Main Menu

ফিরে দেখা ইতিহাস (জেঃ জিয়াউর রহমান, একজন কর্নেল তাহের এবং অন্যান্য) :- (প্রথম পর্ব) !!

+100%-

snatcher-1446718094-cc8e5cd_xlarge

ওয়েব থেকে নেয়া::২৪ শে নভেম্বর, ১৯৭৫
ঢাকা, বাংলাদেশ
চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিসট্রেটর এবং সেনাপ্রধান জেঃ জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহের সহ জাসদের নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। এই কর্নেল তাহেরের সহযোগিতাতেই জেঃ জিয়া কিছুদিন আগে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। পুলিশ কর্নেল তাহেরের বাসভবন ঘিরে ফেললো। পুলিশের দলটির নেতৃত্বে থাকা অফিসারটি বাসার ভেতরে প্রবেশ করে বললেন,

– “স্যার, আপনাকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে। জেঃ জিয়াউর রহমান আপনার সাথে আলোচনা করবেন।“

কর্নেল তাহের বিস্মিত হলেন এ কথা শুনে। উনি সেই পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন,

– “জেঃ জিয়ার কাছে যেতে হলে আমার পুলিশ প্রহরার কি দরকার?”

তবে পুলিশ সেই অফিসার তাকে জানালেন যে তাকে সাথে করে নিয়ে যাবারই নির্দেশ আছে। কর্নেল তাহের এ সময় জেঃ জিয়াকে টেলিফোন করেন কিন্তু তাকে বলা হলো যে জেঃ জিয়া সেখানে নেই। কর্নেল তাহের এরপর ডেপুটি চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর মেজর জেঃ এরশাদকে টেলিফোন করলে জেঃ এরশাদ তাকে জানালেন যে এটা পুলিশের পদক্ষেপ এবং উনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। সেই পুলিশ অফিসার তাকে জীপে তুলে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে নিয়ে এসে সেখানের জেল হাজতে রাখলেন। এরপর তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র উল্লেখ করা হলো যে, উনি সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রুপান্তরের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কিছু সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন।

এর বাইরে নিরাপত্তা বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে অনেক জাসদ নেতাকর্মী এবং সমর্থককে গ্রেফতার করলো। সামরিক বাহিনীর ২২ জন সদস্যকেও সরকার উৎখাতের অপচেষ্টা এবং সামরিক বাহিনীতে ক্যু এর জন্য উস্কানীর অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো। এদের বেশিরভাগই জাসদ কিংবা এর সামরিক শাখা গনবাহিনীর সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে আসম আব্দুর রব, মেজর এমএ জলীল এম বি মান্না, হাসানুল হক ইনু, মোহাম্মদ শাহজাহান প্রমুখ ছিলেন। অন্যদের মধ্যে কর্নেল তাহেরের দুই ভাই মেজর আবু ইউসুফ খান ও প্রফেসর আনোয়ার হোসেন এবং মেজর জিয়াউদ্দীন আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, ডঃ আখলাকুর রহমান, কেবিএম মাহমুদ ও সালেহা বেগমও ছিলেন। এর দুই সপ্তাহ পর কর্নেল তাহেরকে রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন জেঃ জিয়া। একটি সামরিক হেলিকপ্টারে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলোl এখানেই তিনি জীবনের বাকীটা সময় বন্দী হিসেবে কাটাবেন।

এর সময়ে জেঃ জিয়ার অধীন সামরিক সরকার ছোট বড় নানা বিদ্রোহ সামাল দিতে সক্ষম হলো। এরমধ্যে বড় দুটি ক্যু প্রচেষ্টা হয় মার্চ মাস, ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে এবং আরেকটি এরপরের মাসে বগুড়াতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী লেঃ কর্নেল ফারুক রহমানের ১ম বেঙ্গলের সেনাদের দ্বারা। জেঃ জিয়া চালিয়ে পুরো ইউনিটসহ নিঃচিহ্ন করে দেবার হুমকী দেন লেঃ কর্নেল ফারুককে। এরপর বেঙ্গল ল্যান্সার আত্মসমর্পন করে এবং জেঃ জিয়া বেঙ্গল ল্যান্সারই বিলুপ্ত করে দেন।

এরপর সেনাবাহিনিতে কিছু মাত্রায় শৃংখলা ফিরে আসে। এ সময় সামরিক বাহিনীর উপরের স্তরের অফিসারেরা এবং বেসামরিক আমলারা জাসদের এবং তাদের সমমনা দলগুলোর তৎপরতা কমাতে জেঃ জিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন এনএসআই এর মহাপরিচালক এ এম এস সফদার এবং স্বরাস্ট্র সচিব সালাউদ্দীন আহমেদ। এই দুইজন কর্মকর্তাই ছিলেন আইয়ুব খানের শাসনামলের অন্যতম জেষ্ঠ্য গোয়েন্দা এবং আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপর শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর নতুন সরকারের প্রসাশনে তাদের আসন পাকা করে ফেলেন। সেনাবাহিনীতে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগে ক্ষোভ ছিলো ৭ই মার্চের অভ্যুত্থানের সময়, সে ব্যাপারে প্রতিশোধ নিতে অনেক অফিসার চাপো দিচ্ছিলো। আর আমলাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের দোসর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগসের রদবদলের পরে সেই শুন্যস্থান তাদের দিয়েই পুরন করা হয়। লরেন্স লিফতসুলজ এ ব্যাপারে লিখেছিলেন,

– “এই লবিই সম্মিলিতভাবে বিচারের জন্য জিয়াকে চাপ প্রদান করতে থাকে। এবং তিনিও সামরিক বাহিনীতে তার প্রধান প্রতিপক্ষকে দমাতে ইসলামপন্থীদের ইচ্ছা মোতাবেক চলেন এবং বিচারের নির্দেশ দেন।“

৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৭৫
ঢাকা, বাংলাদেশ
প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে আজকে ১৯৭২ সালের “কোলাবরেটরস এক্ট, ১৯৭২” বাতিল করা হলো। ২৪ শে জানুয়ারী, ১৯৭২ সালে জারী করা এই আইনের অধীনে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রায় লাখখানেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং এদের মধ্যে ২৮৮৪ জনকে আদালতে বিচারের আওতায় আনা হয়। যাদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমানীত হয়। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেন এই আইনের মাধ্যমে লঘু কিংবা গুরু অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়াদের প্রতি। তবে যারা ধর্ষন, হত্যা এবং লুন্ঠনের মত অপরাধে দোষী প্রমানিত হয়েছিলেন তাদের মুক্তি দেয়া হয়নি। সেই সাধারন ক্ষমার আওতায় অভিযোগ প্রমানিত না হওয়া বাকী ২০৯৬ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে রাস্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা ঘোষনা করা হলে যেকোন অপরাধের অভিযোগে জনগনের আদালতে বিচার চাইবার অধিকার ছিলো। সাধারন ক্ষমা ঘোষনার পরেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই আইন কার্যকর ছিলো কিন্তু এর অধীনে আর একটাও মামলা করা হয়নি। এই যুক্তি দেখিয়েই এই আইন প্রত্যাহার কুরে নেয়া হয়। তবে সাধারন জনগনের মনে এই আইন বাতিল করা ক্ষোভের জন্ম দিলো। সাধারন জনগন একে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক দালালদের প্রতি নিঃশর্ত ক্ষমা বলেই মনে করলো, যারা ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যার সাথে জড়িত ছিলো। এই আইন থাকলে যে দেশের কোন ক্ষতি হতো এ ব্যাপারে কোন যুক্তিই দেয়া যায়না। কিন্তু এর মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেইসকল মানুষের ফিরে আসবার সুযোগ তৈরি হলো যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সরাসরি সহযোগিতা করেছিলো। এই আইন বাতিল তাই দেশের ইতিহাসেরই আরেকটা কলংকজনক অধ্যায় হয়ে রইবে।

