আওয়ামীলীগ নেতা যখন ডিলার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ টাকার চাল পাচ্ছে স্ত্রী-সন্তান ও শ্যালকসহ ৫ তলা ভবনের মালিকও
পাঁচতলা বাড়ি। সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রীর নাম উঠেছে রেশন কার্ডের তালিকায়। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ভাই-ব্রাদার,ওএমএস ডিলারের পরিবারের সদস্যদের নামে ঠাসা তালিকা। ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সাধারণ শ্রমিক, দিনমজুর, রিকসা চালক, ভ্যান চালক,পরিবহন শ্রমিক, চায়ের দোকানদার, হিজড়া সম্প্রদায়ের বদলে সুবিধে ভোগীর তালিকায় ভেসে উঠেছে ধনাঢ্যদের নাম। বিতিকিচ্ছিরি এই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায়। করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষ ওএমএস চালু হয়েছে এখানে। ৯ হাজার ৬’শ জনকে দেয়া হচ্ছে এই সুবিধের কার্ড। যা রেশন কার্ড হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু শুরু থেকে এ তালিকায় প্রকৃত লোকজনের জায়গা হচ্ছেনা বলে অভিযোগ উঠে। প্রথম দফায় প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৫’শ জনের তালিকা হয়। যারা এরইমধ্যে ১০ টাকা কেজিতে ২০ কেজি চাল পেয়েছেন। এই তালিকা নিয়ে একটি ওয়ার্ডে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে এচিত্র। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউতলী গ্রাম।
মসজিদ পাড়ার মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিশেষ ওএমএস নিয়ে। মহল্লার মুদি দোকানী থেকে শুরু করে সবাই জানেন কারা পেয়েছে এই সুবিধে, কে বানিয়েছে তালিকা। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলেননা তারা। মহল্লার প্রবেশ মুখে মোতাহার ম্যানশন।
স্থানীয়রা জানিেেয়ছেন,মোহাম্মদ মোতাহার হোসেনের এক ছেলে লন্ডন প্রবাসী। পাশাপাশি ৫তলা দুটি ভবন রয়েছে তাদের। তারই এক ছেলে কাজী অপু সারোয়ারের স্ত্রী এ্যানি সারোয়ারের নাম রয়েছে ভোক্তা তালিকার ৩৪ নম্বরে। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ওএমএস ডিলার মো: শাহআলমের পরিবার ও স্বজনদের কারো নামই বাদ নেই। তিনি জেলা আওয়ামীলীগের শিল্প ও বানিজ্য সম্পাদক । ভোক্তা তালিকার ১৬ নম্বরে রয়েছে তার স্ত্রী মোছাম্মৎ মমতাজ আলমের নাম। ১২ নম্বরে মেয়ে আফরোজার নাম। তার তিন ভাইবোন মো: সেলিম,মো: আলমগীর ও শামসুন্নাহারের নাম রয়েছে ৮,৯ ও ২৭ নম্বর ক্রমিকে। আরেক ভাই খোরশেদ মিয়ার ছেলে নাছিরের নাম রয়েছে ৭ নম্বরে। নাছির প্রবাসী। ৩ নম্বরে রয়েছে শ্যালক মো: তাজুল ইসলামের নাম। শ্যালকের স্ত্রী আসমা ইসলামের নাম ৫ নম্বরে। আরেক শ্যালকের স্ত্রী মোছাম্মৎ জান্নাতুল ইসলামের নাম রয়েছে ১০ নম্বরে। বোনের তিন দেবর মতিউর রহমান,মাহবুবুর রহমান,লুৎফুর রহমানের নাম রয়েছে ৭২,৭৩ ও ৭৪ নম্বর ক্রমিকে। আরেক শ্যালক প্রবাসী শফিকুল ইসলামের নামও রয়েছে তালিকার ১৩ নম্বরে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো: মাকবুল হোসেনের ৩ ভাই মো: আরিফ,মো: হানিফ ও মো: গোলাম রাব্বীর নাম রয়েছে ৮৭,৯২ ও ৯৪ নম্বর ক্রমিকে। স্থানীয়দের চোখে অবস্থা সম্পন্ন হাসেন আল মামুন,মো: বশির,মো: শরিফ ও মিনারা বেগমও পেয়েছেন এই কার্ড। তাদের মধ্যে মিনারার ৩ তলা বাড়ি রয়েছে। তাদের নাম রয়েছে ৬৭,৮৯,২৪ ও ৫৬ নম্বরে।
মো: শাহআলমের কাছে তালিকায় পরিবারের সদস্যদের নাম থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, এবিষয়ে আমি কিছু জানিনা। এটা কাউন্সিলর বলতে পারবে। এরআগে এবিষয়ে খোজখবর নেয়ার সময় শাহআলম বলেন,আমার ভাই মহল্লার সর্দার। আমাকে বলছে মহল্লার মধ্যে হতদরিদ্র এবং নিন্ম মধ্যবিত্ত যারা আছে তাদের তালিকা করার জন্যে। এই তালিকা তার(কাউন্সিলরের) কাছে পাঠানো হয়েছে। সে এবং পৌরসভা যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল করবে। তাছাড়া আমি কোন কার্ড বন্টন করিনি। আমি হলাম ডিলার। ডিলার কোন কার্ড দিতে পারেনা। তবে কাউতলী গ্রামের ১০৬ জনের তালিকার প্রথম পৃষ্টায় মেয়র,পৌর সচিব এবং কাউন্সিলরের পাশাপাশি মো: শাহআলমের স্বাক্ষর রয়েছে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকবুল হোসেন তার তিন ভাইয়ের নাম থাকার বিষয়ে বলেন- থাকতেই পারে। হালে তারা দুর্বল এবং আলাদা আলাদা রয়েছে। তালিকায় একই পরিবারভূক্ত সবার নাম উঠার বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান । তবে শাহআলমের দু-ভাইয়ের নাম তালিকায় দেখেছেন বলে জানান। তিনি বলেন এবিষয়ে আমি সৎপথে রয়েছি। জানামতে কোন ভুল করিনি।
এদিকে বিশেষ ওএমএস তালিকা নিয়ে অভিযোগ আছে সবারই। জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মাহবুবুল আলম খোকন বলেন- এনিয়ে কোথায় কি হচ্ছে কিছুই জানিনা আমরা,তুগলকি কান্ড চলছে। যারা কার্ড পেয়েছে তারা স্বাবলম্বী। গরীব,যাদের প্রয়োজন তাদের অনেকেই কার্ড পায়নি। ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর,সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী একজন,শিক্ষক প্রতিনিধি, রেডক্রিসেন্ট, এনজিও, ইমাম,পুরোহিত ও গনমাধ্যম প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে সুবিধা ভোগীদের তালিকা প্রনয়নের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এই পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর তার এলাকার ২/১ জন প্রভাবশালীকে নিয়ে বা নিজের ইচ্ছেমতো তালিকা তৈরী করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ তালিকায় বেশীরভাগ নিজস্ব বলয়ের লোকজনের নামই দিয়েছেন তারা। পরে অনুগত লোকজনকে নিয়ে করা কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে স্বাক্ষর আদায় করে তালিকা জমা দেন। কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই ওই তালিকা জমা হয় রেশনের জন্যে। তাছাড়া বিশেষ ব্যাক্তিদের দেয়ার জন্যে পৌরসভা ভিআইপি কার্ডও সংরক্ষন করে। বুধবার মানবজমিনে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরদিন জেলা ওএমএস কমিটির সভায় এনিয়ে আলোচনা হয়। ইতিমধ্যে হওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে দেখার এবং নতুন তালিকা(প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৩’শ জনের) প্রনয়ন যাতে ঠিকভাবে হয় তা দেখার নির্দেশ দেন কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান।
জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন-১০ জন স্বাক্ষর দিয়ে একটি তালিকা যখন জমা করে তখন খাদ্য অফিসার সেটি গ্রহন করে। তার আগে মেয়র সেটি অনুমোদন করেন। কোন ত্রুটি থাকলে মেয়র এর জবাব দেবেন। আমাদের পক্ষেতো ঘরে ঘরে গিয়ে তা যাচাই করা সম্ভব নয়। কোন অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।