Main Menu

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে স্মৃতিচারণ_ সাবেক এসপি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পিপিএম (বার) (পর্ব ১)

+100%-

ভালবাসা (পর্ব ১) _

নাইদার স্লিম নর স্মার্ট।।

“একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।
এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা ,অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্ব কে অর্থবহ করে তোলে।-‘‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র প্রারম্ভিকী অনেকটা এরকমই। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশ্লেষন করলে বারে বারে এ বক্তব্যেরই প্রতিচ্ছবি মিলে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাটি জীবন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, একটি পরাধীন জাতিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব,তার ও নেপথ্যের কারন এই দেশের প্রতি ভালবাসাই। তাত্ত্বিক বিশ্লেষনে দেখা যাবে আজন্ম বিপ্লবীর জীবনের পরতে পরতেও প্রেরণা যুগিয়েছে কোন না কোন ভালবাসা,প্রেম। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয় জনমানুষের কল্যান কামনায় যারা বিপ্লব করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, মরনপন লড়াই করেছেন তারা তো তাদের কওম, জনতা বা জনপদ কে ভালবেসেই করেছেন। সেই হিসাবে ভালবাসাই জীবনের আলোকবর্তিকা,দি লাইট হাউজ।

স্থান কাল পাত্র ভেদে ভালবাসায় রূপ বদলায়,ধরন ও প্রকৃতি বদলায় কিন্তু লক্ষ একটাই থাকে,আর তা হল মঙ্গল ইচ্ছা। ভালবাসার গল্পই আজ শুনাবো ভাবছি।বিগত দুপর্বে ভয়ের কাহিনী পড়ে অনেকেই ভয় পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।ভয় তাড়াতে ভালবাসার গল্পই নাহয় বলি।

দেশজুড়ে এমনকি বিশ্বজুড়েই চলছে করোনার প্রকোপ। বেশ কয়েক মাস ধরেই। মাঝে মাঝেই ফেসবুক বন্ধুদের ছেলেমানুষী মেসেজ পাই। যার অর্থ হল আর যদি দেখা না হয় ক্ষমা যেন করি। ভাষা দেখেই বোঝা যায় শুধু আমাকে নয় আরো অনেককেই পাঠানো হয়েছে। এই থমকে যাওয়া জীবনে আরো থমকে দাঁড়াই। সত্যিই কি জীবনাবসান হতে চলেছে? সত্যিই কি আর দেখা হবেনা প্রিয়জনদের সাথে? জীবনের কত কিছু এখনো বাকী, হাফ সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও তো মনে হয় মাত্র সেদিনই তো জীবনটা শুরু করলাম। ঐ যে, খয়েরী কডের প্যান্ট, আকাশী নীল প্রিন্টের হাফশার্ট আর ৭৮ টাকা দামের বাটা কাপড়ের জুতা পায়ে ১০/১১ বছরের শিশুটি বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বেরুলো। দিব্যি দেখতে পাই নেভিব্লু প্যান্ট, সাদা শার্ট আর ইচ্ছে মত জুতা/স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ১৫/১৬ বছরের কিশোরটি এসএসসি পরীক্ষা শেষ করল। আমি এমনকি তার কালো জোড়া ভ্রু, মুখে গোঁফ দাঁড়ির নতুন রেখাটিও দিব্যি দেখতে পাই। কলেজ শেষ করলাম এই তো সেদিন।এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যাবে?মানুষের জীবনের বেশীরভাগ বলতে চাওয়া কথাইতো অব্যক্ত থেকে যায়।সত্যিই যদি সময় ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তো তার আগেই তো মনে হয় কিছু না বলা কথা বলে ফেলা ভাল।তো তাই শুরু করি।

তখন আমি পুলিশ সুপার ব্রাক্ষণবাড়িয়া। পরিবার পরিজন ঢাকায়। আমি একাই থাকতাম। আমি সাধারনতঃ অফিসেই লাঞ্চ করতাম একটু বেলায়। সহকর্মী বা ভিজিটররা লাঞ্চে গেলে, ৩টার দিকে।

