ডেস্ক ২৪ :একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গুলো প্রমানিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি অভিযোগ ছিল হত্যার নির্দেশ। এ হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার পৈরতলায়। অভিযোগ পত্রে বলা হয়, তার পত্রের নির্দেশানুয়ায়ী সিরু দারোগাসহ ৪০ জনকে জেলখানা থেকে বের করা হয়। এরমধ্যে পাকি সৈন্য ও রাজাকাররা গুলি করে ৩৮ জনকে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে একজন প্রাণে বেঁচে যান। নিহতদের মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে রাখা হয়। প্রসিকিউটরবৃন্দ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, তা থেকেই এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নিহত ৩৮ জনের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন (১) সিরু মিয়া দারোগা, পিতা-মৃত আমিন উদ্দিন ব্যাপারী, সাং রামকৃষ্ণপুর, থানা হোমনা, কুমিল্লা। তিনি ১৯৭১ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত ছিলেন। (২) আনোয়ার কামাল (১৪) পিতা-সিরু মিয়া দারোগা, (৩) নজরুল ইসলাম, পিতা মৃত আব্দুল আজিজ সরকার, থানা-দাউদকান্দি, কুমিল্লা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) এর ছাত্র ছিলেন। (৪) আবুল কাশেম, পিতা ও ঠিকানা অজ্ঞাত। সিরু মিয়া দারোগা এবং তার ছেলে আনোয়ার হোসেনসহ ৩৮ জন নিহত হবার পেছনে গোলাম আযমের নিদেশ ছিল বলে জানা গেছে। ১৯৭১ সালের ২১ নবেম্বর রোজার ঈদের দিন রাত আনুমানিক ১টায় আসামির পত্রের নির্দেশানুযায়ী সিরু মিয়া দারোগা, আনোয়ার কামাল, নজরুল, শফিউদ্দিন আহম্মেদ, আবুল কাশেমসহ ৪০ জনকে স্থানীয় জেলখানা থেকে বের করে লরিতে ওঠায়। ওঠানোর পর শফিউদ্দিন পাকিস্তানে লেখাপড়ার কারণে উর্দুতে কথাবার্তা বলতে পারায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহর নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাদবাকি ৩৯ জনকে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী রাজাকার ও আলবদররা পৈরতলা নিয়ে যায়। সেখানে রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাক সৈন্যরা আটককৃতদের গুলি করে। এদের মধ্যে একজন প্রাণে বেঁচে যান। বাকি ৩৮ জন নিহত হন। গুলিতে নিহতদের রাজাকাররা মাটিতে পুঁতে রাখে। অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামির সরাসরি নির্দেশে এসআই সিরু মিয়া,আনোয়ার কামাল, নজরুল ইসলামসহ ৩৮ জনকে নিহত ও এস আই সিরু মিয়া ও আনোয়ার কামালকে নির্যাতনের জন্য আসামি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) (এ) ধারার অধীনে হত্যা ও নির্যাতনজনিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, কুমিল্লার সিরু মিয়া দারোগা ১৯৭১ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব¡ পালন করতেন। তার ছেলে সে সময় মতিঝিল গবর্নমেন্ট হাইস্কুলে ১০ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত আনুমানিক ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মোহাম্মদপুর থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখে এসআই সিরু মিয়া তার বাসা চামেলীবাগে যান। ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম, পুত্র আনোয়ার কামাল ও অন্য আত্মীয়স্বজন গ্রামের বাড়ি চলে যান। সিরু দারোগা পাকিস্তান বাহিনী দ্বারা আক্রমণের কারণে দেশত্যাগে বাধ্য শরণার্থীদের খাওয়া দাওয়া ও তাদের ভারতে পৌঁছাতে সাহায্য করেন। তিনিও ৭/৮ দিন পর ভারতে চলে যান। সপ্তাহখানেক পর আবার ভারত থেকে চলে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা তার ছেলে আনোয়ার কামাল, নজরুল, আবুল কাশেম, জাহাঙ্গীর সেলিম (বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত) ও শফিউদ্দিন ভারতে যাবার উদ্দেশে নিজ বাড়ি থেকে বের হন। এ সময় সিরু মিয়া দারোগা ও নজরুল ইসলামের কাছে একটি করে রিভলবার ছিল। ’৭১ সালের ২৭ অক্টোবর আনুমানিক সকাল ১০টায় ভারতে প্রবেশের