Main Menu

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন : শ্রমিক নেতা হত্যায় গার্মেন্টসে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে

+100%-

গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল দু’বছর আগে। গত বৃহস্পতিবার ঘাটাইলে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে- তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ঘটনার তদন্তের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটনের শ্রমিকদের সংগঠন। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে। ওদিকে আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ও শ্রমিকদের মধ্যে ফের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৯ই এপ্রিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘কিলিং অব বাংলাদেশী লেবার অর্গানাইজার সিগন্যালস অ্যান এস্কেলেশন ইন ভায়োলেন্স’ শীর্ষক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টটি লিখেছেন জুলফিকার আলী মানিক ও বিকাশ বাজাজ।

এ ছাড়া অন্যান্য বিদেশী মিডিয়ায়ও এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে- নিম্ন বেতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে অংশ নেয়ায় দু’বছর আগে আমিনুল ইসলাম নামে একজন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির একজন সংগঠক। এ গ্রুপটি শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে উন্নত পরিবেশের জন্য আন্দোলন করছে। গত সপ্তাহে ঢাকার কাছেই আমিনুল ইসলামের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। শ্রম অধিকার বিষয়ক পরামর্শক ও পুলিশ গত সোমবার এ কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ওয়ালমার্ট, টমি হিলফিগার এবং এইচএন্ডএম-এর মতো প্রতিষ্ঠানের পোশাক প্রস্তুত করে। কিন্তু আমিনুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রুমিকদের গ্রুপ ও গার্মেন্টস কারখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রায় মিইয়ে যাওয়া উত্তেজনা ফের জেগে উঠতে পারে।

আমিনুল ইসলাম টেক্সটাইল কারখানার একজন শ্রমিক। তাকে ২০১০ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি এবং অন্য শ্রমিকরা অভিযোগ করেছিলেন- পুলিশ এবং গোয়েন্দারা তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। সর্বশেষ আমিনুল ইসলামকে গত বুধবার ওই আশুলিয়ার কাছে জীবিত দেখা গিয়েছিল। পরের দিন বৃহস্পতিবার ওই স্থানের ৬১ মাইল উত্তরে ঘাটাইলে একটি পুলিশ স্টেশনের কাছে রাস্তার পাশে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। পুলিশ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এ কথা বলেছেন। ওই সময় ঘাটাইলের স্থানীয় পুলিশ লাশ শনাক্ত করতে পারেনি। ফলে তারা তার ছবি তুলে রেখে দাফন সম্পন্ন করে। পরে নিহত আমিনুল ইসলামের ভাই রফিকুল ইসলাম একটি জাতীয় পত্রিকায় ছবি দেখে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন।

এরপর গত সোমবার বিকালে কবর থেকে আমিনুল ইসলামের লাশ ফের তোলা হয় এবং তা দিনশেষে গ্রামের বাড়ি কালিয়াকৈরে দাফন করা হয়। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক। রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আমরা তার হাত থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। গোঁড়ালি থেঁতলে দেয়া হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। বিশ্বে গার্মেন্টস রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। সেখানে শ্রমিকের বেতন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তার তুলনায় বাংলাদেশে বেতন কাঠামো অনেক কম। এ শিল্প খাত থেকে দেশ অনেক সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক দেশ।

গত বছর বিদেশে তৈরী পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ১৮০০ কোটি ডলার। কিন্তু এই শিল্প শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ ও বিক্ষোভে মাঝেমধ্যেই ধাক্কা খাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র পর্যবেক্ষণকারী গ্রুপ ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে সামপ্রতিক সময়ে কোন ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিককে হত্যার বিষয়ে আমরা জানি না।

বিক্ষোভের সময় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে মারা যাওয়ার কথা আমরা জানি। তবে কোন শ্রমিককে সমপ্রতি হত্যা করা হয়েছে কিনা তা আমরা জানি না। এমনিতেই দেশে শ্রমিক অধিকারের দুরবস্থা তার ওপর এমন ঘটনা সেই অবস্থার আরও অবনতি ঘটাবে। শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের অনেক কারখানায় এত কম বেতন দেয়া হয়, যা দিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। এমনিতেই দেশে শতকরা ১০ ভাগ মুদ্রাস্ফীতি। তারা গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তার মানদণ্ডেরও তীব্র সমালোচনা করেন। যথোপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেয়ায় সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে কয়েক ডজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টসে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই যুবতী নারী।

কম বেতন সত্ত্বেও তারা ব্যাপক সংখ্যায় এই গার্মেন্টস কারখানার কাজে যোগ দিচ্ছেন। এই কারখানাগুলোর বেশি ভাগই ঢাকায় ও এর চারপাশে। তারা এই কাজটিকে পরিবারের উপার্জনের একটি পথ হিসেবে দেখে থাকেন। তাদের অনেকেই ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এটাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে নিয়েছেন। সোমবার এক ই-মেইল বার্তায় ওয়ালমার্ট এবং টমি হিলফিগার জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এইচঅ্যান্ডএম এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, আমিনুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির সংগঠক। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। নীতিনির্ধারকরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম বর্ধিত বেতন কাঠানো দাঁড় করাতে না পারায় ২০১০ সালের বিক্ষোভে এই গ্রুপটি নেতৃত্ব দিয়েছিল।

অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোও একই আহ্বান জানিয়েছিল। পরে সরকার নিম্নতম বেতন কাঠামো মাসে ৩০০০ টাকা (বর্তমান মুদ্রাবিনিময় হার অনুযায়ী যা ৩৬ ডলারের সমান) নির্ধারণ করে। ১৬৬২.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ওই বেতন কাঠামো দাঁড় করা হয়। আমিনুল ইসলামের মতো অন্য শ্রমিক নেতারা নিম্নতম মজুরি কমপক্ষে ৫০০০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছিলেন। তবে, অনেক গার্মেন্টস কারখানার মালিক বলেছিলেন- তা করা হলে তাদেরকে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। ২০১০ সালের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করেন। কিন্তু নিম্নতম মজুরি কাঠামো ৩০০০ টাকা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার আর কোন প্রতিবাদ সহ্য করবে না।

আমিনুল ইসলাম ও আরও কয়েক ডজন শ্রমিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পরপরই তাদের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা উসকে দেয়ার অভিযোগ গঠন করা হয়। তবে আমিনুল ইসলাম ও অন্যরা সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি ও সিনিয়র অন্য দু’জন শ্রমিক নেতা কল্পনা আখতার ও বাবুল আখতারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা মুলতবি আছে। সোমবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, আমিনুল ইসলামকে হত্যার মাধ্যমে কম বেতনভোগী ও প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করা শ্রমিকদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি ও অন্য শ্রমিক নেতারা বলেন, পুলিশ যদি গ্রেপ্তার না করতো তাহলে তারা আন্দোলন থেকে পিছু হটতেন না।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের মূল গ্রুপ বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন আমিনুল হত্যার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে সোমবার। ওয়াশিংটনেও শ্রম অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এ মৃত্যুর তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে এবং তারা যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে পক্ষপাতিত্বমূলক নয়, পূর্ণাঙ্গ একটি তদন্তের জন্য বাংলাদেশকে চাপে রাখতে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে শ্রমিক নেতারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।

মানবাধিকার বিষয়ক  সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে কলম্বিয়ায় ২৮৮০ জনেরও বেশি শ্রমিক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের ইউনিয়ন এসব হত্যাকে কলম্বিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু গত অক্টোবরে কংগ্রেস কলম্বিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের অনুমোদন দিয়েছে।







Shares