২২শে মে, ১৯৭৬
ঢাকা, বাংলাদেশ
আজ কর্নেল তাহেরকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে আবার কড়া নিরাপত্তার সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হলো। কর্নেল তাহের সহ অন্য অভিযুক্তদের কোন ধরনের আইনী সহায়তা নেবার কিংবা আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগের সুযোগ দেয়া হবেনা এরপর পুরোটা সময় জুড়েই। প্রকাশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কোন বিধিনিষেধ না থাকলেও কোন সংবাদপত্রই এ ব্যাপারে কোন খবর ছাপার প্রয়োজন মনে করেনি কারনটাও আমরা সবাই জানি।

এরপর ১৫ জুন একটি বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করে কর্নেল তাহের এবং অন্যান্যদের বিচারের ব্যবস্থ্যা নেয়া হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্নেল ইউসুফ হায়দার হলেন এর চেয়ারম্যান। ২১শে জুন ১৯৭৬ সালে গোপন বিচার শুরু হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরেই। ক্যামেরার সামনে গনমাধ্যম কর্মীদের অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ শুরু হলো যা সাধারন বিচার ব্যবস্থার নিয়ম বহির্ভুত ছিলো। কর্নেল তাহাদের পক্ষে নিয়োগ করা হলো আইনজীবি আতাউর রহমান এবং রাস্ট্রপক্ষে এটিএম আফজালকে। আদালতের কার্যক্রম শুরু করবার আগে দুই আইনজীবিকেই শপথ নিতে হতও যে তারা এ বিচারকার্য্যের ব্যাপারে সম্পুর্ন গোপনীয়তা বজায় রাখবেন এবং বিচার প্রক্রিয়ার কোনকিছুই কারো কাছে প্রকাশ করবেন না। কর্নেল তাহেরের পক্ষের আইনজীবিকে সাতদিন সময় দেয়া হলো মামলার পক্ষে যুক্তিপ্রমান উপস্থাপন করতে, যদিও এই মামলার কার্যক্রম চলছিলো ৬ মাস ধরে।.

আর এভাবেই পুর্ব পাকিস্তান কিংবা অধুনা বাংলাদেশের ইতিহাসেই প্রথমবারের কোন বিচার কার্যক্রম জেলখানার দেয়ালের ভেতর অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো।
.
২৮ শে জুন বিচার কার্যক্রম আবার শুরু হলো। কর্নেল তাহেরের অসম্মতি থাকলেও থাকলেও তাকে এই আদালতে হাজির করা হুয়। কর্নেল তাহের বলেছিলেন,

– “আমাকে যদি বিচার করতেই হয় তবে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের মাধ্যমে করা হোক। ইউসুফ হায়দারের মত যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদের দিয়ে নয়।“

তবে কর্নেল তাহেরের আইনজীবিরা তাকে রাজী করা সক্ষম হন। তাদের ধারনা ছিলো বিচার নিরপেক্ষ হবে। অবে পরবর্তীতে এ নিয়ে তারাও আফসোস করবেন। তারা বুঝতে পারবেন যে বিচারের রায় অনেক আগেই নির্ধারন করে রাখা হয়েছিলো।

১৭ই জুলাই, ১৯৭৬
ঢাকা, বাংলাদেশ
বিকেল ইনটার সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ আদালত তাদের রায় ঘোষণা করলো। কর্নেল তাহেরকে প্রতারনা এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক মতবাদ ছড়িয়ে দেবার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে এ কারনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। আর যোলজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হলো, যাদের মধ্যে ভাই মেজর আবু ইউসুফ খান এবং মেজর এমএ জলিলও ছিলেন।। তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হলো। তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করবার নির্দেশ দেয়া হলো। উনার আরেক ভাই প্রফেসর আনোয়ার হসেন, হাসানুল হক ইনু, আসম আব্দুর রব এবং মেজর জিয়াউদ্দীনকে ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয় অর্থ জরিমানা সহ তাদের অনুপস্থিতিতেই।

তবে এই বিচার প্রক্রিয়া পশ্চিমা গনমাধ্যমে ব্যপকভাবে প্রচারিত হয় যা সরকারের ধারনার বাইরে ছিলো। কর্নেল তাহের বিচারেররায় শুনে হাসিতে ফেটে পরেন। উনাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আট নম্বর সেলে স্থানান্তর করা হলো। এখানে কেবল তাদেরই রাখা হয় যাদের ফাসির আদেশ হয়। তার আসেপাশে আরো তিনজন ফাসির আসামী ছিলেন। সেই সেলে নিয়ে যাবার পর সেটা সম্পর্কে কর্নেল তাহের বললেন,

– “এটা ছোট একটা সেল, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ঠিকঠাকই বলা যায়।“

সরকার পক্ষের চীফ প্রসিকিউটর এএফএম আফজাল এই বিচারের রায় সম্পর্কে বলবেন,

– “এমন রায় আমার নিজের কাছেও অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিলো। আমি মৃত্যুদন্ড চাইনি। এমন কোন আইন ছিলনা যার অধীনে কর্নেল তাহেরকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ড দেয়া যেতো।“

এরপরের দিন সরকার সংবাদপত্রগুলোকে নির্দেশ দিলো রায়ের ব্যাপারে সরকারী বক্তব্য ছাপতে। বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম ছিলো, “তাহের টু ডাই”। এসব পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের নেতৃত্বদানের জন্য এই পরিনতি ভোগ করতে হচ্ছে। তবে তারা কেউ এটা লিখলোনা যে এই কর্নেল তাহেরের নির্দেশেই জেঃ জিয়াকে মুক্ত করা হয়।

১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬
ঢাকা, বাংলাদেশ
কর্নেল তাহের কারাগার থেকে তার জীবনের শেষ চিঠিটি লিখলেন পরিবারের উদ্দেশ্যে। যাতে লেখা ছিলোঃ


শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান, আমার ভাই ও বোনেরা,
গতকাল বিকালবেলা ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়া হলো। আমার জন্য মৃত্যুদণ্ড । ভাইজান ও মেজর জলিল যাবজ্জীবন কারাদন্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। আনোয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়া ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা। সালেহা, রবিউল ৫ বছর সশ্রম কারাদ-, ৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। ডা. আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্নাসহ ১৩ জনকে মুক্তিদান। সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মতো তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করল।

হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ সাহেব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি তাঁকে সান্ত¦না দিতে তিনি বললেন, ‘আমার কান্না এ জন্য যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণা করতে পারল।’ বোন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে যেয়ে কাঁদতে শুরু করল। সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম, ‘তোমার কাছ থেকে এ দুর্বলতা কখনই আশা করি না।’ সালেহা বলল, ‘আমি কাঁদি নাই, আমি হাসছি।’ হাসি-কান্নায় এই বোনটি আমার অপূর্ব। জেলখানার এই বিচার কক্ষে এসে প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কোন জাতি এর মতো বোন সৃষ্টি করতে পারে।

সশস্ত্র বাহিনীর অভিযুক্তদের শুধু একটি কথা, ‘কেন তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো না’। মেজর জিয়া বসে আমার উদ্দেশে একটি কবিতা লিখল। জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, ‘তাহের ভাই লাল সালাম’। সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। জেলখানার উঁচু দেয়াল এই প্রতিধ্বনি কি আটকে রাখতে পারবে? এর প্রতিধ্বনি কি পৌঁছবে না আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়।

রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হঠাৎ হতবাক হয়ে গেলেন। তারা এসে আমাকে বললেন, যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না, তারা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন। কারণ, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন। আমি তাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো আবেদন করা চলবে না। এই রাষ্ট্রপতিকে আমিই রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছি। এই দেশদ্রোহীদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না।’

সবাই আমার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শুনতে চাইল। এর মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আমি বললাম, আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লোভ, লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপানাদের মাঝে থাকি, তখন সমস্ত ভয়, লোভ, লালসা দূরে চলে যায়। আমি সাহসী হই, আমি বিপ্লবের সাহসীরূপে নিজেকে দেখতে পাই। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে প্রবেশ করে। তাই আমাদের একাকিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সে জন্যই আমাদের সংগ্রাম।

