিখাটির অবতারণা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জাতীয় দৈনিকের পাঠক সংগঠনের বন্ধুরা নিজেদের ঈদের বাজেট কমিয়ে সেই টাকায় অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি করে রঙিন জামা বিতরণ করে ঈদের আনন্দ অসহায় শিশুদের সাথে ভাগ করে নিবে। তারা এই আয়োজনের নাম দিয়েছেন ”একটি করে রঙিন জামা” । তবে আমি হলে নাম দিতাম একটি করে রঙ্গিন স্বপ্ন। কেন ? দেখুন একটি অসহায় শিশু একটি নতুন জামা পাবে, বিষয়টি আপনার আমার জন্য সামান্য, কিন্তু শিশুটির মনে সেই রঙ্গিন জামায় শতকোটি স্বপ্ন উড়ে বেড়াবে। হয়তো সেই রঙ্গিন জামায় সে নিজেকে জড়িয়ে সে নিজেকে তার কল্পনার সৃষ্ট জগতের পরীদের সাথে খেলায় মেতে উঠবে। আর অন্যদিকে, যে তাকে জামাটি উপহার দিল সেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে। আর ধর্মীয় দিক থেকে সংযমের একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে তাদের এ আয়োজন। কারণ একটি রঙ্গনি জামা না কিনলে এই পুরো টাকাটা দিয়েই সে জামা কিনত বা বন্ধু মহলের আড্ডায় সেটা খরচ হয়ে যেতো। কিন্তু এখন তার এই সামান্য টাকাতেই একটি রঙ্গিন স্বপ্ন ডানা মেলেছে। এভাবে যদি ছোট ছোট স্বপ্নগুলো ডানা মেলার সুযোগ পায়, আমার শহর একদিন সত্যি সত্যি স্বর্গ হয়ে যাবে। আমাদের শহর একদিন সত্যি সত্যি স্বর্গ হয়ে যাবে।
জয়তু রঙ্গিন জামার স্বপ্ন
জয়তু স্বপ্ন বুননের কারিগররা
লেখক :: মনিরুজ্জামান পলাশ, সংবাদমাধ্যমে নিয়োজিত শ্রমিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ১৪-৬-১৭ ইং। ই-মেইল :mdpalash92@gmail.com