ভূতের নগরীর রুপ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রেল ষ্টেশন ধংস স্তুপ, দূর্ভোগে যাত্রীরা, ৭টি মামলায় আসামী অজ্ঞাতনামা ৬০০০ জন (ভিডিও)
মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় সৃষ্ট সহিংসতায় ভূতের নগরীর রুপ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেন সে সবের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। রেলওয়ে ষ্টেশন, জেলা আওয়ামীলীেগর কার্যালয়, দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংঘঠনে চালানো হামলায় বাকরুদ্ধ সে সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। রেলওয়ে স্টেশনে হামলার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অগ্রমি ও আসনসহ টিকেট বিক্রির কার্যক্রম, সিগন্যাল সিস্টেম নষ্ট করে ফেলায় এখন “ডি” শ্রেণীর রেলওয়ে স্টেশনের তালিকায় এই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটি। যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে চরম দূর্ভোগ। সবাই দ্রুত দোষিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। । এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় করা হয়েছে ৭টি মামলা। বিস্তারিত তুলে ধরছেন মনিরুজ্জামান পলাশ।
সোমবার বিকেলে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের সঙ্গে ঘটে যাওয়া তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে পুলিশ-মাদ্রাসা ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের(পক্ষে ছাত্রলীগের নেতা কর্মী) ত্রিমুখী সংঘর্ষে মঙ্গলবার নিহত মাসুদুর রহমানের মৃত্যুকে ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সব ঘটনায় অনেকটাই ভুতুরে নগরীর রুপে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলা রেলওয়ে স্টেশন। বুধবার সেখানে শুধু ধংস্ব স্তুপ দেখা গেছে। বন্ধ রয়েছে অগ্রমি ও আসনসহ টিকেট বিক্রির কার্যক্রম, যাত্রীদের দেয়া হচ্ছে হাতে লিখা আসনবিহীন টিকেট। সিগন্যাল সিস্টেম নষ্ট করে ফেলায় এখন ডি শ্রেণীর রেলওয়ে স্টেশনের তালিকায় এই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটি। রেলকর্মচারীরা বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রেন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
রেলওয়ের সহকারী স্টেশন মাষ্টার সোয়েব মিয়া জানান, বর্তমানে আপ ও ডাউনের (ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী) দুটি ষ্টেশন যথাক্রমে তালশহর ও পাগাচ্ং এর সিগনাল সিস্টেমে এই ষ্টেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা টেলিফোনের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে ক্রসিংগুলোকে অবহিত করছি। ষ্টেশন এলাকায় চারটি লাইন থাকলেও এখন শুধু মাত্র দুটি ব্যবহার করা যাচ্ছে। এ ভাবে ট্রেন পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
টিকেট কাউন্টারের বিক্রয়কর্মী মো: ফারুক আহমেদ জানান, এখন ভিপিডির (কাগজে হাতে লিখা টিকেট) মাধ্যমে আমরা শুধু মাত্র আসন বিহীন টিকিট দিতে পারছি। এই টিকেট ট্রেন ছাড়ার আধ থেকে এক ঘন্টা আগে যাত্রীদের কাছে সরবরাহ করার নিয়ম রয়েছে।
এদিকে, মাদ্রাসা ছাত্রদের এই তান্ডবের পর রেলওয়ে ষ্টেশনের এই অবস্থা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠছেন। টিকিট না পাওয়া, বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা নষ্ট করে ফেলায় তাদের পড়তে হচ্ছে দূর্ভোগে । তারা বলছেন এসব কার্যক্রম যারা করেছেন তারা দেশের শত্রু। তারা দ্রুত এ পরিস্থিতির উন্নয়ন চান।
কুমিল্লাগামী যাত্রী শাহিনুর বেগম অনেকটা আক্ষেপ করে বলেন, আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লায়। সড়ক পথ ভাঙ্গা হওয়ায় যেতে পারিনা তাই প্রায় ট্রেনে আসা যাওয়া করি। অন্য সময় কুমিল্লার টিকিট ট্রেন আসলেও কাউন্টারে পাওয়া যায়। কিন্তু আজ নিতে পারিনি। কেন নিতে পারেন নি এমন প্রশ্ন করতেই, তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “দেখতেই তো পারছেন”।