সবাই একে একে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখ। বেশ কিছু দিন সবাই একত্রে কাটিয়েছি। আবার কবে দেখা হবে। সালেহা আমার সঙ্গে যাবে। ভাইজান, আনোয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের তো আমি জানি। আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য তাদের অভিনয়। বেলালের চোখ ছলছল করছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায়। (বেলাল-তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন রহমান বেলাল) জলিল, রব, জিয়া আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। এই আলিঙ্গন অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে দৃঢ় আলিঙ্গনে আমরা সমগ্র জাতির সঙ্গে আবদ্ধ। কেউ তা ভাঙ্গতে পারবে না। সবাই চলে গেল। আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম, সালেহা চলে গেল তার সেলে। বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি ও রাজবন্দিরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বন্ধ সেলের দরজা-জানালা দিয়ে। মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যরা দেখাল আমাকে বিজয় চিহ্ন। এই বিচার বিপ্লবীদের তাদের অগোচরে এক করল।

ফাঁসির আসামীদের নির্ধারিত জায়গা ৮ সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরও তিনজন ফাঁসির আসামি, ছোট্ট সেলটি ভালই বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই, তাতে লজ্জার তো কিছুই নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতো বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে।

নিতু, যিশু ও মিশুর কথা, সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি। কিন্তু আমার সমগ্র জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি, শত সহ¯্র উলঙ্গ, মায়া, ভালোবাসা বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালি জাতির জন্য উদ্ভাসিত সূর্যের আর কত দেরি। না, আর দেরি নেই। সূর্য উঠল বলে। এ দেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব, যা আমার জাতিকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে, এর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে।
আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি তা করতে পারে। কেউ পারবে না।

আজকের পত্রিকা এলো। আমার মৃত্যুদ- ও অন্যদের বিভিন্ন শাস্তির খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতত্বে ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ঘটে, আমার নির্দেশে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। আমার দ্বারা বর্তমান সরকার গঠন হয়। সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোনো উল্লেখই ছিল না। অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান, জুলমত আলী ও অন্যরা যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান ও অন্যদের বলবে, সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে তারা যদি ব্যর্থ হন, তবে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
তোমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আদর নিও। বিচার কক্ষে বসে জিয়া অনেক কবিতা লেখে, তারই একটি অংশ

‘জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম।
জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম।
জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম।
পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।’

তোমাদের,
তাহের
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল

কর্নেল তাহেরের ফাসির রায়ের বিরুদ্ধে তার আইনজীবিরা প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেন। সেই সময়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে পুনরায় আপীল করবার কোন নিয়ম ছিলনা। তবে প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এ এম সায়েম এই আবেদন নাকচ করে দেন। মাত্র ৫ বছর আগেই মৃত্যুদন্ডের ব্যাপারে উনিই এক যুগান্তকারী আদেশ শুনিয়েছিলেন। এক হিন্দু ব্যক্তির ফাসির রায় চেয়ে তার কাছে বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হলে তিনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন আসামীপক্ষকে আরো সময় নিয়ে তাদের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য। উনি আদেশে উল্লেখ করেছিলেন যে, কোন আইনের অধীনেই অভিযুক্তকে তার স্বপক্ষে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করবার সুযোগ না দিয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যাবেনা। সেই বিচারপতি সায়েমই আজকে প্রেসিডেন্ট। উনি ফাসির রায় ঘোষনার মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সেই রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।

এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ নানা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থ্যা এ ব্যাপারে সরকারকে পুনবিচারের আবেদন জানায়। কোন কিছুতেই সরকারী সিদ্ধান্ত টললোনা। কর্নেল তাহের সহ অন্যান্যদের মুক্তির জন্য জাসদের ক্যাডারেরা ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরনের চেস্টা চালায়, যাতে করে তার মুক্তির বিনিময়ে অন্যদের ছাড়িয়ে আনা যায়। তবে এই প্রচেস্টা ব্যর্থ হয় ও জাসদের আরো অনেক কর্মীকে হত্যা এবং গুম করে ফেলা হয় এতে জড়িত থাকবার অভিযোগে। এরপরে ৮ই ডিসেম্বর পিটার কাস্টার্স নামের একজন ডাচ সাংবাদিককেও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকবার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তাকেও দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। তবে রাস্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করলে ডাচ সরকারের চাপের মুখে তাকে মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

২১শে জুলাই, ১৯৭৬
ঢাকা, বাংলাদেশ
ঠিক বিকেল চারটায় কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের (বীর বিক্রমের) ফাসি কার্যকর করা হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এ সময় উনার বয়স ছিলো ৩৭ বছর।বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়ে থাকবে এই ফাসির আদেশ। ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রামে অশ্রাগার লুটের দায়ে মাস্টারদা সুর্য্য সেনকে ফাসিতে ঝুলাবার ৪২ বছর পর বাংলার মাটি আরেকটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড দেখলো।

উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের মত এ অংশেও ব্যাপারটা এমন ছিলনা যে রাজনৈতিক কারনে হত্যাকান্ড ঘটতো না। তবে কারাগারে আটক থাকা অবস্থ্যায় কোন বিপ্লবীকে এমন পরিনতির সম্মুক্ষীন হতে হয়নি অনেক বছর ধরেই। কর্নেল তাহেরের ফাসির মাত্র ১০ দিন পর সরকারও এই ভুল বুঝতে পারে। ৩১ শে জুলাই ১৯৭৬ সালে আইন মন্ত্রনালয় মার্শাল ল’ ডিক্রীর ২০ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক মতবাদ ছড়িয়ে দেয়াকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবার মত অপরাধ হিসেবে পরিবর্তিত করে প্রকাশ করে। এই সংশোধনী আজও বলবত আছে।

কর্নেল তাহেরের দ্রুত বিচার এবং মৃত্যুদন্ড জেঃ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের প্রথম দিকের কিছু নমুনা হয়ে থাকবে। এর পরে এমন ঘটনা আরো হাজার হাজার ঘটবে এবং সেগুলো সম্পর্কে কেউ কোন প্রশ্ন করবার সুযোগই পাবেনা।

কর্নেল তাহের যেভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝে রাজনৈতিক মতবাদ কিংবা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেটা সমর্থনযোগ্য না। রাজনৈতিক ভাবে কর্নেল তাহেরকে জেঃ জিয়া সবচেয়ে বিপদজনক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং সরিয়ে দেন। যদিও ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব অথবা পট পরিবর্তনের প্রধান রুপকার এই কর্নেল তাহেরই ছিলেন।

মার্চ মাস, ১৯৭৬
ঢাকা, বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীতে সম্ভ্যাব্য বিদ্রোহের প্রতিকারমুলক ব্যবস্থ্যা হিসেবে আমুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো সেনাবাহিনীর ইউনিট সমুহ। যেসব ইউনিওগুলো থেকে হুমকীর সামান্যতম আশংকা আছে সেগুলোকে ঢাকা থেকে এবং নিজেদের থেকেও দূরে দূরে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়া হলো সারা দেশব্যাপী। ঢাকার ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেডের ইউনিট সমুহকে আলাদা আলাদা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে ৯ম পদাতিক ডিভিশনকে ঢাকার প্রতিরক্ষার দ্বায়িত্ব দেয়া হলো।

জেঃ জিয়া এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় বাঁধার মুখোমুখি হলেন ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারকে ঢাকা থেকে বগুড়ায় স্থানান্তরের ব্যাপারে। তারা এ ব্যাপারে সরাসরি তার অসম্মতি জানিয়ে দেন। তবে বিমান বাহিনী প্রধান এবং ডেপুটি চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তোয়াব তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার হুমকী দিলে তারা স্থানান্তরে রাজী হয়। এদিকে চট্টগ্রামে বেঙ্গল রেজিমেন্টে অসন্তোষ দেখা দিলে তাও কঠোর হস্তে দমন করা হয়।

