Main Menu

আবারো ভূমিকম্প

+100%-

Zaforekbalনতুন বছরের জানুয়ারির ৪ তারিখ খুব ভোর বেলা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) যেহেতু সিলেট এলাকা থেকে বেশ কাছে ছিল তাই ঝাঁকুনিটা আমরা টের পেয়েছি সবচাইতে বেশি। ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ভেতর বাড়াবাড়ি ধরণের আতংকে আছে। এই দেশে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে বছরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ মারা যায়। ভূমিকম্পে সাড়ে আটজনও মারা যায়না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ গাড়িতে উঠতে কখনো ভয় পায় না।
কিন্তু ভূমিকম্পের বিন্দুমাত্র আভাস পেলেই ভয়ে আতঙ্কে তাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। আমি যতটুকু জানি এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশে যত মানুষ মারা গেছে তারা কেউ ভূমিকম্পের কারণে মারা যায়নি। তারা মারা গেছে ভূমিকম্পের ভয়াবহ আতংকে। ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষজন চারতলা বাসা থেকে নিচে লাফ দিয়েছিল।

ভূমিকম্পের পর পর আমার সাথে অনেকে যোগাযোগ করেছে। একজন লিখেছে যখন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে তখন তারা ভয়ে আতংকে খাঁচার ভেতর আটকে পড়া ইঁদুরের মত ছোটাছুটি করেছে, কিন্তু কি করতে হবে বুঝতে পারেনি। আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন বলে দেই কি করতে হবে।

মুশকিল হচ্ছে মোটেও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ নই, ভূমিকম্পের সময় কি করতে হবে সে ব্যাপারে আমার উপদেশ দেয়া ঠিক হবে না। সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের সেই কথাগুলো বলা উচিৎ। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল আমাদের দেশের বড় বড় বিশেষজ্ঞরা ভয় দেখাতে ভালোবাসেন। ভূমিকম্পের সময় টিকে থাকার প্রথম বিষয়টাই হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখা। ভয় পেলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায় না। কাজেই ভূমিকম্প নিয়ে অযৌক্তিক ভয়টা দূর করে ফেলতে পারলেই অনেক কাজ হবে। আমি বেশ কয়েক বছর ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ছিলাম, সেখানে স্যান অ্যান্ড্রিয়াস ফল্ট লাইনে যেকোনো মুহূর্তে একটা ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার কথা। আমি যখন থেকে এর কথা জেনেছি, তারপর ৩৫ বছর কেটে গেছে। এখনো সেই ভূমিকম্পটি হয়নি। (হলিউডের লোকজন অবশ্য সেই ভূমিকম্পটিকে নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে টু-পাইস কামিয়ে নিয়েছে!) কাজেই ভূমিকম্পের প্রথম কাজটি হচ্ছে এটি কখন হবে কেউ বলতে পারে না- অর্থাৎ এটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোনো বিষয় না। সেটা কখন আসবে কেউ জানে না, সেটাকে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকার কোনো অর্থ নেই। হঠাৎ চলে এলে সেটাকে সামলানোর একটা প্রস্তুতি নিয়ে দৈনন্দিন কাজ করে যেতে হয়।

তবে সমস্যা হচ্ছে আমরা যদি বলতে থাকি ‘ভূমিকম্পের সময় কেউ ভয় পাবে না, মাথা ঠাণ্ডা রাখবে’- তাহলেই সবাই ভয় না পেয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে শুরু করে এই ভেবে যে সেটা কখনো ঘটবে না। আমি নিজে যখন জীবনের প্রথম বড় ভূমিকম্প দেখেছি, তখন ভয় না পেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ছিলাম, সেটা মোটেও সত্যি নয়। ভূমিকম্প নিয়ে পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত আমার ভয় একটু কমেছে। পড়াশোনা করে আমি যেসব জেনেছি সেগুলো জানলে আমার ধারণা অন্যদেরও অযৌক্তিক ভয় একটুখানি হলেও কমবে।

প্রথমে সবার যে বিষয়টা জানা দরকার, সেটা হচ্ছে ভূমিকম্প কিন্তু খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এই লেখাটি লেখার জন্য আমি গত দুই সপ্তাহে সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সবগুলো ভূমিকম্পের হিসাব নিয়েছি। মোট সংখ্যা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার। অর্থাৎ ঘণ্টায় ১০টা। যে বিষয়টা ছয়-সাত মিনিটে একবার ঘটে, সেটাকে যদি আমরা নিত্য নৈমিত্তিক এবং খুবই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মেনে না নিই, তাহলে কেমন করে চলবে? কেউ যেন আমাকে অবিশ্বাস করতে না পারে সেজন্য পৃথিবীর ম্যাপে লেখা কোথায় কোথায় ভূমিকম্পগুলো ঘটেছে।

