সকালে নিহত, রাতে মামলার স্বাক্ষী :: এজহারও তৈরী করেছে পুলিশ ,বাদী গ্রাম ছাড়া
ষ্টাফ রিপোর্টার ::শামীম (২৬) গত ১৭ নভেম্বর ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তার পিতার নাম আলী আহাম্মদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কাটানিশার গ্রামে এ পরিবারের বসবাস। শামীমের সৎ ভাই দীন ইসলামের (৩৫) সাথে তার ছিল পারিবারিক দ্বন্ধ। নিস্পত্তির জন্য সালিস সভা বসে প্রতিবেশী বকুল মিয়ার ওঠানে। এক পর্যায়ে দীন ইসলাম অতর্কিতে হামলা চালায় শামীমের উপর। তার বুকে পিঠে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে দীন ইসলাম। শামীমকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নিয়ে যায় হাসপাতালে।
শামীম গত ১৭ নভেম্বর ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তার লাশ ময়না তদন্তের পর স্বজনরা হত্যা মামলা করতে যায় সরাইল থানায়। কিন্তু লাশের খবর জানার পরও হত্যা মামলা নেয়নি পুলিশ। লাশের উপর ৩২৬ ধারায় মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। নিহত শামীমকে করা হয়েছে স্বাক্ষী। ওই মামলার আসামীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করছে না? আবার আসামীদের হুমকিতে বাদীনি ও তার স্বামী এখন কেন গ্রাম ছাড়া? এ সকল প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বাদী ও তার স্বজনদের মনে।
স্থানীয় লোকজন ও মামলা সূত্রে জানা যায়, কাটানিশার গ্রামের দিনমজুর আলী আহাম্মদ (৬০)। দুই বিয়ে করেছেন তিনি। ১টি নিজ গ্রামে পরেরটি শাহবাজপুরে। প্রথম সন্তান দীন ইসলাম। দ্বিতীয় বিয়ের বয়স ৩৫ বছর। স্ত্রী সামছুন্নাহারের গর্ভে জন্ম নেয় একমাত্র ছেলে শামীম ও চার মেয়ে জলি (২২) তাকমিনা (২০) তানজিনা (১৮) ও তানিয়া (১২)। তারা সকলে একই বাড়িতে বসবাস করত। দীন ইসলামের স্ত্রী মন বালার (৩০) সাথে নিয়মিত পারিবারিক কলহ হত শামীম তার স্ত্রী মা বাবা ও বোনদের। তার সহোদর মামা বকুল মিয়া (৪৮) ও দুধ মিয়া প্রকাশ মলাই মিয়া (৫৫) ছিল শক্তির উৎস।
গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যার পর দুই ভাইয়ের বিরোধ নিস্পত্তির জন্য সালিস বসে বকুল মিয়ার ওঠানে। সর্দার ছিলেন রহিম আলী, জাকির মিয়া, বাবুল ও দুধ মিয়া। কিছুক্ষণ পর দীন ইসলাম সালিসে বসা শামীমের উপর হামলা চালায়। শামীমের গলার নিচে পিঠে বুকে সে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে চলে যায়। রক্তাক্ত ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে প্রথম সরাইলে পরে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরন করা হয়। ১৭ নভেম্বর ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শামীম মারা যায়। হাসপাতালের পত্রের আলোকে বনানী থানা ওইদিনই নিহত শামীমের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেন।
ওই দিন সন্ধ্যার পর সরাইল থানায় হত্যা মামলা দিতে যান শামীমের মাতা মোছা: সামছুন্নাহার বেগম। আহত ব্যক্তি এখন লাশ। ময়না তদন্তও হয়েছে। এমন খবর দেয়ার পরও ৩২৬ ধারায় নথিভুক্ত হয়েছে সামছুন্নাহারের মামলা। এজহারও তৈরী করেছেন তারা (পুলিশ)। আসামী দীন ইসলাম তার দুই মামা ও স্ত্রীসহ চারজন। মামলায় ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে ৪ নভেম্বর শামীমের পূর্ব ভিটির বসত ঘরে। মামলার ১নং স্বাক্ষী করা হয়েছে নিহত শামীম মিয়াকে।
অকালে সন্তান হারিয়ে পাগল প্রায় শামীমের দরিদ্র পিতা মাতা এ মামলার খেলা প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ময়নাল হোসেন এখন মামলাটি ৩০২ ধারায় সংযোজন করার জন্য আবেদন করেছেন বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সেই সাথে চলছে দুইজন আসামীকে মামলা থেকে বাদ দেয়ার পায়তারা। ওদিকে ঘটনার পর থেকে আসামীরা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করছে না এমন অভিযোগ বাদীর। গত ২২ নভেম্বর হাজী মজিবুরের বাড়িতে প্রকাশ্যে বাদীনি ও তার স্বামীকে মারধর করে আসামী বকুল। মামলা প্রত্যাহার না করলে প্রাণনাশেরও হুমকি দেয় বকুল মিয়া। ভয়ে বাদীনি এখন গ্রামছাড়া। তার বৃদ্ধ স্বামী, ৪ মেয়ে, নিহত শামীমের দুই শিশু সন্তান ইভা (৫) বাবুনি (২) ও ৭ মাসের অন্তসত্তা স্ত্রী কে নিয়ে সামছুন্নাহার এখন বাবার বাড়ি শাহবাজপুরে অবস্থান করছে।
শামীমের মা মামলার বাদী সামছুন্নাহার ও পিতা আলী আহাম্মদ বলেন, লেখাপড়া জানি না। ১৭ নভেম্বর ভোরে ছেলে মারা গেছে। রাত সাড়ে সাতটায় থানায় গেছি। এর আগে থানায় কোন অভিযোগ দেয়নি। তাই পুলিশ নিজেরাই লিখে কি মামলা করলো বুঝি না। এখন আবার কোর্টে দৌড়াতে হচ্ছে। বকুল মিয়া আমাদেরকে মারধর করে মামলা বাদ না দিলে ছেলের মত হত্যার হুমকি দিয়েছে। পরিবারের সকলকে নিয়ে এখন আমরা গ্রাম ছাড়া। গরীবের জন্য আইন নাই। আসামীরা বুক উঁচু করে প্রকাশ্যে গ্রামে ঘুরছে। পুলিশকে গ্রেপ্তারের কথা বললেই বলে তদন্ত চলছে। এর পেছনে গ্রামের অনেক ষড়ন্ত্রকারী কাজ করছে। ৪ জন থেকে ২ আসামীর নাম বাদ দেয়ার পায়তারা করছে।
সাবেক ইউপি সদস্য মো. কাশেম মিয়া সহ গ্রামের একাধিক লোক বলেন, এক ভাই আরেক ভাইকে মেরে ফেলেছে। শামীম নিহতের পর নিস্পত্তির জন্য বসেছিলাম। সেখানে শামীমের পিতা আলী আহাম্মদ ও বাদীনি সামছুন্নাহারকে বকুল মিয়া লাঞ্ছিত করেছে। আসামীরা এখন বাজারে দোকানপাটে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই ময়নাল হোসেন বলেন,মামলাটি তদন্তাধীন আছে। গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা (বাদী) আসামী না দেখাইয়া দিলে গ্রেপ্তার করব কিভাবে বলেন? সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আলী আরশাদ বলেন, শামীম মারা যাওয়ার আগে মামলা হয়েছে। এমন ঘটনায় জখমী ব্যক্তিই স্বাক্ষী হয়। আসামী গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।