সরাইলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে
মোহাম্মদ মাসুদ, সরাইল প্রতিনিধি :: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিভিন্ন হাট -বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্টান , হোটেল-রেস্তোরাঁ সিএনজি ওর্য়াকসপ, ফার্নিসারর কারখানায় শিশু শ্রমিকের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। এ উপজেলায় শিশুশ্রম আইনের কোন প্রয়োগ না থাকায় দিন দিন বেড়েই চলছে এর সংখ্যা। কিছুসংখ্যক সুবিধা ভোগী দোকান মালিক , ও কারখানার মালিক কম পারিশ্রমিকে শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র পরিবারের বেশির ভাগ শিশু এসব কাজে নিয়োজিত।
মঙ্গলবার জাতীয় শিশু দিবসে সরজমিনে দেখা যায় উপজেলা সদর সহ বিভিন্ন ইউনিয়নে শ্রম বিক্রি করছে পাঁচ শতাধিক শিশু। এদের অনেকের বাবা নেই। থাকলে ও দ্বিতীয় বিয়ে করে আর স্ত্রী সন্তানের খবর নিচ্ছে না। অনেকের বাবা বেঁচে থেকেও কর্মক্ষম। কেউ কেউ মাদকাসক্ত। কথা হয় ফয়সাল (১০) নামের এক শিশু শ্রমিকের সাথে। সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ আরিফাইল গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা চালক কবির মিয়ার ছেলে ফয়সাল। উপজেলা সদরের একটি চায়ের দোকানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সে। গতকাল দুপুর ১২টায় গিয়ে দেখা যায় পানির ক্যাটলি হাতে নিয়ে পুকুর থেকে দোকানের দিকে যাচ্ছে। আর শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। শিশু দিবসেও কাজ করছ তুমি ! এ কথা বলার পর চুপসে যায় ফয়সাল। পরক্ষণেই সে বলতে থাকে, আমডার আবার শিশু দিবস। সহাল ৭টায় আইছি। রাইত ৮টায় বাড়িত যামু। ৭০ টেহা পামু। টেহাডা নিয়া মার আত দিমু। আমডা ৫ ভাই। আমি একজনের ছোড। বড় ভাই হাকিম মিয়া (১৪) ও হুটেল-অ কাম করে। বাহি তিন ভাই ছোড ছোড। আনডার আব্বা সিএনজি চালা। টিক মত বারিত আইয়ে না। টেহাঅ দে না। হাইয়া না হাইয়া দিন পাইর করি। কেলাশ টু তামাত পড়ছিলাম নিজ সরাইল ইসকুলে। আর-অ পড়বার ইচ্ছা আচিল। পারতাছি না। ঘর চলে না। পেডে ভাত না তাকলে পড়–ম কি কইরা। আমার সাতের পোলা পাইন ইসকুলে বই লইয়া যা। আর আমি চা’র দোগানের কাপ আত লইয়া চাইয়া তাহি। হুব হরাপ লাগে। পরিসকার বালা শাট পেন পইরা পেলাপাইনে লাইন ধইরা বড় সাররার সাথে রাস্তা দিয়া আটতাছে। ইডারে বলে রলি কয়। ছোড বাইচ্চারার কি দিবস বলে আজকা। আমার মনডা অত হিয়ান যাইতে চায়। কাম ফালাইয়া যামু কেমনে? গেলে অত মালিকে আজকার টেহাডা আর দিত না। ফয়সাল অট্রহাসি হেঁসে বলে, ইহানের কামে বলে অয় না। আমডার হুফু হুটেলে কাম করনের লাই¹া আমার লাগি একটা বিসা বলে আনছে। তয় হুটেলডা আবার ঢাহা। হিয়ানে বেশী টেহা দিব। একই গ্রামের জাহাঙ্গির আলমের ছেলে মাফুজ (১১)। পড়েছে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা দূরে। দুই ভাই, দুই বোনের সংসার পরিচালনায় মা দিশেহারা। বাধ্য হয়ে মাফুজ কাজ করছে চায়ের দোকানে। মাফুজ বলে, হুব সখ ও ইচ্চা আচিল পড়বার। অপিসার অইবার। কপালে নাই। ঘরে অভাব। তাই ডেলি ৬০ টেহা বেতনে কাম করতাছি। আমডার আবার দিবস! উচালিয়া পাড়া মোড়ের চায়ের দোকানে কাজ করছে ৮ বছরের শিশু সাইফুল। হেবজু মিয়ার ছেলে সাইফুলরা ৩ ভাই ৩ বোন। তার মাসিক বেতন ৮’শ টাকা। সকাল থেকে রাত ৮-৯টা পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হয়। প্রচন্ড রোদ্রেও রিকশা চালাচ্ছে গুনারা গ্রামের জুরু মিয়ার শিশু পুত্র আনু মিয়া (১০)। তারা দু’ভাই। মা সহ ৪ সদস্যের পরিবার। বাবা অসুস্থ্য। পড়া নয় আগে বাঁচতে হবে। তাই সে রিকশা চালাচ্ছে। উচালিয়া পাড়া গ্রামের আনোয়ার মিয়ার শিশু পুত্র ফেরদৌস (১২)। একটি ফার্নিসারের দোকানে কাজ করছে। ফেরদৌস বলে, শিশু দিবস বুঝি না। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলাম। পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই সপ্তাহে এক’শ টাকার বেতনে কাজ করছি। কাচারী পাড়ার আমির আলীর শিশু পুত্র রাকিব (১০)। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। পড়ার ফাঁকে দৈনিক ৫০ টাকার হাজিরায় তরজার দোকানে কাজ করছে রাকিব। আরেক শিশুর নাম রবিন (০৯)। বাড়ি শাহবাজপুর। দৈনিক ২০ টাকা ও খাবারের বিনিময়ে ফার্নিসারের দোকানে কাজ করছে। এ ছাড়া উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নে শত শত শিশু কাজ করছে। গ্রীলের দোকান, চায়ের দোকান, হোটেল, ওয়ার্কশপ, রিকশা চালানো সহ নানান জটিল পেশায় কাজ করছে তারা। শিশু শ্রম নিষিদ্ধ জেনেও অনেক মালিক কম মূল্যে তাদের শ্রম ক্রয় করছেন। জাতীয় শিশু দিবসেও ওইসব শিশু থাকে অবহেলিত। এদের খবর কেউ নেয় না। র্যালীতে যাওয়ার জন্য এদেরকে কেউ ডাকে না। শিশু দিবসেও কাজ করতে হয় ওদের। সরাইল উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, শিশু শ্রমকে সরকার আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। আর শিশু দিবসে এদেরকে দিয়ে কাজ করানোর প্রশ্নই আসে না। আমরা তদন্ত করে ব্যবন্থা নিব।