যেদিনের কথা বলছি সেদিনও আমি লোকজন বিদায় করে হাতের কাজ শেষ করে নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছি, লাঞ্চ করব তারপর। আমার অফিসে ছিল কনস্টেবল মোর্শেদ। বলতে গেলে অফিসে সে আমাকে মাতৃসম মমতায় দেখেশুনে রাখতো। খাবারটা, পানিটা, জলখাবারটা হাতের কাছে এগিয়ে দিয়ে তাগাদা দিতো। পূর্বের কর্মস্থলেও সে আমার সাথে ছিল। আমার স্ত্রীর পীড়াপীড়িতেই আমি ঢাকা থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া যাওয়ার সময় ওকেও বদলী করিয়ে নিয়ে যাই। ও থাকাতে আমার স্ত্রীও অনেকটা নির্ভার থাকতেন এই ভেবে যে, একা থাকলেও অন্তত খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হবে না মোর্শেদের কল্যাণে।

মোর্শেদ অত্যন্ত স্বল্পভাষী,বিনয়ী ও সিনসিয়ারএকটি ছেলে। খুব আস্তে করে কথা বলে। হঠাৎ আমি অফিসে মোর্শেদের উচ্চকন্ঠ শুনলাম। অবাক হলাম, ভিতরে ডাকলাম। কি হয়েছে, শব্দ কেন জিজ্ঞেস করলে কাঁচুমাঁচু হয়ে মাথা নীচু করে রাখলো।

ওর স্টাইলটা আমি জানতাম। আরো দুয়েকবার জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তা হল, দুই মহিলা এখনি দেখা করতে চায় আমার সাথে। ও বুঝিয়ে অপেক্ষা করতে বলছে, তারা শুনছেনা, কান্নাকাটি করে এখনি ঢুকতে চাচ্ছে। ডাকলাম ভিতরে। চল্লিশোর্ধ এক মহিলা, পরনে ছিন্ন বস্ত্র, চোখে মুখে চেহারায় দারিদ্রের স্পষ্ট ছাপ। সাথে ১৭/১৮ বছর বয়সের এক সন্তানসম্ভবা কিশোরী। কি হয়েছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম। ওযুর পানি তখনো হাত, মাথা থেকে দু-এক ফোঁটা পড়ছে। যা জানলাম তার সারমর্ম হল, মহিলার ৫ সন্তান, স্বামী নেই। বাড়ী বিজয়নগর। মেয়েটিকে বছর তিনেক আগে মালয়েশিয়া প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল গরু, ছাগল বিক্রি করে লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে। ছেলে দেশে ফেরত এসেছে।

মহিলার ভিটে বাড়ী সহ মোট ৭ শতক জায়গা আছে। একপাশে ছোট্ট একটা ঘরে মহিলা থাকে, আর একটা ঝুপড়িতে তার দুধের গরু এবং ৩/৪ টা ছাগল। সামনের ৫ শতক মত জায়গায় সবজি চাষ করে। নিজেই হাটে গিয়ে বিক্রি করে। কোনভাবে তার সংসার চলে। মেম্বার দয়া করে ভিজিএফের একটা কার্ড করে দিয়েছে। চাল কিনতে হয়না বলে রক্ষা।

