Main Menu

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : স্বাধীনতার বীজ ছড়ানো ভাষণ ব্যবচ্ছেদ

+100%-

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের তৈরি এবং জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রধানতম কুশীলব। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল পাকিস্তান হওয়ার এক বছরের মধ্যে। নিজ মাতৃভাষায় কথা বলার ন্যায্য অধিকারের জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল এই তল্লাট। সেই বায়ান্নর রক্তিম পথ বেয়ে বাঙালি একে একে পাড়ি দিয়েছে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সর্বোপরি ১৯৭০ সালের নির্বাচন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানেই ক্ষমতাসীন নয় বরং পূর্ব-পশ্চিম উভয় অর্থাৎ পাকিস্তানের দুই অংশেরই ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নীল নকশার কারণে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল সাক্ষাত রক্তগঙ্গা। নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার কথা কিন্তু কূটচালে তা আর হয়ে উঠে নি। তখন থেকেই বস্তুত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে রঙ লেগেছিল জোরেশোরে।

মার্চের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আন্দোলন ছড়িয়ে যায়। অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকেও সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের শলাপরামর্শে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঘোষণা আসে হরতালের, চলে বিক্ষিপ্ত লড়াই। বিশেষ করে বিহারিদের সাথে বাঙ্গালিদের লড়াই মার্চের প্রথম থেকেই শুরু হয়। ৫ই মার্চ চট্টগ্রামে এমন ই এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে দুই শতাধিক বাঙ্গালি প্রাণ হারান। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা। পরিস্থিতি ঠিক যখন অগ্নিগর্ভ তখনি ৭ই মার্চের ভাষণের ঘোষণা আসে। আর তাতেই দানা বাঁধতে শুরু করে স্বাধীন বাংলা গড়ার স্বপ্ন।

সাত মার্চের ভাষণ একাধারে একটি দেশের জন্মের গাঁথুনি হিসেবে টোটকা হিসেবে কাজ করেছিল। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে বঙ্গবন্ধু কিন্তু পক্ষান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়েছিলেন। বিশেষ করে “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই দুই লাইনেই স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত কথা বিরাজমান ছিল এবং উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা এটাকে ঘোষণা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু তাতে করে পাকিস্তানি জান্তাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়েছিল।

তাছাড়া “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল” এর মাধ্যমে পূর্ণ প্রস্তুতির কথাই বলা হয়েছে এবং তা ঠিক ঠিক প্রতিধ্বনিত করেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সদস্যরা এবং যেসব স্থানে আঘাত আসার সাথে সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল তারাও প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।

ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর আবেগপূর্ণ সম্ভাষণ নিঃসন্দেহে এটার গুণগত মান এবং আন্তরিকতার মাপকাঠিতে উত্তরণ ঘটাতে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। উপস্থিত সমুদ্রসম জনতাকে জনসভাস্থলে শান্ত রাখাটাও ছিল দারুণ কৃতিত্বের নচেৎ জনসভাস্থলেই বিপর্যয়ের মুখে পরতে পারতো লক্ষ লক্ষ জনতা। কারণ পাকিস্তানি জান্তা ঠিক সেরকম প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছিল। শান্তিপূর্ণ হরতালের আবাহন জানানোর মাধ্যমে একদিকে আন্দোলন চাঙ্গা রাখার পরিকল্পনা আবার অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে যে আওয়ামী লীগই শেষ কথা তাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল জনসভায়। আর এই তল্লাটের জনসাধারণ যে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল জনসভায়। বস্তুত উনিশ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু এটাই বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে “বাঙালিদের আর দাবায়া রাখতে পারবা না”।

শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব বিশ্ব-পরিমণ্ডলেও অপরিসীম। একটা শক্তিশালী ও হিংস্র জাতির সাথে থেকে সেখান থেকে ন্যায্য অধিকারের দাবিতে স্বাধীনতার আন্দোলন করে যাওয়াটা রীতিমত অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর জন্য আক্ষরিক অর্থেই চপেটাঘাত ছিল। কারণ আমেরিকা, চায়না, সৌদিআরব সহ বেশ কয়েকটা শক্তিশালী দেশ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সাথে একাত্ম ছিল। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য শান্তিকামী অংশটা পাকিস্তানের পূর্ব অংশ অর্থাৎ বাংলার সাথেই ছিল।

একটা ভাষণে একটা স্বাধীন জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল ; এটা বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বে আরও অনেক ভাষণ দেওয়া হয়েছে। মার্টিন লুথার কিং এর “আই হ্যাভ এ ড্রিম” কিংবা আব্রাহাম লিঙ্কন এর “গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস” বারাক ওবামার “মেইডেন স্পীচ” কিংবা নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া ফিলিস্তিন স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধানতম স্থপতি ইয়াসির আরাফাতের ভাষণের কথা উল্লেখ করা যায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিল। কারণ এই ভাষণের মাধ্যমেই এই তল্লাটের মানুষের মনে এই বিশ্বাস পোক্ত হয়েছিল যে তারা পারবে। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শোষণ থেকে রেহাই পেতে তারা সক্ষম। আর এই বীজের শুরু থেকে শেষ অবধি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্মই হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য। এই একটা মাত্র অমোঘ জায়গায় অন্যান্য নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যতিক্রমতা লক্ষ করা যায়। এবং এর জন্যই অনন্য বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণ এবং এর ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষদের অফুরন্ত প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রস্তুত করেছিলেন। ধাপে ধাপে প্রস্তুতি নিয়ে শেষমেশ বাংলাদেশ গড়েছিলেন। নিজে সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে নিজের জীবনের আধেক তিনি কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গভাবে। আর এই সকল কিছুর ছাপ দেখতে পাওয়া যায় সাত মার্চের মহাকাব্যিক কবিতায়।






Shares