সময় কুমিল্লা জেলার কসবা থানাধীন তন্তর চেকপোস্টে পৌঁছামাত্র রাজাকাররা তাদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সে সময় একটি জিপে ৫/৬ জন পাকসেনা সেখানে আসে। তারা সিরু মিয়া ও নজরুল ইসলামের কাছ থেকে দুটি রিভলবার নিয়ে নেয়। পরে সিরু মিয়া দারোগা, তার ছেলে আনোয়ার কামাল, কাসেম, শফিউদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলমকে তার দিয়ে বেঁধে ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী একটি ট্রাকে তোলে দেয় হয়। রাত ১২টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক স্থানে তাদের নামায়। সেখানে শান্তি কমিটি ও জামায়াতের নেতা পেয়ারা মিয়া (বর্তমানে মৃত) আসে এবং তাদের গালাগালিজ করে। পেয়ার মিয়ার সঙ্গে আরও ৪/৫ যুবক ছিল। পেয়ারা মিয়া ও অন্যরা আটকদের কাছ থেকে হাতঘড়ি, আংটি ইত্যাদি ছিনিয়ে নেয়। তাদের বিকেল ৪/৫টায় রাজাকার মঞ্জিল (অন্নদা স্কুলের সামনে কালীবাড়ী) নিয়ে যায়। পথে তাদের দেখিয়ে মাইক দিয়ে প্রচার করা হয় যে, স্পেশাল বাহিনী অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে। ধরে নেয়ার পর তাদের অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আলী রেজা, ব্রিগেডিয়ার সাদাত উল্লাহ, মেজর আব্দুল্লাহ, হাবিলদার বশির উদ্দিন এই নির্যাতন কেন্দ্রে নির্যাতন করতেন। দুদিন নির্যাতনের পর সিরু মিয়া দারোগা ও আটকদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয। এসআই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে গেলে তার ছেলে একটি চিঠি দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতের আমির এবং শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার কারণে ইচ্ছা করলে আটক সিরু মিয়াসহ তাদের মুক্ত করতে পারবেন। এ বিশ্বাস রেখে ১৫ রোজার দিন এসআই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তার পিতা আয়েত আলী সরকারসহ ঢাকায় আনোয়ারা বেগমের মেজোবোন মনোয়ারার স্বামী মোহসিন আলী খানের খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়ার বাসায় আসেন। তখন মোহসিন আলী খিলগাঁও গবর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আসামির দু’ছেলে আজমী ও আমীন তার ছাত্র ছিল। আনোয়ারা বেগমের অনুরোধে তার ভগ্নিপতি মোহসিন আলী খান আসামির কাছে তার মগবাজারে বাসায় যান। এ সময় আসামি বলেন যে, সিরু মিয়া দারোগা ও তার ছেলে মুক্তিবাহিনী। তারা অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে। তা তিনি জানেন। এ কথা বলার পর মোহাম্মদ মহসিন আলীকে দুদিন পর তার সঙ্গে পুনরায় দেখা করতে বলেন। কথা মতো দুদিন পর মহসিন আলী আবার যান। গোলাম আযমের বাসায় গেলে তিনি একটি গাড়িযোগে মহসিন আলীকে নিয়ে তৎকালীন পুরান সংসদ ভবনের নিকটবর্তী নাখালপাড়ায় জামায়াতের অফিসে নিয়ে যান। আসামির গাড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গার্ড ছিল। কিছুক্ষণ পর গোলাম আযম একটি খামবদ্ধ চিঠি মহসিন আলীর হাতে দেন। কাউকে না দেখিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তি কিমিটির নেতা পেয়ার মিয়ার হাতে দিতে বলেন। আনোয়ারা বেগম চিঠিটি নিয়ে নিজ বাড়িতে আসেন এবং তার ভাই ফজলুর রহমানকে (মৃত) গোলাম আযমের কথা মতো চিঠি কাউকে দেখাতে নিষেধ করে তার হাতে দেন। ফজলুর রহমান উক্ত চিঠি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তি কমিটির নেতা পিয়ারা মিয়ার কাছে গেলে সে চিঠিটি পড়ে গোলাম আযমের লিখিত আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি ফজলুর রহমানকে দেখায়। এতে সিরু মিয়া দারোগা ও তার ছেলে আনোয়ার কামালকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যার নির্দেশ ছিল। পেয়ারা মিয়া ফজলুর রহজমানকে আরও বলে যে, যে চিঠি এনেছ তাতে নতুন কিছু নেই, বাড়ি গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর। এর পর ২১ নবেম্বর রোজার ঈদের দিন তাদের জেল থেকে এনে গুলি করে হত্য করা হয়। |