জামাইটি দেশে এসে কোন কাজ পায়নি। বেকার ঘুরেবেড়ায়। কাজের মধ্যে মেয়েটিকে প্রেগনেন্ট করেছে। এখন মেয়েকে প্রেসার দিচ্ছে তোর মাকে বল, জমিটা বিক্রি করে একটা সিএনজি কিনে দিতে। তাইলে তোকে রাখব নইলে যা ভাগ। তোর মত পোয়াতি ফহিরনির ঝি দরকার নেই। ফ্রেশ দেখে আরেকটা বিয়ে করব। পাত্রী হাতেই আছে। পাত্রীর বাপ সৌদি থাকে, মালদার পার্টি, তোদের মত ফহিন্নি না। পেটে তোর বাচ্চা, তাই দয়া দেখিয়ে তোকে রাখতে চাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মেয়েটির বয়স কম হলেও দারিদ্রের অভিজ্ঞতায় তার ঝুলি সমৃদ্ধ। সে স্বামীকে বলে দিয়েছে ঐ জমি বিক্রি করলে আমার মা ছোট ভাই বোনদের নিয়ে না খেয়ে মরবে, কাজেই মরে গেলেও ওকথা মাকে বলতে পারবেনা। তাতে কপালে যা আছে তাই হবে। ফলাফল মেয়েটির বাচ্চাভরা পেটে স্বামীর লাথি। প্রতিবেশী এক জনের দয়ায় হাসপাতালে ভর্তি। ১০/১৫ দিন হাসপাতালে থেকে দালালের মাধ্যমে হাজার তিনেক টাকায় মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে অতঃপর আশ্রয় হয়েছে মায়ের জীর্ণ কুটিরে। মায়ের দীন দরিদ্র সংসারে নতুন একজন খানেওয়ালা, সে আবার ৭ মাসের পোয়াতি।

মায়ের অন্ধকার জীবনে নেমে এল আমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার। মেম্বার, চেয়ারম্যান, মোড়ল, মাতব্বরদের পিছনে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে কোন কাজ না হওয়ায় অবশেষে থানায় গমন। ওসি সাহেবের দেখা পাওয়ার জন্য কয়েক দিন ঘোরাঘুরি। ওসি সাহেব হন হন করিয়ে গাড়ীর হর্ন বাজিয়ে বেরিয়ে যায় এ কাজে, ও ডিউটিতে, বেলা গড়িয়ে রাজ্যের ক্ষুধা আর বিরক্তি নিয়ে থানায় ঢোকেন।দীন দরিদ্র,ব্লাউজ পেটিকোট বিহীন এই দরিদ্র নারীর দিকে ভ্রুক্ষেপ করার তার সময় কোথায়?

বেটি দুয়েক বার সাহস করে সেন্ট্রি এড়িয়ে ডিউটি অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেও পাত্তা দেয়নি খুব একটা। একবার খালি বলেছে স্যার আসলে দেখা করো । থানার সামনে গাছতলাটি শান বাঁধানো, এটিই রক্ষা। বেটি তার বেটিকে নিয়ে বসে থাকে। ওসি সাহেব থানার দোতলায় থাকে, খেয়ে দেয়ে নামবে তখন যদি একটা বিহীত হয়!

সেই সকাল এগারোটায় থানায় এসেছে, পড়ন্ত বিকেল পর্য্যন্ত পেটেও কিছু পড়েনি। প্রেগনেন্ট মেয়ে।শরীরে খাওন দরকার। সামনের সিঙাড়ার দোকানে গিয়ে আচলের খুট থেকে একটা ময়লা ১০ টাকার নোট দিয়ে সিঙাড়া কিনতে গেলে দোকানির দয়া হইছে। সে পুরির সাথে একটা বাটিতে একটু ডাল, মাংসের ঝোলও মিশিয়ে দিয়েছে। মা বেটিতে দুটো ডালপুরি আর থানার সামনের টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে পানি খেয়েছে। কিন্তু ক্ষুধা গরীবেরই মনে হয় বেশী লাগে!বেলা বাজে চারটা। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। ওসি সাহেবের নামার খবর নেই।

