সরাইলে ৪শত টাকার রুপার চেইন কেড়ে নিলো কিশোরীর জীবন । মামলা হলে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি
মোহাম্মদ মাসুদ ,সরাইল থেকে :অসহায় হতভাগিনী এক কিশোরীর নাম লাকী বেগম (১৩)। তিন বছর আগে মারা গেছে তাঁর মা আছমা বেগম। তারা দুই ভাই এক বোন। লাকী সবার ছোট। তাদের বাবার প্রথম স্ত্রী মুরচান বেগম (৫২)। মুরচান ও তার তিন ছেলে লাকীকে কোন ভাবেই সহ্য করতে পারছিল না। পিতা জুরাল মিয়াও তাঁর প্রথম স্ত্রী সন্তানদের অত্যাচারের কাছে একেবারেই অসহায়। টকবগে সুন্দরী এ কিশোরী অসহনীয় যন্ত্রনা নির্যাতন সহ্য করে সৎ মায়ের সংসারে বসবাস করে আসছিল । অন্য ৮/১০ জন মেয়ের মত লাকীরও সাধ ছিল পড়া লেখা করে মানুষের মত মানুষ হবে। সৎ মা ভাইয়ের অত্যাচার ও দারিদ্রতা লাকীর সেই স্বপ্ন পূরন হতে দেয়নি। যন্ত্রনা সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে লাকীর বড় ভাই সেলিম (১৯)। ছোট ভাই সালমান (১৭) এলাকায় নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। অবশেষে সৎ মা ও ভাইয়েরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে নির্যাতনের পর লাকীকে নির্মম ভাবে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। হত্যার পর বিষপানে আত্মহত্যার কথা প্রচার করছে সৎ মা মুরচান বেগম ও তার স্বজনরা। গত বৃহস্পতিবার সকালে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের শাখাইতি গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে গতকাল শুক্রবার সকালে ময়না তদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরন করেছে। এ দিকে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে গ্রামের কিছু সালিশকারক। তারা লাকীর বড় ভাই দিনমজুর সেলিমকে এ বিষয়ে মামলা করলে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দিচ্ছে বলে জানিয়েছে লাকীর পরিবার। লাকীর পরিবার ও স্থানীয়রা জানায়, গ্রামের বাসিন্ধা জুরাল মিয়া (৭০)। প্রথম স্ত্রী প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে মুরচান বেগম (৫২)। তাঁর তিন ছেলে দানিছ মিয়া (৩০), জাহাঙ্গীর মিয়া (২৭) ও কবির (২৫)। প্রথম স্ত্রী সন্তান রেখেই জুরাল মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন আছমা বেগমকে। তারঁ ঘরে জন্ম নেয় সেলিম, সালমান ও লাকী। লাকী ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। দেড় বছর আগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় লাকীর মা আছমা বেগম। চরম দুঃখ দুর্দশা নেমে আসে তিন ভাই বোনের ললাটে। ঠিক মত তিন বেলার আহারও জুটেনি তাদের ভাগ্যে। সৎ মা মুরচান ও তার তিন ছেলে মিলে তাদের উপর চালাতে থাকে অত্যাচার নির্যাতন। যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে পরিবার ছেড়ে চলে যায় সেলিম। জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে নৌকা চালাতে থাকে সালমান। মেয়ে হওয়ায় সৎ মা ভাইয়ের বর্বর নির্যাতন সহ্য করেই দুনিয়াতে থাকতে চেয়েছিল ওই কিশোরী। কাজের মেয়ের মত খেটেছে সংসারে। শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও তারা পড়া লেখা করতে পারেনি। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। লাকীর বড় ভাই সেলিম জানায়, টাকার অভাবে গত বুধবার খালাম্মার দেওয়া ৪০০ টাকা দামের একটি রুপার চেইন বিক্রি করেছিল লাকী। এই অপরাধে তার বাবা তাকে রাগ করে থাপ্পর দিয়েছিল। এ ঘটনার জের ধরে সৎ মা ও তিন ভাই মিলে ওই রাতেই লাকীর উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। গরুর ঘরে ঢুকিয়ে তারা সকলে মিলে লাকীকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে। চিৎকার করার চেষ্টা করলে মুখে গামছা ঢুকিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে দানিছ লাকীকে মাটিতে ফেলে গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে রাখে। গুরুতর আহত লাকী সারা রাত মৃত্যু যন্ত্রনায় ওই গরুর ঘরেই ছটফট করছিল। তার চিকিৎসার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। লাকীর মুখে বিষ মেখে ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করে। বৃহস্পতিবার সকালে পাশের গ্রাম থেকে লাকীর নানী এসে গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। অবস্থার দ্রুত অবনতি দেখে চিকিৎসক লাকীকে জেলা সদরে প্রেরন করেন। লাকীর নানী হাসেনা বেগম (৫৫) জানান, হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিক্সায় উঠানোর পর লাকী ঘটনার রাতে তার উপর সৎ মা ও ভাইদের নির্মম নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী ব্যাখ্যা করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পথিমধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে লাকী। তারা লাকীর মাকেও একই ভাবে হত্যা করেছিল। খবর পেয়ে সরাইল থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। সেলিম ও লাকীর খালাম্মা খোদেজা বেগম (৩৫) জানান, ঘটনার পর থেকেই সর্দার হাজী ফুল মিয়া, হেবজু, ইদু মিয়া, দারু মিয়া, আক্তার মিয়া, সোহেল ও মিষ্টার মিয়া টাকার বিনিময়ে বিষয়টি নিস্পত্তি করে ফেলার জন্য আমাদেরকে চাপ দিচ্ছেন। হত্যা না করে থাকলে তারা টাকা দিতে চাই কেন ? আমরা গরীব। তাই আমাদেরকে এ ঘটনায় কোন মামলা করলে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা এ হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্ত মূলক বিচার চাই। এ বিষয়ে সালিশকারক হাজী ফুল মিয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এরা গরীব মানুষ। তাই গ্রামের কয়েকজন সালিশকারক নিয়ে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করেছিলাম। পুলিশের সাথেও কথা বলে একটা লাইন করেছিলাম। লাকীর নানী একটা খারাপ মানুষ। সে চিৎকার মেরে না করে দিল। সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার চক্রবর্তী বলেন, এ বিষয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিষ পানের কোন আলামত পায়নি। নিহতের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্নও পায়নি। ময়না তদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারছি না। |