তার একটা ছবি দিচ্ছি। যার জন্য অবিশ্বাস্য, সে ইচ্ছে করলে গুণে দেখতে পারে। শুধু মনে রাখতে হবে যে এখানে ছোটবড়ো সব ধরনের ভূমিকম্প আছে। এই সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া তাদের হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়েছিল, সেটাও এখানে আছে! কারো যদি আরেকটু কৌতূহল থাকে, তাহলে মনে করিয়ে দেওয়া যায় পৃথিবীতে রিখটার স্কেলে আট মাত্রার (ভয়ঙ্কর) ভূমিকম্প হয় আনুমানিকভাবে বছরে একবার। সাত মাত্রার (বড়) ভূমিকম্প বছরে ১০বার, ছয় মাত্রার (শক্তিশালী) একবার এবং পাঁচ মাত্রার (মাঝারি) হাজারবার! অর্থাৎ মাত্র একধাপ কমে গেলে সংখ্যা বেড়ে যায় ১০ গুণ।

যারা ভূমিকম্পের ম্যাপটি প্রথমবার দেখেছেন, তারা নিঃসন্দেহে একটা বিষয় দেখে খুব অবাক হবে। পৃথিবীতে এত ভূমিকম্প হয়, কিন্তু সেটি মোটেও সারা পৃথিবীতে সমানভাবে ছড়ানো ছিটানো নয়, নিশ্চিতভাবে কোনো কোনো এলাকায় বেশি। যেখানে বেশি সেখানে ভূমিকম্পগুলো একটা লাইন ধরে সারিবদ্ধভাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমরা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সেটাকে যতই একটা স্থির ভূখণ্ড ভাবি না কেন, আসলে এটা মোটেও স্থির নয়। পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ অনেকগুলো ভূখণ্ডে ভাগ হয়ে আছে। এবং একেকটা ভূখণ্ড একেক দিকে আছে। ভূখণ্ডগুলো যে জায়গায় একটা আরেকটাকে ধাক্কা দেয়, সেখানে ভূমিকম্প হয় সবচেয়ে বেশি। আমরা সেগুলোকে বলি ফল্ট লাইন। এবং আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে যে এতটুকু পড়ে এলে নিশ্চিতভাবে জানতে চাইবে বাংলাদেশ কি কোনো বড় ফল্ট লাইনের ওপর বসে আছে? উত্তর হচ্ছে- ‘না’। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট লাইন, সেটা ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের ধাক্কায় তৈরি হয়েছে, (যার কারণে আমরা হিমালয় পর্বতমালা পেয়েছি এবং সেখানে গত বছরের ভয়াবহ নেপালের ভূমিকম্প হয়েছে)। সেটা খুবই সাবধানে বাংলাদেশকে এড়িয়ে তার উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দক্ষিণে নেমে গেছে। এটুকু পড়ে কেউ যেন আনন্দে বগল বাজাতে না থাকে দুই কারণে। প্রথমত ফল্ট লাইনটি বাংলাদেশের যথেষ্ট কাছ দিয়ে গেছে এবং সেখানে বড় ভূমিকম্প হলে আমরা বাংলাদেশে বসে সেটা খুব ভালোভাবেই টের পাব। নেপালের ভূমিকম্প এবং কয়েকদিন আগের মনিপুরের ভূমিকম্পে আমরা সেটা দেখেছি। দ্বিতীয় কারণে বড় ফল্ট লাইন ছাড়াও ছোট ছোট এমনকি অজানা ফল্ট লাইনও থাকতে পারে। সেগুলো আমাদের মাঝেমধ্যে চমকে দিতে পারে!

আমাদের কতখানি চমকে দিতে পারে, সেটা অনুমান করার জন্য বাংলাদেশ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমানার ভেতর কতগুলো ভূমিকম্প হয়েছে, আমি সেটার তালিকা বের করে দেখেছি। সংখ্যাটি মোটেই বেশি নয়। এই একই সময়ে সারা পৃথিবীতে পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার। তার মাঝে মাত্র ১০টি ছিল বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে! ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার, বাংলাদেশে হয়েছে মাত্র একটি! সেটি হয়েছে সিলেট এলাকায়, একেবারে ভারতবর্ষের সীমানার কাছাকাছি, ১৯১৭ সালের মে মাসের ৮ তারিখ। কাজেই পরিসংখ্যানের যদি গুরুত্ব থাকে, তাহলে আমি গত ৪০ থেকে ৫০ বছরের পরিসংখ্যান দেখে বাংলাদেশের ভেতরে একটা ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে যাবে সেই দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম নষ্ট করতে রাজি নই!