তবে এ সময়ে এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে জামাতে ইসলামীর এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে দেখা যায়, যাতে তিনি ধর্ম নিপরেক্ষতা ত্যাগ করে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রুপান্তরিত করবার কথা বলেন। নোউবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এমএইচ খানও এ ব্যাপারে সম্মত ছিলেন। এই ঘটনার যগসুত্র অন্যখানে, দেশ কোনদিকে এগিয়ে যেতে পারতো কিংবা যাচ্ছিলো আমরা সেটা অনুমান করে নিতে পারি এ থেকে এবং আর মাত্র একমাস পরে ঘটে যাওয়া আরো কিছু ঘটনা থেকে।

৩০শে এপ্রিল, ১৯৭৬
বগুড়া, বাংলাদেশ
কিছুদিন আগে বগুড়ায় স্থানান্তরিত হয়ে আসা ১ম বেঙ্গলের মাঝে আবার এসে উপস্থিত হয়েছেন লেঃ কর্নেল ফারুক রহমান। এর আগে ৩রা নভেম্বর জেঃ খালেদ মোশাররফের ক্যু এর সময় গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানকারী লেঃ কর্নেল ফারুক এবং আরো ছয়জন জুনিয়র অফিসার দেশত্যাগের সুযোগ পান। এদেরকে ছয় মেজর নামে ডাকা হতো। তাদের আবার দেশে আগমনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন জেঃ জিয়া। তবে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে এই অফিসারদের বেশ কয়জন গোপনে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সরকারের মধ্যেরই কিছু ব্যক্তি তাদের এই ব্যাপারে সাহায্য করেন।

লেঃ কর্নেল ফারুক তার ইউনিটে গোপনে ফেরত এসে আবার উদ্দীপনাপুর্ন বক্তব্য দিলেন। তারা বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য আক্রমন শুরু করলো। এ সময় লেঃ কর্নেল ফারুক একটী ইসলামিক রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথ জানালেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের অংশ দাবী করে বসলেন।

তবে জেঃ জিয়া লেঃ ক্ররনেল ফারুকের পিতামাতা এবং বোনকে আটক করে নিয়ে আসেন এবং তাদের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠালেন যে তার সেনাদের আত্মসমর্পনের বিনিময়ে তাকে দেশত্যাগের সুযোগ দেয়া হবে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি দাড় করানো হবেনা। আর সেটা না মানা হলে জেঃ জিয়া হুমকী দিলেন যে পুরা ইউনিটকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে।

জেঃ জিয়া এই দানেও জিতে গেলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে পদত্যাগে বাধ্য করলেন জেঃ জিয়া। কারন এই এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবই ওই মেজরদের আবার দেশে ফিরবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার জায়গায় নতুন বিমান বাহিনী প্রধান হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল এম খাদেমুল বাশার। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে ইউরোপে নির্বাসনে পাঠানো হলো, আর ওই মেজরদের আবারো লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। ওই মেজরদের শক্তির প্রধান উৎস ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারকে বিলুপ্ত করে দিলেন জেঃ জিয়া। ইউনিটের ৫০০ সদস্যের অর্ধেকেরও বেশি সদস্যকে নানা অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি দাড় করানো হলো। তাদের কোন খোজ এরপরে আর পাওয়া যাবেনা।

লেঃ কর্নেল ফারুককে এরপরে বিদেশী মিশনে কুটনৈতিকের পদ দেয়া হয়, তবে তাকে আর দেশে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি জেঃ জিয়ার শাসনামলে। তাকে খুব সম্ভবত দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ১৯৭৭ সালের শেষদিকে বেশ অনেকদিন আটক রাখবার পর। এরপরে লেঃ কর্নেল ফারুক জেঃ এরশাদের সরকারের সময় দেশে ফেরার সুযোগ পান এবং ১৯৮৬ সালে ফ্রিডম পার্টি নামের রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পার্লামেন্টের সদস্যও হন।

এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে দুই মেজরের চাপাচাপিতে দেশে এনে বিমান বাহিনীর প্রধান করা এবং তাদের সহ অভ্যুত্থানকারীদের ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে সুসম্পর্ক এবং ইসলামিক রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিন্ন প্রচেষ্টা এটাই ভাবতে বাধ্য করে যে ১৫ই আগস্টের ক্যু কারীরা একসুত্রে গাথা ছিলো। জেঃ জিয়া সম্ভবত সুযোগের সদব্যবহার করে এবং পরিস্থিতির কারনে সামনে চলে আসেন। এই জিয়াই পরে ওই অভ্যুত্থানকারী সকলকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। জেঃ জিয়া তার সামনে এমন কাটা রাখতে চাননি যারা বিপদের কারন হতে পারে। উনার সম্পুর্ন শাসনামল জুড়েই এই সরিয়ে দেয়ার কিংবা সকল প্রতিপক্ষকে সমুলে উৎপাটনের ধারা বজায় রাখতে দেখা যায়।

২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
ঢাকা, বাংলাদেশ
জাপানীজ রেড আর্মীর একটা দল জাপান এয়ারলাইন্সের (ফ্লাইট নং ৪৭২) একটা ডিসি-৮ বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। বিমানটি ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে প্যারিস থেকে টোকিও হানেদা বিমানবন্দরের পথে ভারতের বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বাই) যাত্রাবিরতি করে। বোম্বাই থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষন পরেই ড়েদ আর্মির পাচজন সদস্য অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করে এবং ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার নির্দেশ দেয়। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরনের পর হাইজ্যকাররা যাত্রী এবং ক্রুদের জিম্মী করে রাখে। তারা এই ছিনতাইয়ের কারন হিসেবে তাদের সহযোদ্ধা কমরেড হিদাকাকে জর্ডানের সরকার কর্তৃক আটকের পর নির্যাতন করে হত্যার পাওটা পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করলো।

এই জেআরএ কিংবা জাপানীজ রেড আর্মি ছিলো একটা কম্যুনিস্ট সশস্ত্র দল যারা মাউন্ট হোরানায় তাদের প্রশিক্ষন শিবিরে নিজেদের দলেরই বিদ্রোহী ১২জন কর্মীকে জবাই করে হত্যা করবার ঘটোনার কারনে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলো। হাইজ্যাকাররা তাদের ভাষায় এমন এক স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়, যা তাদের চোখে ছিলো স্বাধীন, ইসলামিক এবং জনপ্রিয় বাংলাদেশ, যারা তাদের দাবীর প্রতি সহানুভুতিশীল হবে। তবে তারা জানতোনা যে পর পর বেশ কটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখানে এখন গনতান্ত্রিক সরকারের বদলে সামরিক শাসন চলছে।

তবে বিমান বাহিনী প্রধান, ডেপুটী চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ সাহসী পদক্ষেপ নিলেন এ ব্যাপারে। উনি নিজেই সরাসরি ডানকে ছদ্মনামের রেড আর্মির মুখপাত্রের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো বিমানে জিম্মী যাত্রিদের মুক্ত করা। তবে হাইজ্যাকাররেরা তাদের প্রধান দাবিতে অবিচল ছিলেন, আর তা হচ্ছে ৬ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপন এবং তাদের আটকে রাখা ৯ জন সহযোদ্ধার মুক্তি।

আলোচনা খুবই ভদ্রভাষায় জাপানী সৌজন্য এবং বিনয়ে বিগলিত হয়েই চলছিলো। মাঝে মাঝে আলাপচারিতায় বিরতি নিতে হচ্ছিলো কারন ডানকের ইংরেজী ছিলো দুর্বল এবং ভাঙ্গা ভাঙ্গা। আলাপচারিতার প্রথমদিকের কিছু অংশ ছিলো এমনঃ


ডানকেঃ আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি। আমরা নিজেদের মধ্যে আলচনা করেছি এবং সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে সকল যাত্রীকে আমরা মুক্তি দিতে পারবোনা। এটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব আমাদের নীতির কারনে। প্রথম নীতি হচ্ছে, আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে বিমানের সুরক্ষার ব্যবস্থ্যা করা হবে এবং সেইসাথে আমাদের ও ক্রুদের। মনে করে দেখুন কেন আমরা এখানে অবতরন করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশ সরকার একটী স্বাধীন, ইসলামিক এবং জনপ্রিয় সরকার এবং আমরা বিশ্বাস করি যে আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন ও জাপানী শাসকগোষ্ঠী এবং আমাদের মধ্যে আলচনার মাধ্যম হবেন।