হঠাৎ ওসি সাহেব হন হন করে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুদল গ্রামবাসী টেটা বল্লম নিয়ে মুখোমুখি। ঢাকা সিলেট হাইওয়ে বন্ধ। কন্ট্রোল রুম থেকেও বার বার ফোন আসছে। লাইন থেকে এক্সটা ফোর্স নিয়ে সার্কেল এএসপি রওনা হয়েছে। সার্কেল এএসপিটা ত্যান্দোড় আছে। কোন কারনে তার আগে পৌঁছতে না পারলে দু কথা শোনাতে দেরী করবে না।

বেটি তাকিয়ে থাকে। ওসি সাহেবের নীল রঙের পিকআপ বেজায় শব্দে বেরিয়ে যায়। একটা কনস্টেবল দৌড়ে গিয়ে গাড়ীতে ওঠে। প্যান্টের চেইন তখনো খোলা, বাথরুম থেকে বেরুনোর পর চেইন লাগানোর সময় পায়নি। এত কষ্টেও কিশোরী ফিক করে হেসে দেয়।

সেন্ট্রি ছিল দাড়িওয়ালা এক বয়স্ক কনস্টেবল। সকাল থেকেই দেখছে মা বেটি বসে আছে। হাতের ইশারায় কাছে ডাকে বেটিকে। সব শুনে তার মায়া হয়। পকেট থেকে পঁঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলে ‘‘বেটি তুমি গরীব মানুষ থানা পুলিশ করে পারবানা। আমাদের বড় সাহেব গরীবের দয়া বোঝে। তুমি কালকে শহরে যাও। বড়সাহেবকে যদি বুঝিয়ে বলতে পারো তো তোমার কাজ হয়ে যাবে। কনস্টেবল তাকে সব বুঝিয়ে দেয় কিভাবে কোথায় যেতে হবে। মেয়েটি গ্রামের স্কুলে ফাইভ পর্য্যন্ত পড়েছে,প্রবাসী স্বামীর ঘর করেছে বছর তিনেক, সে ও মোটামুটি চিনে জানে। যে কথা সেই কাজ। পরদিন সকালে রান্নাবাড়া করে বাচ্চাদেরকে খাইয়ে দাইয়ে গরু ছাগলের খাবার দিয়ে ১২ বছরের ছেলেটিকে, ছোট দুতিনটা ছানা পোনার দায়ীত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পায়েহেঁটে, সিএনজিতে করে মা মেয়ে এসপি অফিসে এসেছে। দুপুর তখন ৩টা বাজে।

এসপি সাহেবের অফিসের ব্যবস্থা ভালই। গেটেই ডেস্কে দুজন অল্পবয়সী মহিলা পুলিশ। গরীব বলে তাকে অবহেলা করলনা। নাম ঠিকানা লিখে কার কাছে যাবে শুনে ওপর তলায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানেও সুন্দর ব্যবস্থা। সোফা আছে, ফ্যান আছে, বাথরুম আছে। যাওয়ার সাথে সাথে মা বেটি দুজনকেই আলাদা প্লেটে দুটো করে বেকারীর বিস্কুট, কাচের গ্লাসে এক গ্লাস পানি আর এক কাপ করে লাল চা দিল। চিনির ব্যবস্হা আলাদা।বেশী নিলেও অসুবিধা নেই।ওয়েটিং রুম থেকে আমার রুমে মা মেয়ের আগমন।

জিজ্ঞেস করলাম খেয়েছে কিনা-বলল খেয়েছে। কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করলে চা বিস্কুটের কথা বলল। মোর্শেদকে ওদের খাবার ব্যবস্থা করতে বলে আমিও ভিতরে ঢুকলাম। নামাজ ও লাঞ্চের জন্য। বেলা তখন সোয়া ৩টা।

ঐ দিন আমার বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম নেই। ওসিকে বললাম থানায় থাকতে। মেয়েটির হাসবেন্ড, তার বাবা, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে থানায় নিয়ে আসার জন্য বললাম।মহিলা ও তার মেয়েকে গাড়ীর পিছনে বসিয়ে রওনা দিলাম বিজয়নগর থানায়। পাঁচটার দিকে থানায় পৌছলাম। চেয়ারম্যান, মেম্বার, জামাই বাবু ও তার বাবা এবং এক চাচাও থানায় উপস্থিত। ভাব বুঝতে পেরে বিশেষ করে আমার গাড়ীর পিছন থেকে মা মেয়েকে নামতে দেখে ভড়কে গেছে। ওসি সাহেবও কৌতুহলী। উনিও বুঝতে পারছেন না কাহিনী কি। মা মেয়েকে ডিউটি অফিসারের রুমে বসিয়ে ওসির রুমে গিয়ে বসলাম।

ছেলেটি ও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম সমস্যা কি? যৌতুকের জন্য চাপ দেওয়া বা মারপিটের কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও বুঝলাম কাহিনী ঠিকই আছে। ছেলেটিও সুদর্শন। ২৮/৩০ বছর বয়স। জিজ্ঞেস করলাম এমন কেন করো?তোমার স্ত্রীর বাবা নেই, বড় ভাই নেই, বাপের বাড়ী থেকে পাওয়া সামান্য জমিতে ভাইদের লাঞ্চনা সহ্য করে থাকে। তুমিতো ও পরিবারেরও গার্জিয়ান। এমন কেন করো? ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম মানুষ এসে সারাদিন থানায় বসে থাকে। এসপির দেখা পায়, আপনার দেখা পায়না কেন? লজ্জা পেলেন। ওসি সাহেবও, আমিও। ব্যর্থতা তো আসলে আমারই। কিসের এসপি আমি, সেন্ট্রি কনস্টেবলের কথা মতো কিসের দয়া আমার! যেখানে দরিদ্র মানুষ বিচারের জন্য ঘোরে দুয়ারে দুয়ারে?

আমার নরম স্বরে ছেলেটির চোখেও জল এল। কেঁদে ফেললো। বললো দালালের খপ্পরে পড়ে কিভাবে সর্বশান্ত হয়ে দেশে ফিরেছে। বেকার বলে কারো কাছেই পাত্তা নেই। সবাই, এমন কি বাবা মাও দুরছাই করে। মর্দানির জায়গা ঐ একটাই, ঘরের বউ। তারও দুনিয়াতে কেউ নেই। মেরে ফেললেও জিজ্ঞেস করার কেউ নেই।

কাঁদতে কাঁদতেই বললো স্যার বাবার টাকায় বিদেশ গেছি। বাবা আর কিছু দিবেনা সাফ বলে দিয়েছে। ভাবছিলাম একটা সিএনজি কিনতে পারলে তা চালিয়ে খেতে পারতাম। কোন উপয়ান্তর না দেখে বউকে প্রেশার দিয়েছি জমি বিক্রি করে টাকা দেবার জন্য। আমার ভুল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

মেয়ে ও তার মাকেও ডাকলাম। জামাই শাশুড়ির কাছে মাফ চাইল। বউ এর দিকেও তাকালো ভয়েই, কিছুটা হয়তো ভালবাসায়ও। ওসি সাহেব করিৎকর্মা লোক। তাৎক্ষনিকভাবে সিএনজি ভাড়া দিয়ে চালায় এমন এক লোককে ডেকে আনলেন। তিনি আবার স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশের একজন সংগঠক। আমার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন স্যার ওকে আমি একটা সিএনজি দিব। ওসি সাহেব এবং চেয়ারম্যান সাহেব দায়ীত্ব নিলেন ছেলে ভাড়া না দিলে তারাই ব্যবস্হা করবেন।

তখনি সব সাব্যস্ত হল। গ্যারেজ থানার সামনেই। সিএনজি একটা ছিলই ড্রাইভার ছাড়া। জামাই গিয়ে সিএনজি নিয়ে আসল। বউ শাশুড়িকে সিএনজিতে চড়িয়েই থানা থেকে বিদায় নিল।

