২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
বাবরসহ ১৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড, তারেকের যাবজ্জীবন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা দুই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবনের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর ১১ সরকারি কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
১০ অক্টোবর, বুধবার দুপুর সোয়া ১২টায় হত্যা ও বিস্ফোরকের দুই মামলায় এ রায় ঘোষণা করেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল ১০ অক্টোবর। এদিন সকালে মামলার ৩১ আসামিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
২১ আগস্ট হামলা
বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। ওই নৃশংস হামলায় নেতাকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও ছিলেন।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মামলা
গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ।
এরপরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেন। এ সব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন
২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। ওই কমিশন এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।
অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এ সব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল।
প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তিটা কোন দেশ তা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
প্রথম অভিযোগপত্র
তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।
২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। পরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ।
কাহহার আকন্দ ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন।
সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক-বাবর
গ্রেনেড হামলার ঘটনার মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সে দিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত চার্জশিটটি দাখিল করেন এস আই গোলাম মাওলা।
দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশিটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্তদের তালিকায় নতুনভাবে যাদের যোগ করা হয় তাদের মধ্যে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উল্লেখযোগ্য।
জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় ইতোমধ্যেই কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়।
এখন এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ জনে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন এবং জামিনে ছিলেন ৮ জন। জামিনে থাকা আট জনের জামিন বাতিল করে আদালত।
মামলার বিচার শুরু
একুশে অাগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ২৮ মার্চ বুধবার৷
বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় ওই বছর ৯ এপ্রিল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়৷ এর আগে একুশে অাগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শুরু হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিশেষ ট্রাইবুনালে৷
এই মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানসহ ২২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়েছিল৷ আদালত ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছিল৷
আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
বিচারপ্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত
এই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
এ নিয়ে ১১৯তম কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ কার্যদিবস ব্যয় করেছে।