এ জি মাহমুদঃ ডানকে, আপনি সাধারন একটা উত্তর দিতে অনেক বেশি সময় নিয়েছেন। আমাদের একসাথে অনেক কাজ করতে হবে। আমি আপনাকে অনুরধ করছি আপনি খুব সাধারন ভঙ্গিতে ‘হ্যা’ এবং ‘না’ এর মধ্যে উত্তর দেবেন যাতে করে আপনাদের সমস্যার সমাধানে যা যা করা দরকার আমি খুব দ্রুত তা সম্পন্ন করতে পারি এবং আপনারা আপনাদের গন্তব্যে রওনা দিতে পারেন

এই দুইজন অচেনা ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমতা আর বিশ্বাস ছাড়া অন্য কোনকিছুর সম্পর্ক ছিলনা। দুইদিন ধরে এমন ধীর গতিতে আলোচনা চলবার পর পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হলো যখন একটী জাপানী এয়ারলাইন্সের ভাড়া করা বিমান ৬ মিলিয়ন ডলার এবং ৯ জন বন্দী সহ ঢাকায় এসে পৌছালো। জপানী প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকাদা ঘোষনা করলেন যে জাপান সরকার হাইজ্যাকারদের দাবী মেনে নিচ্ছে এই নীতিতে যে, মানুষের জীবন পৃথিবীর অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে মুল্যবান। ২রা অক্টোবর অর্থ এবং বন্দী বিনিময় সম্পন্ন হলো। হাইজ্যাকাররা ১১৮ জন যাত্রী এবং ক্রুকে মুক্তি দিলো।

তবে সংলাপের শেষদিকে এসে ডানকে এবং মাহমুদ দুইজনেই ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। ডানকে তিনদিন আলোচনার পর শেষদিকে এসে একের পর এক যাত্রীকে হত্যা করবার হুমকী দিচ্ছিলেন। একজন অপরজনকে ধোঁকা দিতে চাইছিলেন বলে মনে হচ্ছিলো। শেষদিকে টেলিভিশনের দর্শক শ্রোতারা বুঝতে পারছিলেন যে কন্ঠেসরে বেশ বড় পরিবর্তন এসেছে এ জি মাহমুদের। এক পর্যায়ে ডানকে দীর্ঘ্য বিরতি নিলেন। তারা যে সুরে আলোচনা শুরু করেছিলেন তা ছিলো অদ্ভুতভাবে আন্তরিক কিন্তু এক পর্যায়ে তাদের কন্ঠে অন্যরকম সুর শোনা যাচ্ছিলো। ২ তারিখই হাইজ্যাককৃত বিমানটি উড্ডয়নের চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বাঙ্গালীর বাঁধার মুখে থেমে যেতে বাধ্য হয়। বিমানের আসেপাশে সন্দেহজনকভাবে অনেক মানুষের আনাগোনা দেখে ডানকে মাহমুদকে তা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। এ সময় এ জি মাহমুদকে বলতে শোনা গেলো,

– “আমি যদি আপনাদের বলি এরা আমার লোক নয়, তবে আপনারা তাদের হত্যা করতে পারেন।“

বাংলাদেশে এবং সারা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই আলাপচারিতা আর বিমানের আসেপাশের দৃশ্য দেখছিলো। তারা এই অদ্ভুত বক্তব্যে আশ্চর্যান্বিত হলেন। কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটছিলো সেখানে যার পরিপ্রেক্ষিতে এ জি মাহমুদ এ কথা বলেছিলেন। আমরা সেটা খুব শ্রীঘ্রই জানতে পারবো।

এরপর হাইজ্যাকারেরা অক্টোবরের ৩ তারিখ বিমানটিকে আবার উড্ডয়নে বাধ্য করেন এবং কুয়েতের দিকে রওনা দেন। সেখান থেকে সিরিয়ার দামেস্কে পৌছে আরো ১১ জন জিম্মীকে মুক্তি দেয়া হয়। শেষমেষ বিমানটি আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে পৌছালে সেখানকার কর্তৃপক্ষ বিমানটি দখলে নেয় এবং বাদবাকী জিম্মীরা মুক্ত হন। তবে হাইজ্যাকারেরা পালিয়ে যী সক্ষম হয়। এরপর জাপানী সরকার পুলিশের একটা বিশেষ দল গঠন করে পরবর্তিতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে। এই ঘটনার সাথে জড়িত রেড আর্মির সদস্যদের পরবর্তী ২০ বছর ধরে খুঁজে খুঁজে একে একে আটক করা হয়।

৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
বগুড়া, বাংলাদেশ
সরকারের মনোযোগ যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে ঘুরপাক খাচ্ছে, জেঃ জিয়ার জন্মস্থান বগুড়ায় বিদ্রোহ করে বসলো ২২তম বেঙ্গলের সেনারা। ২২তম বেঙ্গলের অফিসারেরা বগুড়া এয়ারফিল্ডের দখল নিয়ে লেঃ কর্নেল ফারুক রহমানের মুক্তির দাবী জানায়। ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সেনা পৌছে অন্যান্য ইউনিটের সহায়তায় দ্রুত বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। এ সময় লেঃ হাসান সহ ১০ জন সেনা মারা যান। ২রা অক্টোবর রাতের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হয়। তবে জাপানী রেড আর্মির প্লেন হাইজ্যাকের ঘটনার মাঝেই ঢাকায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছিলো।

ঢাকায় বগুড়ার ক্যুর কারনে নিহত অফিসার এবং সেনাদের মৃতদেহ এসে পৌছালে সেনাবাহিনীর সিজিএস জেঃ মঞ্জুর সেখানে উপস্থিত সাধারন সৈনিক আর জেসিওদের মনোভাবও খেয়াল করলেন। উনি ৪৬ ব্রিগেডের লেঃ কর্নেল এম আমিনকে বললেন ব্রিগেডকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সার্বক্ষনিকভাবে প্রস্তুত রাখতে। দে মাস্ট বি ব্যাটল রেডি!

১লা অক্টোবর, ১৯৭৭
ঢাকা, বাংলাদেশ
মধ্যরাতের পরপরই বিমানবাহিনীর বেশকিছু সংখ্যক নন-কমিশন্ড অফিসার এবং এয়ারমেন (বিমানসেনা) ক্যু এর প্রচেস্টা শুরু করলো উর্ধতন বিমান বাহিনী কর্মক্ররতাদের এবং জেঃ জিয়া সরকারকে উৎখাতে। তাদের সাথে যোগ দিলো সেনাবাহিনীর একদল নন-কমিশন্ড অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং সাধারন সৈনিক। রেড আর্মির বিমান ছিনতাইয়ের ঘটোনা তাদের কাজকে অনেকটাই সহজ করে দিলো।

এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনাটি ছিলো সুপরিকল্পিত। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়েছিলো যে ৯ই অক্টোবর বিমানবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে অভ্যুত্থান করে জেঃ জিয়া সহ সকল উর্ধতন অফিসারকে হত্যা কিংবা আটক করা হবে। এরপর বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে সরকার পরিচালনার দ্বায়িত্ব নেয়া হবে। এসময় জেঃ জিয়ার হঠাৎ করেই ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অপারগতা প্রকাশ করলে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সাথে কিছুদিন আগেই জেঃ জিয়ার কায়রতে সাক্ষাত হয় যেখানে প্রেসিডেন্ট সাদাত জেঃ জিয়াকে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে হত্যা করবার একটা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। জেঃ জিয়া বঙ্গবন্ধুর মত ভুল করলেন না। উনি সম্পুর্ন সতর্কতা অবলম্বন করা শুরু করলেন। তবে ২৮ তারিখের রেড আর্মির বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা তাদের এই পরিকল্পনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা পরিকল্পনা পিছিয়ে দেবার বদলে এই বিমান হাইজ্যাকের ঘটনায় সরকারের ব্যস্ততার সুযোগ গ্রহন করে।

বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবন আক্রমন করে এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বেতার কেন্দ্রের দখল নিতে সক্ষম হয়। তারা ঘোষণা করলেন যে, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র এবং জনতার সৈনিকদের বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে এবং তাদের অভ্যুত্থান সফল হয়েছে।

তাদের মধ্যেই একদল বিদ্রোহী ঢাকা বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রন নেবার চেষ্টা করেন যেখানে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ এবং সরকারের অন্য সিনিয়র অফিসারেরা জাপানী হাইজ্যাকারদের সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত ছিলেন। এখানেই সেনাদের বিদ্রোহ এক মারাত্মক মোড় নিলো। বিদ্রোহীরা তারা বিমান বাহিনী সহ সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের হত্যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর মাথা ছেটে ফেলতে চাইছিলো। আর একারনেই এ জি মাহমুদ বলেছিলেন,

– “যদি আমি বলি ওরা আমার লোক নয় তবে তুমি তাদের হত্যা করতে পারো।“

উনি প্রকৃতপক্ষে তার অফিসারদের বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, জাপানীজ রেড আর্মিকে নয়।

ডানকে তার এই কথা শুনে সকল হিসেব নিকেশ ভুলে প্রথমবারের মত নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন,

– “আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা চলছে।“

বিমানের ভেতর থেকে জিম্মীরাও বিমানবন্দরের আসেপাশে চলতে থাকা নাটক দেখছিলেন এবং ছবি তুলছিলেন।

২রা অক্টোবর, ১৯৭৭
ঢাকা, বাংলাদেশ
ভোরের দিকে একদল বিমানসেনা বিমানবন্দরের ডিজি সিভিল এভিয়েশনের অফিস কক্ষ থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার চৌধুরীকে নীচতলায় নামিয়ে নিয়ে আসলো অস্ত্রের মুখে। একজন সার্জেন্ট গুলি করলো গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসারকে লক্ষ্য করে। উনি সাথে সাথেই মারা গেলেন। সেই সার্জেন্ট আবার গুলী চালালো এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে লক্ষ্য করে, কিন্তু নিশানা লক্ষ্য ভেদ করলোনা। এ জি মাহমুদ ছুটে পালালেন।

তবে অন্যান্য স্থানে লড়াই ছড়িয়ে পরলো। বিদ্রোহীরা বেশ অনেকজন বিমানবাহিনী অফিসারকে আটক করতে সক্ষম হলো এবং তাদের ১১ জনকে হত্যা করলো বিমানবন্দরেই। এদের মধ্যে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাশ মাসুদ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার চৌধুরী, উইং কমান্ডার আনোয়ার আলী শেখ, স্কোয়াড্রন লীডার আব্দুল মতিন প্রমুখ। গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাশ মাসুদ এ জি মাহমুদের বোনের স্বামী ছিলেন। এ জি মাহমুদ সহ আরো অনেক সিনিয়র অফিসার পালিয়ে বাচতে সক্ষম হলেন। এরপর দিনভর খন্ডযুদ্ধের পর এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, এয়ার কমোডোর ওয়ালীউল্লাহ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজমের নেতৃত্বে বিমানবাহিনীর অন্যান্য বিমানসেনারা সেনাবাহিনীর ৪৬তম ব্রিগেডের সহায়তায় বিদ্রোহীদের নিস্ক্রিয় করে ফেলতে সক্ষম হন।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ তার আত্মজীবনে তার বোনের স্বামী রাশ মাহমুদের হত্যাকান্ডের ঘটনার ব্যাপারে লিখেছেন,

– “আমি আমার বোনের স্বামীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। এটা আমার পরিবারেও উত্তেজনা এবং অসুখী আমেজ সৃস্টি করে, যা আজও বয়ে চলেছি।“

তবে বিদ্রোহীদের দমনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। বগুড়ার বিদ্রোহের পরপরই আরেকটি বিদ্রোহের আশংকা করছিলেন উনি নন-কমিশন্ড অফিসার এবং সাধারন সৈনিকদের পক্ষ থেকে। উনি সেই সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত এবং অনুগত ছিলেন। উনি ঢাকার ৪৬ নং পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার লেঃ কর্নেল এম আমিনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীর নবম ডিভিশনের অপেক্ষা না করে সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌছাতে যদি সেনাদের মধ্যে কোন ধরনের অসহিষ্ণুতা দেখতে পান। তার এই আগাম সতর্কতাই তাদের জীবনরক্ষা করলো।

যেহেতু ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেড সম্পুর্ন সতর্ক অবস্থায় ছিলো, তাই তারা বিদ্রোহ শুরু হতে না হতেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে রক্ষায় ছুটে যী সক্ষম হয়। এ সময় বিদ্রোহীরা পিজিআর এবং পুলিশের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে প্রেসিডেন্টের ভবনে ঢুকে পরবার চেষ্টা করছিলো। নবম ডিভিশন আগে থেকেই সতর্ক থাকলেও দুরত্বের কারনে তারা যথাসময়ে পৌছাতে সক্ষম হয়নি। এই মধ্যবর্তী সময়ে ৪৬ ব্রিগেডের সেনারা বিদ্রোহীদের থামিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন এবং সকালের দিকে নবম ডিভিশনের সেনারা তাদের সাহায্যের জন্য এসে পৌছান এবং খুব দ্রুতই বিদ্রোহ দমন করা হয়।

মেজর জেঃ মঞ্জুরের আগাম সতর্কতার কারনে এভাই ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেডের লেঃ কর্নেল এম আমিন এবং তার অনুগত অফিসার ও সেনারা জেঃ জিয়ার সরকারকে একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন। যদি বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট এবং অন্য অফিসারদের হত্যা করতে সক্ষম হতো তবে সেটা জেঃ জিয়ার সরকারের অবসান ঘটাতো। হয়তো আরো অনেক সাধারন সৈনিক ও এনসিও তাদের সাথে যগ দিতেন যারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছিলেন। এটাই ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহ যেটা দমন করতে বেশ বেগ পেতে হয় আগাম সতর্কতার পরেও। ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সাথে এর মিল ছিলো, কারন বিদ্রোহীরা বিপ্লবী পরিষদ গঠনের মাধ্যমে দেশ চালনার ঘোষনা দিয়েছিলো। আর এই বিদ্রোহ ছিলো মারাতমক, কারন এটা দেশের অন্য কোন স্থানে সংঘটিত হয়নি, হয়েছে ঢাকায় যাতে বিমান বাহিনী সহ সেনাবাহিনীর এনসিও এবং সৈনিকদের বড়ো একটা অংশ পরিকল্পিতভাবে অংশ নেয় এবং জেঃ জিয়া সহ সিনিয়র অফিসারদের হত্যার টার্গেট নিয়েই কার্যক্রম শুরু করে।

তবে সামরিক বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের আনুগত্যের কারনে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ভুমিকা পালন করলেন সিজিএস (চীফ অফ জেনারেল ষ্টাফ) মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং জেঃ জিয়ার সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।

এই বিদ্রোহ দমনের পর জেঃ জিয়া টেলিভিশনে ভাষন দিলেন। তবে এবার তার কন্ঠ কিছুটা বিচলিত শোনা গেলো। উনি নিজের বাসভবনের সামনে খন্ডযুদ্ধ হতে দেখেছেন যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছেন। এরপর পরই তিনি প্রমানিত এবং সভাব্য সকল শত্রুর নির্মুলে নামবেন। উনি ভাবছেন, তাকে টিকে থাকতে হলে নির্ভেজাল সমর্থন এবং স্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে হবে। উনি ঘোষনা করলেন, যারা এই অভ্যুত্থান প্রচেস্টার সাথে জড়িত ছিলো তাদের সমুলে উৎপাটন করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে কোন রাজনৈতিক দল কিংবা পক্ষকে এ ব্যাপারে দোষী করে বক্তব্য দেয়া হলোনা। তবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই জাসদ, মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ সহ আরো কয়েকটি দলকে ক্যুতে উস্কানী দেয়ার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হলো। এসব দলের প্রধান নেতাদের গ্রেফতার করা হলো এবং এরপর দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে এসব দলকে কার্যত নিঃচিহ্নই করে দিতে সক্ষম হয় জেঃ জিয়ার সরকার। ধারনা করা হয় যে, প্রধানত পাকিস্তান প্রত্যাগত উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তারা জেঃ জিয়াকে বলেন কঠোর পদক্ষেপ নিতে। তারা মত দিলেন যে, মতে সেনাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করবার জন্য কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হলে এমন ঘটনা আরো ঘটতে পারে। জেঃ জিয়া সম্ভবত সে মোতাবেকই কাজ করেছিলেন।