অপর এক যাত্রী কাশেম আলী বলেন, দশের জিনিষ নষ্ট করা খুব খারাপ কাম, ভালনা। সরহারের (সরকার) মেলা হতি অইছে (ক্ষতি হয়েছে)।
শহরের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্ম বিষয়ক শিক্ষক আব্দুল হালিম বলেন, আমার ছেলে চট্টগ্রামে পড়ে। তাকে ও আমার স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। কাল টেলিভিশনে ঝামেলার ছবি দেখিছি কিন্তু আজ এসে সব দেখে আতকে উঠেছি। সবই ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া হয়েছে। তিনি দ্রুত ষ্টেশনকে স্বাভাবিক রুপে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে দাবি জানান।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর জন্য হতাশার বাণী শুনিয়েছেন রেলওয়ে স্টেশন মাষ্টার মাহিদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, টিকিট আউটপুটের জন্য কম্পিউটার প্রিন্টার ইত্যাদি হয়ত সহসাই পাওয়া যাবে। কিন্তু সিগন্যাল সিস্টেম সহসাই পুনঃ নির্মান হচ্ছেনা। এর জন্য কমপক্ষে ৬মাস অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে রেলওয়ের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা ১০০০ থেকে ১২০০০জনেক আসামী করে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্টেশন মাষ্টার।
অন্যদিকে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তান্ডবের অনেকাই ছিল স্ংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গুলোতে। শহীদ ধীরেন্দ্রণাথ ভাষা চত্তরে অবস্থিত পাঁচটি সাংস্কৃিত কেন্দ্রে, যথাক্রমে- তিতাস সাহিত্য সংষ্কৃতি পরিষদ, সাহিত্য একাডেমি, শিশু নাট্যম, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দও স্মৃতি পাঠাগার, তিতাস ললিতকলা একাডেমি, হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা হয়েছে। কোমলমতী শিশুদের সংস্কৃতি শিক্ষা কার্যক্রম হয়ে পড়েছে বন্ধ। অন্যদিকে, জেলার ঐহিত্যবাহী দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে চালানো তান্ডভে পুড়ে ছাই হয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ র স্মৃতি বিজরিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও মিউজিয়ামের সকল দূর্ভল সংগ্রহ।
সংস্কৃতি কর্মী মনজুরুল আলম মনে করেন, আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে যে তান্ডব চালানো হয়েছে, তা যে কোন বিবেকবান মানুষের কাছে ঘৃণিত কাজ বলে বিবেচিত হবে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ পরম আদরে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিলে তিলে এখানে আলাউদ্দিন খার স্মারক বিষয়গুলো রাখা হয়েছে। তার অনেক ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মিউজিয়ামে ছিল। এর মধ্যে ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যে সরোদ যন্ত্র বাজাতেন তার কয়েকটি সংস্করণ, তার ব্যবহৃত বেহালা, সন্তু, শতরঞ্জি এবং বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহের কাছ থেকে পাওয়া উপঢৌকন। জেলার এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আলাউদ্দিন খাঁ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং তার মাথায় সব সময় টুপি থাকত, তার এই স্মৃতি চিন্হে এই ধরনের আক্রমন আমাদের খুবই তাড়িত করে। তিনি এই হামলার জন্য প্রশাসনের নিকট একটি ন্যায়ানুগ বিচার প্রার্থনা করেন।
অন্যদিকে অশ্রু সজল চোখে কথা বলতে পারেননি দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সাধারন সম্পাদক আব্দুল মান্নান সরকার। তিনি কথা বলার আগেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমাদের সাথে তো তাদের কোন বিরোধ নেই। এই মিলনায়তনে প্রতিবছরই মিলাদ মাহফিল করা হয়। মাদ্রাসার বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করা হয়। তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমি সুদীর্ঘ ২৩ বছর এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলাম এই প্রতিষ্ঠান। দান অনুদানের গড়া ভালবাসার এই প্রতিষ্ঠানের এই অবস্থা দেখে অনেকাই হতবিহবল হয়ে পড়েন এই কবি।
তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের পরিচালক মনির হোসেন বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে কোন সংকটের সময়ই শিল্প সংস্কৃতির উপর এত বড় এবং নৃশংস আঘাত আসেনি যা গত মঙ্গলবার মাদ্রাসা ছাত্র ও তাদের সাথে মিলে ছাত্রদল-শিবিরের ক্যাডাররা যে তান্ডব চালিয়েছে। আমাদের সংগঠনের হারমোনিয়াম তবলা মাঠে এনে ভেঙ্গেছে, চেয়ার টেবিল, বই পত্র সবই ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীরা, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে চায়না সেই পাকিস্তানী প্রেতাত্বারা আজকে বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে ধংস করে দিতে চেয়েছে। এই হামলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প সাহিত্যে উপর পরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট টার্গেট করা হমলা। তিনি হুশিয়ারী দিয়ে বলেন, আমরা মাঠে থাকব। সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার আমরা তাই করব।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা শিশুদের নিয়ে কাজ করি। তাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শিখা্য়। এখন শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হবে।
এদিকে, জেলা আওয়ামীল কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় মামলা করবে আওয়ামীলীগ এমনটাই জানিয়েছেন জেলা আওয়ামীলের সাধারন সম্পাদক আল মামুন সরকার। তার মতে, এই হামলা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ চালিয়েছে।যারা যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি। তবে আওয়ামীলীগ শান্তিতে বিশ্বাস করে বলে কোন কর্মসূচিতে যাবেনা। তারা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মলনে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
মামলা সমূহ ::
অন্যদিকে, এ ঘটনায় পৃথক ৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৬০০০ জনকে। এর মধ্য সদর মডেল থানায় হয়েছে ৫টি মামলা। ১। পুলিশবাহী পিকআপভ্যানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সদর মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রুবেল ফরাজী বাদী হয়ে বেআইনি জনতাবদ্ধে সরকারি কাজে কর্মরত কর্মচারীকে মারধর করার অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৭০০-৮০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। ২। জেলা সদর হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনায় জেলা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক ডা. রানা নুরুস শামস বাদী হয়ে অনধিকার প্রবেশ করে ক্ষতিসাধনের অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৭শ থেকে ৮শ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ৩। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট চমন শিকদার জুলকারনাই বাদী হয়ে একই অভিযোগে মামলা করেছেন, আসামী করা হয়েছে ৮শ-৯শ জনকে। ৪। প্রশিকার পরিচালক হুমায়ুন কবির ৭শ থেকে ৮শ জনকে আসামী করে একই অভিযোগ করেছেন ৫।কাপড় ব্যবসায়ী মো. ফেরদৌস মিয়া ও একই অভিযোগ করেছেন যেখানে দায়ী করেছেন অজ্ঞাতনামা ৩শ থেকে ৪শ জনকে। ৬। সবশেষ অভিযোগের খবর পাওয়া গেছে তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক বাছির দুলালও ভাংচুরের অভিযোগ এনে ৮০০-৯০০ জনকে আসামী করেছেন। অপর মামলাটি জিআরপি থানায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা ১০০০ থেকে ১২০০০জনেক আসামী করে মামলা করা হয়েছে বাদী হয়েছেন স্টেশন মাষ্টার মাহিদুর রহমান।
তুচ্ছ ঘটনায় ঘটে যাওয়া এ ধংসাত্বক ঘটনা ভয়ের ছাপ এঁকে গেছে শহরবাসীর মনে। এ ধরনের ঘটনা আর কখনও যাতে না ঘটতে পারে, প্রশাসন সে বিষয় নিশ্চত করবে এমনটাই প্রত্যাশা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর।