Main Menu

ভুতুড়ে গা ছমছমে শব্দ মহাকাশে! দেখুন ভিডিও

+100%-

spaceডেস্ক ২৪:: হাড় কাঁপানো বললে কমই বলা হয়।
হাড় জমানো ঠাণ্ডা। যেখানে পারদ থাকে শূন্যের ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে। সঙ্গে ঘুটঘুটে, অতল অন্ধকার।
গা ছমছমে সেই হাড় জমানো জমাট অন্ধকারে শোলা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর, ভুতুড়ে সব শব্দ। গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই শব্দগুলো একেকটা এক এক রকমের। তবে সবগুলোই ভুতুড়ে। বা, বলা ভাল, একেবারেই অদ্ভুতুড়ে।

কোথাও গান গাইছে ধূমকেতু। কখনও বা শোনা যাচ্ছে গনগনে তেজে জ্বলা সূর্যের সরোষ গর্জন। আবার কখনও এই সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে ভারী গ্রহ বৃহস্পতিকে কাঁপিয়ে দেওয়া ঝড়, বজ্রপাত আর বিদ্যুৎ-চমকের গা ছমছমে শব্দে পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। কখনও বা শনির বলয় থেকে ভেসে আসছে গায়ে কাঁটা দেওয়া ভুতুড়ে আওয়াজ। পৃথিবীর ভুতুড়ে শব্দও কি কিছু কম কাঁটা দেয় গায়ে?
শব্দগুলো ভুতুড়ে ঠিকই। তবে এ সব কোনও ভুতুড়ে কাহিনী নয়।

দেখুন ভিডিও- মহাকাশের সেই সব ভয়ঙ্কর, ভুতুড়ে শব্দ

এই শব্দগুলোর মধ্যে কোনওটা শুনেছে ১৯৭৭ সালে মহাকাশে পাড়ি জমানো নাসার ‘ভয়েজার-১’ মহাকাশযান। যা ইতিমধ্যেই ৩৯টা বছর পার করে দিয়েছে মহাকাশে। একেবারে হালে নাসার যে মহাকাশযানটি প্লুটোকে পেরিয়ে ক্যুইপার বেল্ট টপকে এগিয়ে চলেছে আমাদের সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে, উরট্ ক্সাউডের (অসম্ভব ঘন জমাট বাঁধা মেঘ) দিকে। কোনও শব্দ আবার শুনেছে নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) পাঠানো অন্য কোনও মহাকাশযান। একেবারে হালে ধূমকেতুর গান শুনেছে ইএসএর ‘রোসেটা’ মহাকাশযান। ২০১৪-র নভেম্বরে ‘৬৪/পি শ্যুরিমোভ-গেরাশিমেঙ্কো’ ধূমকেতুতে ‘পদার্পণে’র পর।
কিন্তু কী ভাবে ওই সব ভয়ঙ্কর, ভুতুড়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে মহাকাশে?

যেহেতু কোনও বায়ুমণ্ডল নেই, নেই শব্দকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর কোনও মাধ্যম নেই মহাকাশে, এটা ভাবলে ভুল হবে। আন্তর্নাক্ষত্রিক মাধ্যম রয়েছে। তবে সেই সব শব্দের কম্পাঙ্ক এতটাই কম বা বেশি, যা কিছুতেই আমাদের শ্রবণযোগ্য হতে পারে না। তাই মহাকাশে তো এই সব ভয়ঙ্কর, ভুতুড়ে শব্দ আমাদের শুনতে পাওয়ার কথা নয়। আমরা তো শুনতে পাই শুধুই ২০ থেকে ২০ হাজার হার্জ কম্পাঙ্কের মধ্যে থাকা শব্দ। আর যে সব ভয়ঙ্কর, ভুতুড়ে শব্দ হয়ে চলেছে ব্রহ্মাণ্ডের এখানে-ওখানে, প্রতিনিয়তই, তাদের কম্পাঙ্ক হয় তার চেয়ে অনেক কম বা, অনেক অনেক গুণ বেশি। তা হলে সেই ভুতুড়ে শব্দগুলি শোনা যাচ্ছে কী ভাবে?
তার আগে দেখে নেওয়া যাক, মহাকাশে কোন কোন জায়গা থেকে ওই গা ছমছমে ভুতুড়ে শব্দগুলি শোনা গিয়েছে।

এক, এই সৌরমণ্ডলের ষষ্ঠ গ্রহ শনির গা ছমছমে গোঙানি!

২০০২ সালের এপ্রিলে নাসার ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযানের নজরে প্রথম ধরা পড়ে শনির দুই মেরুতে মায়াবী আলোর বর্ণালী ‘অরোরা’র সঙ্গে বেরিয়ে আসা ‘এরি রেডিও তরঙ্গ’। ধরা পড়ে শনির চার পাশে আধানযুক্ত গ্যাসের (প্লাজমা) নড়াচড়ার ফলে জন্মানো তরঙ্গও। দেখা যায়, শনির চৌম্বক ক্ষেত্র বরাবর কয়েকটি ছোট ছোট উৎস থেকে বেরিয়ে আসছে রেডিও তরঙ্গ। কিন্তু, আমরা যে কম্পাঙ্কের সীমার মধ্যে থাকা শব্দ শুনতে পাই (অডিব্‌ল ফ্রিকোয়েন্সি), শনি থেকে বেরিয়ে আসা রেডেও তরঙ্গের কম্পাঙ্কগুলি তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। সেই কম্পাঙ্কের মাত্রা ৪৪ হাজার ভাগ কমিয়ে সেগুলোকে শ্রবণযোগ্য করে তোলা হয়। যার মধ্যে ধরা পড়েছে ভুতুড়ে শব্দের ওঠা-নামাও।

দুই, সূর্যের সরোষ গর্জন!

টানা ৩৫ বছর মহাকাশে কাটানোর পর ‘ভয়েজার-১’ মহাকাশযানের নজরে প্রথম ধরা পড়ে সূর্যের সরোষ গর্জন, ২০১২ সালের অগস্টে। সূর্যের একেবারে বাইরের দু’টি স্তর- ‘করোনা’ আর ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’ থেকে বেরিয়ে আসা ‘শক ওয়েভ’-এর সঙ্গে প্লাজমা ওয়েভের ধাক্কাধাক্কির ফলে তৈরি হয় একটি তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। ওই ঘটনাটি ঘটে সূর্যের কেন্দ্রস্থল থেকে ১২০০ কোটি মাইল দূরে। ‘ভয়েজার-১’ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পায় ২০১৩ সালেও। আরও জোরালো তরঙ্গ। যাকে পরে শ্রবণযোগ্য কম্পাঙ্কে রুপান্তরিত করা হয়।

তিন, ‘শ্যুরিমোভ-গেরাশিমেঙ্কো’ ধূমকেতুর গান!

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘রোসেটা’ মহাকাশযান ২০১৪-র নভেম্বরে ‘শ্যুরিমোভ-গেরাশিমেঙ্কো’ ধূমকেতুতে নামিয়েছিল ‘ফিলি’ ল্যান্ডার। তবে তার তিন মাস আগেই, অগস্টে ওই ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢুকে পড়ার পর একটি অদ্ভুতুড়ে শব্দ ‘শুনতে পায়’ রোসেটা মহাকাশযান। তা রেকর্ডও করা হয়। যার কম্পাঙ্ক আমাদের শ্রবণযোগ্য শব্দের কম্পাঙ্কের দশ হাজার ভাগেরও কম। ৪০ থেকে ৫০ মিলি হার্ৎজের মধ্যে। সেই কম্পাঙ্ক এতটাই কম যে, তা আমাদের পক্ষে কখনওই শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই কম্পাঙ্কের ওঠা-নামা থেকে মনে হচ্ছে, ধূমকেতু যেন গান গাইছে! কেন ওই শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা অবশ্য সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত সুনিশ্চিত হতে পারেননি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশের অনুমান, ধূমকেতুর চার পাশে যে চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, তার দোলনের (Oscillation) জন্যই ওই শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে।

চার, বৃহস্পতিতে ভয়ঙ্কর বজ্রপাত, বিদ্যুৎ-চমক!

এই সৌরমণ্ডলের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির আবহাওয়া ভীষণ রকমের ঝোড়ো। উত্তাল, অশান্ত। আবহাওয়ার আচার-আচরণের দিক দিয়ে বৃহস্পতিকে বেশ কিছুটা খ্যাপাটেই বলা যায়। বৃহস্পতিতে অসম্ভব জোরে বয়ে চলা ঝড় ধরা পড়েছে মহাকাশযানের নজরে। ওই অসম্ভব তীব্র ঝড় আর ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎ-চমক ও বজ্রপাতও নজর এড়ায়নি মহাকাশযানের। মাপজোক করে দেখা গিয়েছে, বৃহস্পতির ওই বিদ্যুৎ-চমক ও বজ্রপাত পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রপাতের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। ওই বজ্রপাত অনেক বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করে। যা আমাদের শ্রবণযোগ্য নয়। একে বলে ‘জোভিয়ান হুইস্‌লার’। সেটা তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবেই ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। ’৭৯ সালে ‘ভয়েজার-১’ মহাকাশযান বৃহস্পতির ওই ঝড় আর বজ্রপাতের শব্দ রেকর্ড করেছিল। বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রের কাছে সেই ঝড়ের শব্দ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

পাঁচ, ব্ল্যাক হোলের খাই-খাই শব্দ!

‘GRS-1915+105’ নামে একটি দুই নক্ষত্রের সৌরমণ্ডল রয়েছে। যার একটি তারাকে একটি ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে খেয়ে খেয়ে ফেলছে। আর সেই তারার দেহাংশ ছিটকে পড়ছে মহাকাশে। কতটা করে, জানেন? প্রতি আধ ঘণ্টায় দশ হাজার লক্ষ কোটি টন ওজনের গ্রহাণুর ভরের সমান ভর ছিটকে পড়ছে মহাকাশে। আর তা ছিটকে পড়ছে প্রায় আলোর গতিতে। ’৯৬ সালে প্রথম ওই ঘটনা নজরে আসে নাসার ‘রোসি এক্স-রে ফাইন্ডিং এক্সপ্লোরেশান স্যাটেলাইটে’র নজরে। ওই ঘটনার ফলে যে জোরালো তরঙ্গের জন্ম হচ্ছে, ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি পরে তাকে আমাদের শ্রবণযোগ্য শব্দের কম্পাঙ্কে রূপান্তরিত করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সেই শব্দ আমাদের হৃদপিণ্ডের ‘লাব-ডুবে’র মতোই!

এ ব্যাপারে কী বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?

বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে’র (আইআইএ) অধ্যাপক, সৌরবিজ্ঞানী দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘সূর্যের একেবারে কেন্দ্রে ও তার সবচেয়ে বাইরের স্তর ‘ক্রোমোস্ফিয়ারে’ আমাদের শ্রবণযোগ্য শব্দের চেয়ে অনেক অনেক ভাগ কম কম্পাঙ্কের শব্দের জন্ম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই শব্দ বেশি দূর যাওয়ার আগেই মরে যাচ্ছে। বেশি পথ পেরতে পারছে না। একই রকম ভাবে অত্যন্ত কম কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হচ্ছে ‘ক্রোমোস্ফিয়ারে’র বাইরে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রে। যা ‘ম্যাগনেটো-অ্যাকুইস্টিক ওয়েভ’ হিসেবে এগোয় মহাকাশে। কিন্তু চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্যই সেই তরঙ্গ বেশি দূর এগোতে পারে না। তবে ’৯৬ সালে মার্কিন উপগ্রহ ‘সোহো’র বিশেষ একটি যন্ত্র ওই শব্দ রেকর্ড করেছিল। পরে তাকে শ্রবণযোগ্য কম্পাঙ্কে রূপান্তরিতও করেছিল।’’

বেঙ্গালুরুর ‘রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’র (আরআরআই) অধ্যাপক বিমান নাথের ব্যাখ্যা, ‘‘মহাকাশে তো অস্থিরতা রয়েছে যথেষ্টই। নানা রকমের তরঙ্গের জন্ম হচ্ছে সেখানে প্রতিনিয়তই। তড়িৎ-চুম্বকীয় ও প্লাজমা তরঙ্গ (যা প্লাজমা স্তরের নড়াচড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে) তাদের অন্যতম। তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ কোনও মাধ্যম ছাড়াই এগোতে পারে। যদিও মহাকাশে কোনও মাধ্যম নেই, তা নয়। রয়েছে আন্তর্নাক্ষত্রিক মাধ্যম। শনির ‘এরি রেডিও এমিশন’ আসলে প্লাজমা ওয়েভ। আর তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গই বৃহস্পতিতে ‘হুইস্‌লার ওয়েভ’-এর জন্ম দিচ্ছে।’’

বেশ মজার কথাটা বলেছেন কলকাতার সত্যেন্দ্রনাথ বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেসের সিনিয়র প্রফেসর সন্দীপ চক্রবর্তী। তাঁর কথায় ‘‘বাদুড়েরও নানা শব্দ থাকে। যাকে বলে ‘অ্যাকুইস্টিক ওয়েভ’। তা কিন্তু আমারা কেউই শুনতে পাই না। তা বলে কি আর বাদুড় শব্দ করে না?’’






Shares