Main Menu

স্বাধীন সাংবাদিকতায় মাফিয়াদের দৌরাত্ব

+100%-

ডেস্ক ২৪ :সাংবাদিকতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো কিছু লিখলেও কাজ হয় না- প্রায়ই শুনতে হচ্ছে এ অভিযোগ। শুনতে হচ্ছে এখন আর কাগজ পড়াই যায় না। ভুলে ভরা, যাচ্ছেতাই হাবিজাবি দিয়ে কাগজ ভরে দিচ্ছে। এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বরং উল্টো করে বলা হয় যতোসব বাজে অভিযোগ। এ বিষয়ে যতোদূর জানা গেছে তা হলো আগের দিনের সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে সর্বত্র তোলপাড় হতো। ঘুষ দুর্নীতি, সমাজ-সংস্কৃতি রাজনীতি যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন- আজ কোনোকিছু নিয়ে লিখলে তোলপাড় হয় না, বরং তা নিয়ে নানান প্রশ্ন, সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়। বিগত দুই দশকে এক শ্রেণির সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হলেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। এ অবনতির কারণ সংবাদপত্রকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির হাতিয়ার হিসাবে গড়ে তোলা। এ সময় অধিকাংশ পত্রিকায় পেশাদার সম্পাদকের পরিবর্তে আমরা দেখেছি মালিক-সম্পাদক। নয়তো আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদক। এ মালিক আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদকরা নানা সুযোগ-সুবিধা আদায়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকায় সাংবাদিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্য দিয়ে আজ্ঞাবাহী মাফিয়া ও মালিক-সম্পাদকরা সংবাদপত্র নয় বরং তারা তাদের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। সংবাদপত্র মালিকরা যদি তাদের অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় তাতে আপত্তির কিছু নেই। বরং এ ক্ষেত্রে খুশি হবার কথা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার মানেই কর্মসংস্থান। কিন্তু না, বিষয়টা এখানে সীমাবদ্ধ নয়। এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব যেমন আছে তেমনি সাংবাদিকতায় এর প্রভাব পড়েছে তাৎক্ষণিক। যার পরিণতি হিসেবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মালিকরা সরাসরি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত বলে সংবাদপত্রগুলোতে সাংবাদিকতার পরিবর্তে মালিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা ও প্রসারের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। তাই শুধু নয়, নিরপেক্ষতা আর বস্তু-নিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিকতার নামে এখন মিথ্যাচার আর নির্লজ্জ দালালি চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় জয়ের জন্য কতিপয় সাংবাদিক নামধারী সংবাদপত্রে কর্মরত সম্পাদক থেকে শুরু করে সহ-সম্পাদক, রিপোর্টার কমবেশি সবাই যাচ্ছেতাই লিখে যাচ্ছে। এতে পাঠক শুধু বিভ্রান্ত-ই হচ্ছে না, নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্থও হচ্ছে।
এখানকার সময়ে একজন সাংবাদিক তার বেতনের চাইতেও বেশি টাকা খরচ করে বাড়ি ভাড়ায়। কর্তৃপক্ষ জেনেও কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি-ওই সাংবাদিক চলেন কী করে? অথবা যখন সর্বমোট চৌদ্দ হাজার টাকা বেতনের কোনো সাংবাদিক অফিসে প্রকাশ্যে বলেন, সংসার খরচের জন্য বউকে আঠারো হাজার না দিলে ঘরে ঢুকতে পারবো না। তখন কর্তৃপক্ষে এ নিয়ে গর্ব করে বলে- খরচ না করলে কেউ আয় করতে পারে না। কিন্তু সেই আয় কী- এ প্রশ্ন যদি কেউ কোনোদিন করে? এই যখন অবস্থা তখন সংবাদপত্র- সাংবাদিকতার কী হাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতা পুরোপুরি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এরপর আছে মূর্খতা। অতীতে সাংবাদিকতায় আসতো মেধাবীরা। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীরা স্বাধীন পেশা হিসেবে ওকালতি ও সাংবাদিকতা বেছে নিতেন। বিগত দুই-তিন দশকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বেছে নিয়েছেন। আর সাংবাদিকতায় এসেছে কোথাও চাকরি না পাওয়া তরুণেরা। নেতাদের সুপারিশ নিয়ে নেতাদের কাছে কর্তৃপক্ষের নানা দায়বদ্ধতা আছে, ফলে তরুণদের না নিয়ে উপায় নেই। এভাবে সাংবাকিতায়- আসা মেধাহীন মূর্খরা দু’লাইন লিখতে না পারলেও সাংবাদপত্রের বড় বড় পদ এদের দখলে। কিছু পাঠক সংবাদপত্র ও এর কলাকুশলীদের পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আবার সংবাদটি সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করবে এবং এই মাধ্যমটি তার স্বমহিমায় ফিরে আসবে এই প্রত্যাশা করি।
মূলত, দুটি মূলধারার রাজনৈতিক মেরুকরণ সাংবাদিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয়নি। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম শুরু থেকেই ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়ন চাইলেও প্রবীণদের ক্ষুদ্র অথচ প্রভাবশালী একটা অংশ রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কারণে বিভক্তি জিইয়ে রাখে। তরুণ প্রজন্মের একটা অংশও স্বার্থকামী সুবিধাবাদীদের দলে ভেড়ে এবং বিভক্তি লাইন বাজায় রাখতে তাদের মদদ দেয়। এই সুযোগে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজের প্রভাব ও শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাজনৈতিক ও অন্যান্য পক্ষ সাংবাদিকদের বিভক্তি চলমান রাখার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। দেশে গোটা সাংবাদিক সমাজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে সব জায়গায় দুই বা ততধিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। তারা পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এত তীব্র রূপ লাভ করে যে, দুই পক্ষই পরস্পরের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করতেও কুণ্ঠিত হয় না। কোথাও কোথাও তা মারামারি ও খুনÑখারাবির পর্যায়ে গড়ায়। বিশেষ করে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাংবাদিক হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও।
সমাজের অগ্রসর ও সচেতন এই শ্রেণিটির যেখানে নিজের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রাম করার কথা, সেখানে রাজনৈতিক বিভক্তি তাদের অনেক নিচে নামিয়ে আনে। পেশার বদলে অনেকের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয়। বিভক্ত ইউনিয়নগুলোতে এমনও অনেক নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের কোনোদিন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যও হওয়ার কথা নয়। অনেক নেতা দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনের পুরস্কারস্বরূপ চাকরি-বাকরিসহ অনেক সুবিধা নিয়েছেন তাদের পছন্দের সরকারের কাছ থেকে। আবার বৈরী সরকারের কোপানলে পড়ে অনেকে চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। কিন্তু সাধারণ সাংবাদিকেরা কোনো সুবিধা তো পাইনি, বরং তারা বারবার নানা ঝক্কিঝামেলায় পড়েছেন সাংবাদিকদের বিভক্তির কারণে। ফলে তারা সব সময়ই চেয়েছেন সাংবাদিকদের ঐক্য রচিত হোক।
ইউনিয়নগুলোর এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে সরকার-মালিক, পুলিশ-প্রশাসন, সন্ত্রাসীসহ সব পক্ষ ক্রমশ সাংবাদিকদের উপর চড়াও হতে থাকে। ফলে সাংবাদিক সমাজের মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুণœ হওয়ার পাশাপাশি তাদের ওপের নেমে আসে নানামুখি নির্যাতন। অনেক সাংবাদিক হতাশ হয়ে ইউনিয়ন বিমুখ হয়ে পড়েন। পরে তারা গড়ে তোলেন অঞ্চলভিত্তিক সাংবাদিক ইউনিয়ন-সমিতি। এসব কারণে সাংবাদিক সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
পেশাগত অধিকার ও মর্যাদাহারা সাংবাদিক সমাজ যখন একেবারেই কোণঠাসা। সমাজের প্রভাবশালীদের চাপে যখন তারা দিশেহারা তখনও হত্যাসহ নানা নির্যাতনের মুখে যখন তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই ঘটে সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের ঘটনা। গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজাবাজারে ওই সাংবাদিক দম্পত্তি নিজ বাসভবনের শয়নকক্ষে খুন হন। এর আগে সংঘটিত অনেক সাংবাদিক হত্যারও কোনো বিচার হয়নি। তরুণ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক দম্পত্তি হত্যাকা- কেবল সাংবাদিক সমাজেই নয়, গোটা দেশে চরম আতঙ্ক ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এই হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট সাংবাদিক সমাজ ক্রমশ ফুঁসে ওঠে। তারা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে এবং দীর্ঘদিনের বিভক্তি ও দুর্বল ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধ করার প্রবল তাগিদ অনুভব করে। শুরু হয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এর পরই সাংবাদিক নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করে সাংবাদিক ইউনিয়গুলো ঐক্যবদ্ধ করার ফর্মূলা নিয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হচ্ছেন। মিথ্যা মামলাও দেয়া হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। অনেককে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে।
বিভক্তির কারণে খুন-হয়রানীর শিকার সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ে দাবি ।






Shares