যদিও বিমানবন্দরের টারমাকে ১১ জন প্রান হারিয়েছিলেন, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর হাজার হাজার বিমানবাহিনী অফিসার এবং বিমানসেনাকে সেখানে এনে হাজির করা হয় এবং সামান্যতম সন্দেহের প্রমান পাওয়া গেলেই সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে কিংবা বিচার ছাড়াই তাদের হত্যা করা হয়।

এ ঘটনা বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নতুন করে পুনর্গঠিত হতে লম্বা সময় প্রয়োজন হয়l জেঃ জিয়ার অধীন সেনাবাহিনী এ সময় নির্মমতার অন্যরুপ প্রদর্শন করে। শত শত বিমানবাহিনীর সদস্যকে আটক করে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। হাজারের বেশি বিমানবাহিনীর সদস্য, যাদের ক্যু তে জড়িত থাকবার অভিযোগে আটক করা হয়েছিলো তাদের আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ নিজের চোখের সামনে তার সহকর্মীদের হত্যা দেখে এবং পরবর্তীতে চোখের সামনে বিমান বাহিনী সদস্যদের বিচারের নামে গুম করা আর না সহ্য করতে পেরে সিদ্ধান্ত নিলেন বিমানবাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরে যাবার। উনি এ ব্যাপারে বলেছিলেন যে উনি বুঝতে পারছিলেন নিজ বাহিনীর উপর উনার আর কোন কর্তৃত্ব ছিলনা। পরবর্তীতে উনি জেঃ জিয়া কর্তৃক বিএনপি গঠিত হবার পরে তাতে যোগদানের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্য সব ব্যাপারের মত এই অভ্যুত্থানের সময় ঘটতে থাকা প্লেন হাইজ্যাক নাটক নিয়েই বিতর্ক আছে। যার মদে প্রধানত দুটা ধারা দেখা যায়। এর একটা মত অনুসারে রাশিয়া এবং ভারত মিলে এই প্লেন হাইজ্যাক নাটক করে যাতে বিদ্রোহীরা এই সুযোগে সরকারকে সরিয়ে দিতে পারে। তাদের মতে হাইজ্যাক নাটোকের সংলাপে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপন আর টাকা প্রদান সহ জিম্মীদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে ধীরগতি পরিকল্পিতই ছিলো। আবার আরেকদলের মতে এই প্লেন হাইজ্যাক বরং জেঃ জিয়ার জন্য সুবিধাজনকই হয়েছিলো। এই হাইজ্যাকের ফলেই ক্যু এর পরিকল্পনাকারীরা সময় এগিয়ে আনে যখন সরকার প্রস্তুত হয়েই ছিলো বগুড়ার বিদ্রোএর পর। তবে শেষের মতটাই সম্ভবত সঠিক।

কিছু কথা যা লিখে ফেলেছি কিন্তু এখনো জানিনা কোথায় বসাবোঃ
১৯৭৬ সাল জুড়েই দেশ জুড়ে জাসদ আর মুজিববাদী কিংবা আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা একত্রিত হয় নতুন সরকারের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিব সরকারের আমলের মতই দেশের নানা স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা এবং হত্যা চলতে থাকে। হত্যার শিকার বেশিরভাগই ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা ধনী কৃষক। এ সময় সরকারও কঠোর হয় এবং হাজার হাজার বক্তিকে গ্রেফতার করে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করে। সেনাবাহিনী এ সময় অনেককেই বিনা বিচারে গুম করে দেয় বলে অভিযোগ করেন অনেকেই।

জেঃ জিয়ার সরকার আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী করবার উদ্যোগ নেয় খুব দ্রুতই। মাত্র এক বছরের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৪০০০০ থেকে ৭০০০০ হাজারে উন্নীত করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১৯৭৫ সালের ৫০০০০ হাজারের তুলনায় ১৯৭৭ সালে এসে ৯০০০০ এ দাঁড়াবে।

পুলিশের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের মধ্যে ছিলো যে এতে প্রায় সাড়ে বার হাজার বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কমব্যাট রেডি সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা গেরিলা আক্রমন প্রতিহত করা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সহায়তা করা সহ অন্যান্য বিশেষ কাজে পারদর্শী ছিলো। আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবার লক্ষ্যে সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালে এ বাজেটের পরিমান ছিলো ৭৫ কোটি টাকা, আর ১৯৭৬-৭৭ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২১৯ কোটি টাকায়।

সম্পুর্ন নতুন নবম পদাতিক ডিভিশন এ সময়ে গঠন করা হয় মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীর অধীনে। তিনি হলেন এই শক্তিশালী ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং)। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে জেঃ জিয়ার শাসনামলের শেষভাগ পর্যন্ত।

১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেস্টার পর দেশকে পাচটি নতুন ডিভিশন ভাগ করে সামরিক বাহিনীর ইউনিটসমুহকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের অধীনে আনসার বিডিআর এর সদস্যরা সহ মোট ৩০০০০ করে সেনা ছিলো প্রতিটি সেক্টরে। সামরিক বাহিনীর এই সম্মিলিত শক্তির পরিমান দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ, যারা প্রধানত জেঃ জিয়ার সরকারের প্রতি অনুগত ছিলো। জাসদ কিংবা নিয়মিত বাহিনীর কোন বিচ্ছিন্ন অংশের হুমকী মোকাবেলায় এরা কার্যকরী ভুমিকা রাখবে বলে ধারনা করা হয়।

নতুন ভাবে সামরিক বাহিনীতে লোক নিয়োগের ব্যাপারে জেঃ জিয়ার একটা আলাদা উদ্দেশ্য ছিলো। উনি চেয়েছিলেন একটা অরাজনৈতিক নতুন নিয়োগের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের সাথে তাদের সেনাদের পরিবারের সদস্যর মত সম্পর্ককে ভেঙ্গে দেয়া যাতে আলাদা আলাদাভাবে কেউ শক্তিশালী হয়ে না উঠতে পারে। এ সময় স্বপ্ল সময় অন্তর বদলী করা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

জেঃ জিয়া সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নিলেন। নতুন রিক্রুটেরা আলাদা প্রশিক্ষন সুচীর মধ্যে দিয়ে গেলো। সৈনিকদের অফিসারদের দিয়ে ব্যাটম্যান (অনেকটা ব্যক্তিগত গৃহভৃত্যের মত) হিসেবে কাজ করাবার পদ্ধতি বাতিল করা হয় এ সময়। অফিসার এবং সেনাদের বেতন মুল্যস্ফিতির চেয়ে বেশীহারে বৃদ্ধি করা হয়। আর সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা আসে সেটা হচ্ছে শৃংখলার ব্যাপারে। সে সময়ের অবসর প্রাপ্ত এক সামরিক কর্মকর্তার ভাষ্যে সময়টা ছিলো অনেকটা এমনঃ

– “সে সময়টায় শৃংখলা রেজিমেন্টের অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে বড় ব্যাপার ছিলো। জিয়ার আমলে কি হতো? কোন অফিসার আপনাকে কিছু করবার আদেশ দিলে সেটা আগে করতে হতো, কোন প্রশ্ন থাকলে পরে করে নেয়া যেতো। যদি কাজটা আগে না করতেন তবে প্রেসিডেন্ট আপনাকে মেরে ফেলতো।“