চেয়ারম্যান সাহেব মহিলাকে ঘর তুলে দিবেন বলেও আমাকে জানালেন। আমরাও খুশি মনে কোন মামলা মোকদ্দমা বা সেই অর্থে পুলিশী এ্যাকশন ছাড়াই সমস্যার সমাধান করতে পেরে খুশি হলাম। মাগরিবের আজান পড়ল পাশের মসজিদে। চা খেয়ে সবাই একসাথে ওসি সাহেবের রুমেই নামাজ পড়লাম। ওসি সাহেবের অনুরোধে ইমামতিও করলাম। মনটা ভাল হয়ে গেল। কাহিনী এখানেই শেষ না, কাহিনী এখানে শুরু।

মাস তিনেক পরের কথা। আমার এক প্রবাসী বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি গিয়েছে আমার ওখানে বেড়াতে। ওকে নিয়ে গেলাম আখাউড়া চেক পোষ্টে। উদ্দেশ্য সীমান্ত দেখা এবং ভারত বাংলাদেশ যৌথভাবে পতাকা নামানোর প্যারেড দেখা। বিজিবি বিএসএফ একই কমান্ডে জাতীয় পতাকা নামায়। খুবই আকর্ষনীয় সে প্যারেড। বিজিবির সিও সাহেবকে বললাম। উনিও এলেন। খবর পেয়ে ইউএনও এবং ওসিও আসলেন।

হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়াতে সেদিন আর প্যারেড হবেনা বুঝতে পেরে বিদায় নিলাম। সরাসরি শহরে না এসে আখাউড়া থেকে বিজয়নগর হয়ে ঢাকা সিলেট হাইওয়ে হয়ে ফিরব মনস্থির করলাম। এছাড়া বিজয়নগরের লাল মাটি, লিচু-কাঠালের বাগান এবং দিগন্ত জোড়া ফল ফসল ও সবজির খামার ভাল লাগবে মনে হল। দু বন্ধু গাড়ীতে গল্প করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি চারন করতে করতে ফিরছিলাম। বন্ধুটির হাতে সর্বাধুনিক মডেলের ক্যামেরা। ফটোগ্রাফি ওর হবি। হঠাৎ এক জায়গায় এসে ও গাড়ী থামাতে বলল। দু’ধারে করলার ক্ষেত। মে, জুন মাস তখন। ফুটখানেক করে লম্বা লম্বা করলা ঝুলে আছে হাজারে হাজার।

বৃষ্টিও তখন নাই। এলজিইডির পাকা রাস্তার দুধারে চক্ষু শীতল করা সবজির ক্ষেত। করলা, লাউ, ঝিঙে আরো কত কি। গাড়ী থামালাম। ও শুরু করল ছবি তোলা। উদ্দেশ্য করলার মাচার উপরে হলুদ একটি ফড়িং এর বিভিন্ন এ্যাংগেলের সর্বোত্তম ছবি তোলা।

হঠাৎ একপাশ থেকে এক মহিলা আসলেন গাড়ীর দিকে। দীন দরিদ্র চেহারা, মলিন একটি শাড়ী পরা। শুধু শাড়ীই। পেটিকোট, ব্লাউজ কিছু নেই। লম্বা ঘোমটা।বছর পঞ্চাশেক বয়স, হয়তো কম হবে। অপুষ্টিতে বেশী দেখাচ্ছে। কোমরের বাঁকে একটি টুকরি। তাতে নানারকম সবজি। একটা নাদুস নুদুস মিস্টি কুমড়া, করলা, ঝিঙে, পুঁইপাতা, সবই সদ্য ছেড়া।

ঘোমটা দেয়া মুখে, অন্য দিকে ফিরে বলছে “স্যার আপনার জন্য”। কিছুটা অবাক হলেও ভাবলাম বড় একটি গাড়ী দেখেছে, হয়তো বেশী দামের আশায় দিচ্ছে আমাকে। আমিও দান করার নিয়তে ৫০০ টাকার একটি নোট এগিয়ে দিয়ে স্টাফকে বললাম সবজি গুলো রাখতে। উনি টাকা নিলেন না, বরং বলে উঠলেন “স্যার আপনি আমাকে চিনতে পারেননি”।

তখন আমার অবাক হবার পালা। গ্রামের মধ্যে দরিদ্র এই মহিলাকে চিনবো কিভাবে। হয়তোবা একটু বিরক্তই হলাম। সত্যিকারের বিস্মিত হলাম মহিলার পরের কথায় বললেন “স্যার আপনিতো এখানে নিজে আসেননি, আল্লাহ্ আপনাকে পাঠিয়েছে”।ঘোমটা সরালেন, খুব স্মার্টলি বলতে থাকলেন “স্যার আমি রেবেকার মা। আমার রেবেকা ভাল আছে, ওর একটা ছেলে হয়েছে ১ সপ্তাহ আগে। আর কয়েকদিন পর ছেলে নিয়ে আমি আর এর ওর মা আপনার কাছে যেতাম”। বলতে থাকলেন জামাইও এখন ভাল আয় করে, সিএনজি চালায়। বাচ্চা ওদের বাড়ীতেই হয়েছে। আমাকে একখান শাড়ী কিনে দিয়েছে জামাই। বলতেই থাকলেন “স্যার আল্লাহ্ যদি আপনাকে এখানে না পাঠাবে তাহলে আপনি এখানেই বা আসবেন কেন, আর আমার ঘরের সামনে এই ফাঁকা জায়গায় গাড়ীই বা থামাবেন কেন?”মহিলাকে চিনলাম।সব মনে পড়ল।

উনি মাতৃসুলভ মমতায় আমার গায়ে ফু দিলেন, দোয়া করতে থাকলেন। আমার বন্ধু তখন বিস্ময়ে হতবাক, হাতে ক্যামেরা। হঠাৎ ছবি তুলতে উদ্যত হল। ইশারায় নিষেধ করলাম। সব ছবি তুলতে হয়না। এত উচ্চমার্গের ছবি আমার মত পাপী তাপির জন্য নয়,রাখার মত ফ্রেমও ইহলোকে নাই। এ ছবির স্থান তো অন্য কোন জগতে।

কখন যে আমার, আমার বন্ধুর এমনকি আমরা কঠিন হৃদয় উপজাতি ড্রাইভার আর বডিগার্ডের চোখেও হঠাৎ বন্যা এল বিঝতে পারিনি। মনে মনে খালি বললাম আলহামদুলিল্লাহ্। হে পরোয়ার দিগার আপনি রাহমানুর রাহিম। আমার জন্য আপনার অসীম দয়া। একটা মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আর কিছু কি অর্জন করার দরকার আছে? আমার তো মনে হয় নাই।

আমি নিতান্ত সাধারন পরিবারে জন্ম নেয়া অতি সাধারন একজন মানুষ। গর্ব করার মত তেমন কিছুই আমার নেই। আমার জবটা নিয়ে আমার অনেক গর্ব। গর্ব করেই সব সময় বলতাম বা বলি ‘‘আই এম এ পুলিশ অফিসার বাই চয়েস এন্ড অফ কোর্স নট বাই চান্স’’।

এইসব টুকরো স্মৃতি আছে বলেই জীবনকে এত ভাললাগে,বেঁচে থাকতে ভালবাসি।আমার কন্ঠে সুর নাই। তবুও মন থেকেই গাইতে থাকি

“আমি অকৃতি অধম বলেও তো
কিছু কম করে মোরে দাওনি।
যা দিয়েছো তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাওনি।

ঢাকা ০৪ মে ২০২০
(রেবেকা নামটি কাল্পনিক)
(চলবে…..)

(স্হান কাল পাত্রের সাথে কারো ঘটনা মিলে গেলে তা কাকতালীয়)






Shares