পত্রিকার পাতায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
ডেস্ক ২৪:: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। যুদ্ধ শেষে প্রায় এক মাস পর জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরবেন দেশে। জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আঁচ পত্রিকার পাতায় দেখা যায় ৮ জানুয়ারি থেকেই। যতদিন যেতে থাকে নেতার প্রত্যাবর্তনে ততই পত্রিকার পাতাজুড়ে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও এর সাফল্যগাথা, আরেকদিকে যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের প্রথম সপ্তাহের পত্রিকায় সাক্ষ্য দেয় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, যার মুক্তির পর দেশে ফিরিয়ে আনতে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় এক মাস।
১০ তারিখ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুহূর্তের বঙ্গবন্ধু
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর শিরোনাম ছিল ‘ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে।‘ এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ বহু প্রতীক্ষিত সেই শুভদিন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আস্থা ও ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষার স্বর্ণসিঁড়িতে হাঁটিয়া হাঁটিয়া স্বাধীন বাংলা ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুদীর্ঘ নয় মাস পরে আবার জননী বাংলার কোলে ফিরিয়া আসিতেছেন।’
১০ তারিখের দৈনিক বাংলার ছবি (জয়তু মুজিব)
পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এইদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং তারপর দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।তিনি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে শুরু হয় তার আসার অপেক্ষা। ৯ জানুয়ারির অবজারভারে প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। লন্ডন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন এবং ফিরছেন। আট কলামে ব্যানার হেডলাইনে প্রকাশিত এই খবরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে প্রথম পাতা সাজিয়েছিল তারা।পরের দিনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রক্তস্নাত স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলায় পা রাখেন।
ফিরে আসার আগের দিনের কাগজে বঙ্গবন্ধুর কথা
ওইদিন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় ঢাকা নগরী। এক কলামের আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, আকাশবাণী ধারাবিবরণী প্রচার করিবে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকায় প্রধান প্রতিবেদনই ছিল বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে। পূর্বদেশে লাল কালির প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’। আবেগময় ভাষা দিয়ে লেখা সংবাদটি ছিল মর্মস্পর্শী।প্রথম পাতাতেই বঙ্গবন্ধুর বড় একটি রঙিন ছবির পাশে ছিল সম্পাদকীয়। শিরোনাম ছিল ‘মাগো, তোর মুজিব এলো ফিরে’।
দৈনিক বাংলার ৯ এবং ১০ জানুয়ারি আট কলাম ব্যানার শিরোনামে লেখা হয় জয় বাংলা, জয়তু মুজিব এবং স্বাধীন হয়েছি, স্বাধীন থাকব।১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর আর স্থিরচিত্র। এদিন ইত্তেফাকে ছাপা হয় বঙ্গবন্ধুর বিশাল একটি স্থিরচিত্র।
দৈনিক বাংলার ছবি– স্বাধীন থেকেছি স্বাধীন থাকব
জীবন মৃত্যুর চ্যালেঞ্জের ভয়াবহ অধ্যায় পার হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানোর পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে গ্রেফতার হন এবং তাকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। জাতির জনকের এই প্রত্যাবর্তন স্মরণীয় করে রাখতে বিদেশি পত্রিকাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খবর প্রকাশ করে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডেইলি টেলিগ্রাফসহ সবকয়টি পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ ও ছবি প্রকাশ করেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউনিয়র্ক টাইমস এর কপি
সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, ঠিক দুপুর দেঢ়টায় প্রখর রোদের মধ্যে ঢাকার আকাশে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি কমেট জেট দেখা গেল। ঠিক তখনই জেটটি নামল না। আকাশ থেকে শেখ মুজিব তার সোনার বাংলাকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ঘুরে ঘুরে পাইলট তাকে তার সোনার বাংলা দেখার সুযোগ করে দেন। সোনার বাংলা তখন শ্মশান। শেখ মুজিব অবশেষে দেশে ফিরতে পারলেন।
বঙ্গবন্ধুর আবেগাপ্লুত ছবি
ইত্তেফাকে সেদিনের প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল স্বপ্ন আমার সফল হইয়াছে, বাঙালি এবার হাসিবে, খেলিবে। অন্যান্য সংবাদের মধ্যে ছিল ‘নেতার কথা’ ও ‘স্বাধীনতা কেউ হরণ করিতে পারিবে না’। দৈনিক বাংলায় সেদিনের ব্যানার শিরোনাম ছিলো স্বাধীন হয়েছি, স্বাধীন থাকব। দৈনিক সংবাদে আট কলামজুড়ে ছিল রেসকোর্সে সমবেত জনতার ছবি। প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘সাবধান! ষড়যন্ত্র এখনও চলিতেছে; মুজিব’।
জাতির জনক পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তাঁরা পৌঁছান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। সেখানে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি বিমানে তিনি পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন।
পত্রিকার কৃতজ্ঞতা: সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চ (সিবিজিআর) ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)