যে যাই বলুক, জিয়া সেনাবাহিনীক একটা নির্দিস্ট মানে উন্নীত করেন, জেঃ এরশাদ সেটাকে আরো শক্তিশালী করেন। জেঃ জিয়া অবশ্য বিমানবাহিনীকে প্রায় পঙ্গুও করে ফেলেছিলেন। বর্তমান সময়েও সেনাবাহিনী অন্য দুই বাহিনীর উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ওই সময়ের ধারাবাহিকতায়।

এ সময় নির্বাচিত সংসদের যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার জয় সামরিক বাহিনীর অনুমোদনের দরকার হতো। অনেকটা আইয়ুব খানের মৌলিক গনতন্ত্রের মত ছিলো ব্যাপারটা। শেখ মুজিবের সময় রাজনীতিকে সামরিক বাহিনী থেকে সম্পুর্ন আলাদা করে ফেলবার পদক্ষেপ নেয়া হয়, আর জেঃ জিয়া এ দুটাকে একীভুত করে ফেলছিলেন প্রথম কয় বছর।

স্বাধীনতার দুই বছর পর পাকিস্তানে আটকে পরা সেনা কর্মকর্তারা দেশে ফিরে আসেন। সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তাদের দৃস্টীভঙ্গী ছিলো পাকিস্তান আমলের মত। বঙ্গবন্ধুর আমলে মুক্তিযদ্ধা অফিসারদের প্রত্যাগতদের চেয়ে বেশি সুবিধা দেয়া হয়। পদোন্নতি সহ সকল ক্ষেতরে ছিলো তাদেরই আধিপত্য। তবে জেঃ জিয়া ক্ষমতায় এসে এই প্রত্যাগত অফিসারদের প্রতিই ঝুকে পরেন তার অবস্থান সুসংহত করতে। জেঃ জিয়ার হত্যাকান্ডের সময় সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের সংখ্যা ছিলো শতকরা ১৫ %, প্রত্যাগতদের ২৫% এবং সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধির নীতির কারনে একেবারে নতুন জওয়ানরা ছিলো সংখ্যায় প্রায় ৬০%। জেঃ জিয়া এবং অন্যান্য উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তারা মনে করতেন যে প্রত্যাগত এবং নতুন রিক্রুটরা পেশাগত ক্ষেতরে বেশি দক্ষ এবং শৃংখলাপূর্ন কারন তারা পরিপুর্ন সামরিক প্রশিক্ষনের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং তাদের পদোন্নতির ব্যাপারগুলো রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় হয়নি।

জেঃ জিয়ার আমল পদোন্নতির ব্যাপারে জেষ্ঠতা কঠোরভাবে অনুসরন করা হয়। আর এ কারনে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারেরা এমনিতেই পিছিয়ে পরতে থাকেন। এর বাইরেও প্রত্যাগতদেরই পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় বেশি যেটা একটা সরল পরিসংখ্যানেই বোঝা যায়। ১৯৮১ সালে যখন জেঃ জিয়াকে হত্যা করা হয়, তখন সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল এবং ব্রিগেডিয়ার পদের মোট ৫০ জন অফিসার ছিলেন। এদের মধ্যে ৪৮ জনই ছিলেন পাকিস্তান ফেরত। এদের মধ্যে একজন ছিলেন মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী এবং আরেকজন ছিলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। জেঃ জিয়ার এ পদক্ষেপ তার প্রতি মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এবং সেনাদের ক্ষোভের কারন হয়ে দাঁড়ায়।

জেঃ জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরনের কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তবে তার পুরো শাসনামল জুড়ে উনি শৃংখলার ব্যাপারে কঠর ছিলেন যার প্রধান ভুক্তভোগী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারাই। কারন প্রধান ক্যু এর প্রচেষ্টাগুলো তাদের দিয়েই সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের সেনাবাহিনীর পাচটি ডিভিশনের জায়গায় ১৯৮১ সালে ডিভিশনের সংখ্যা ছিলো আটটি। এর মধ্যে ঢাকায় দুইটি, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দুইটি এবং রংপুর, কুলিল্লা, বগুড়া এবং যশোরে একটি করে ডিভিশন ছিলো। এর পেছনে ধারনা হিসেবে কাজ করে যে, এ কারনে সেনাবাহিনীতে নতুন রিক্রুট নেবার কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের আনুপাতিক সংখ্যা এমনিতেই কমে যাবে।এর বাইরে ১৯৭৭ সালের ক্যু এর কারনে জেঃ জিয়া হতাধিক সামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদকে হত্যা করেন যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

জেঃ জিয়ার নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নং ৯ বাতিল ঘোষনা করেন। যার মাধ্যমে কোন কারন দর্শানো ছাড়াই কোন সরকারী কর্মকর্তাকে চাকুরীচ্যুত করা যেতো। এর বাইরে এই আইনের আওতায় যেসব আমলারা স্বাধীনতার পর চাকুরীচ্যুত হয়েছিলেন তাদের আপীল করবার সুযোগ দেয়া হয়। আর এই সুযোগে পাকিস্তানপন্থী কিংবা দোসর হিসেবে পরিচিত অনেক আমলাই জেঃ জিয়ার সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ন পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এর বাইরে মুজিবপন্থী হিসেবে যেসব আমলা পরিচিত ছিলেন তাদের চাকুরিচ্যুত করা হয় অথবা নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়। যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সচিব ছিলেন শফিউল আজম, তাকে তার পদে বহাল করা হয় আগস্টের পর। আবার সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী এটিএম সায়িদ হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনিতে মেজর জেঃ খলিলুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদ এবং ব্রিগেডিয়ার ক্কাজী গোলাম দস্তগীরকে পরপর পদোন্নতি দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশ ভারতের উপর অনেক দিক থেকেই নির্ভরশীল ছিলো। সম্পর্কও বেশ বন্ধুত্বপুর্ন ছিলো। সামরিক সরকার আসবার পর পরই এ অবস্থ্যা পাল্টে যায়। তারা ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে আসবার চেষ্টা করেন। ভারতীয় সরকারও পালটা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমুলক কার্যক্রমকে উস্কে দেয়। এর বাইরেও নানা পদক্ষেপ নেয় যা দেশের জন্য ক্ষতির কারন ছিলো। প্রথমেই তারা বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়াই ফারাক্কায় গঙ্গার পানির দিক বদলে দেয়। এছাড়াও মুজিববাদী নানা গ্রুপকে আশ্রয় এবং সাহায্য প্রদান করতে থাকে। তবে ইন্দিরা সরকারের পতনের পর নতুন মুরারজী দেশাই সরকারের সাথে জেঃ জিয়ার সরকারের সমঝোতা হয় নানা ব্যাপারে।

মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা ইসলামিক দেশের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয় এ সময়। রাস্ট্রকে ইসলামের মুলনীতির অধীনে চালিত করবার পদক্ষেপ নেবার কারনে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং আর্থিকভাবে অনেক সাহায্য পাওয়া যায় তাদের থেকে। লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে কাজের জন্য যেতে থাকে। দেশের অর্থনীতিতে আসতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রা। পাকিস্তানের সাথেও সম্পর্কের বেশ ভালো উন্নয়ন ঘটে এ সময়। দুই দেশের মধ্যে তিনবছর মেয়াদী বানিজ্যচুক্তি হয়।

তথ্যসুত্রঃ
উইকিপিডিয়া
বাংলাপিডিয়া
http://archive.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=196604
মার্ডার ইন ঢাকা – জিয়াউর রহমান্স সেকেন্ড রাউন্ড
স্টেট ইন বাংলাদেশ আন্ডার জিয়া (১৯৭৫-১৯৮১)- সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম
বিডিনিউজ২৪ ডট কম
বাংলাদেশ আফটার জিয়া – এ রেট্রোস্পেক্ট এন্ড প্রসপেক্ট- মার্কাস ফান্ডা
Politicization of the Bangladesh Military: A Response to Perceived Shortcomings of Civilian Government –
Zillur R. Khan
আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ – এস মাহমুদ আলী
বাংলাদেশ এন্ড পাকিস্তান – উইলিয়াম বি মিলাম
এবং অন্যান্য






Shares