আমার পরিচিত যারাই ভূমিকম্প হলেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাদের ভয় কমানোর জন্য একটা উপদেশ দিয়েছি। বলেছি যখন ভূমিকম্প হয়, তখন তারা যেন মনে করে যে সেটি মোটেই তাদের পায়ের নিচে ঘটছে না- প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেটি ঘটছে শতশত কিলোমিটার দূরে এবং এখানে বসে তারা শুধু দূরের একটা ভূমিকম্পের রেশটুকু টের পাচ্ছে। তাহলেই তাদের ভয় কমে যাবে। আজকাল ইন্টারনেটের যুগে ভূমিকম্প হওয়ার এক-দু’ মিনিটের ভেতরে আমরা বের করে ফেলতে পারি সেটা আসলে কতদূরে ঘটেছে। সেটা কয় মাত্রার ভূমিকম্প।

দূরে ভূমিকম্প হলে আমরা তার রেশটুকু কীভাবে অনুভব করবো, সেটাও মোটামুটি অনুমান করা যায়, আমরা আসলে কম্পনটুকু অনুভব করি। তাই যখন কম্পন বেশি হয়, আমরা বলি ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্পের কেন্দ্র যত দূরে হবে, ভূমিকম্পের পরিমাণও তত কমে যাবে। খুবই সহজভাবে অনুমান করার জন্য বলা যায়, দ্বিগুণ দূরত্বে সরে গেলে কম্পন চারগুণ কমে যাবে। কাজেই কিছুদিন আগের ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটি সিলেটের মানুষেরা যত তীব্রভাবে অনুভব করেছে, ঢাকার দূরত্ব দ্বিগুণের মতো হওয়ার কারণে তার মাত্র এক-চতুর্থাংশ অনুভব করেছে! (তারপরও ঢাকার লোকজন দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে!)

২.

আমার মনে হয় ভূমিকম্প নিয়ে অযৌক্তিক আতঙ্ক কমানোর জন্য যথেষ্ট তথ্য দেওয়া হয়েছে। এবার মূল বিষয়ে আসা যাক, ভূমিকম্প চলতে থাকলে কী করতে হবে। আমি যেহেতু ভূমিকম্পে বিশেষজ্ঞ নই, তাই নিজে থেকে কোনো উপদেশ না দিয়ে যারা এসব নিয়ে মাথা ঘামান, তাদের বক্তব্য তুলে দিই। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্পের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার সরকারি উপদেষ্টা এরকম :

ক. যদি ভেতরেই আছ, তাহলে ঘরের ভেতরেই থাকো। একটা শক্ত টেবিলের নিচে গিয়ে টেবিলটাকে ধরে থাকো। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ঘরের ভেতরের দেয়ালের পাশে দাঁড়াও। বাইরের দেয়াল। জানালার কাঁচ, ভারি ফার্নিচার- এসব থেকে দূরে থাকো। নিচে নামার জন্য লিফট ব্যবহার করো না।

খ. যদি বাইরে আছ, তাহলে বাইরেই থাকো। উঁচু বিল্ডিং কিংবা উপরের ঝুলন্ত ইলেকট্রিক তার থেকে সরে যাও!

আমি যেটা লিখেছি সেটা ক্যালিফোর্নিয়ার পদ্ধতি, আমাদের বাংলাদেশের নয়। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে দেখেছি, বাংলাদেশেও মোটামুটি এই একই উপদেশ দেওয়া হয়। ভূমিকম্পের সময় পুরো বিল্ডিং ধসে পড়ার ঘটনা খুব বেশি নেই। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় আশপাশের জিনিসপত্র শরীরের উপর পড়ে আঘাত পাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। তাই ভূমিকম্পের সময় প্রথম চেষ্টা করা হয়, এ ধরনের আঘাত থেকে বাঁচানোর।

৩.

ভূমিকম্প নিয়ে কথা বলতে হলে আমি সবসময় সবাইকে একটা বিষয় মনে করিয়ে দিই (২০১০ সালে হাইতিতে রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পে হাইতিতে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে চিলিতে আট মাত্রার চাইতেও বেশি একটা ভূমিকম্পে মানুষ মারা গিয়েছিল মাত্র ১৩ জন। এখানে মনে রাখতে হবে, আট মাত্রার ভূমিকম্প সাত মাত্রার ভূমিকম্প থেকে ৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী!)

বিষয়টা বিস্ময়কর মনে হলেও আসল কারণটি সহজ। চিলি পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি (১৯৬০ সালে সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছিল)। চিলি ধীরে ধীরে তাদের সব বিল্ডিং কম্পন সহনশীল করে গড়ে তুলেছে। সে কারণে বড় ভূমিকম্পেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি বলতে গেলে হয়ই না। দরিদ্র হাইতিতে ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং নেই। তাই সেখানে এত সহজেই এরকম অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্ক আছে। সচেতনতা নেই। ভূমিকম্পের ব্যাপারে আমরা মোটেই হাইতি হতে চাই না- আমরা চিলি হতে চাই।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, শাবিপ্রবি।






Shares